১৯২৫ সালের ৫ ডিসেম্বর। পাবনা জেলার ফরিদপুর উপজেলার গোপালনগর গ্রামের উদ্ভিদবিদ গিরিজাপ্রসন্ন মজুমদার ও সুধা মজুমদার দম্পতির কোল আলো করে জন্ম নিল এক পুত্রসন্তান। বাবার নামের সঙ্গে মিল রেখে নাম রাখা হলো গৌরীপ্রসন্ন। প্রেসিডেন্সি কলেজের খ্যাতনামা অধ্যাপক বাবা ও গৃহিণী মায়ের আদরে বেড়ে ওঠা গৌরীপ্রসন্ন শিশুকাল থেকেই মেধাবী ছিলেন। গ্রামে শৈশব ও কৈশোর কাটিয়ে উচ্চতর পড়ালেখার জন্য তিনি পাড়ি জমালেন কলকাতায়। ভর্তি হলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে, ইংরেজি বিষয়ে। প্রথম প্রথম গ্রামের বাড়িতে আসা–যাওয়া থাকলেও কালে কালে যাতায়াতে ভাটা পড়ে। একে একে পরিবারের অন্যরাও ভারতে চলে যান। পড়ালেখায় মনোযোগী গৌরীপ্রসন্ন ইংরেজি ও বাংলা—দুই বিষয়েই স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছিলেন।
ছোটবেলা থেকেই বিখ্যাত শিল্পীদের গান শুনতে শুনতে বড় হয়েছেন গৌরী। বাড়িতে সকাল-সন্ধ্যা গ্রামোফোনে বিভিন্ন ঘরানার গান বাজত। পাশাপাশি ছিল বই পড়ারও আবহ। দেশি-বিদেশি নানা বই স্কুলজীবনেই হাতের কাছে পেয়েছিলেন তিনি। আর পড়তে পড়তে, শুনতে শুনতে ছাত্রজীবনেই অনুভব করেছিলেন লেখার তাগিদ। ছাত্রজীবনেই কালিদাসের শ্রেষ্ঠ খণ্ডকাব্য‘মেঘদূতম’ ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন। গান লেখার চর্চাও ছাত্রজীবনেই শুরু করেছিলেন। এবং পরে গানেই জীবনের স্বরলিপি রচনা করেছেন।
হঠাৎ গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারকে নিয়ে লেখার কারণ আজ বরেণ্য গীতিকবির জন্মদিন। জন্মদিনে তাঁর কিছু গানের গল্প জেনে নেওয়া যাক। শচীন দেববর্মনের গান পছন্দ করতেন গৌরী। কলেজজীবনে গান লিখে রেডিওতে গান গাওয়ার আবদার নিয়ে দেখা করতে গিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে। আবদারও রেখেছিলেন শচীনকর্তা। আকাশবাণীতে গৌরীর লেখা গান গেয়েছিলেন। সঙ্গে একটা শর্তও জুড়ে দিয়েছিলেন। যে গান রেকর্ডও হবে কিন্তু তার জন্য পড়ালেখা শেষ করতে হবে, স্নাতক হতে হবে। যে কথা সেই কাজ। গৌরী স্নাতক শেষ করলেন। শচীনকর্তাও পূর্ব প্রতিশ্রুতিমতো তাঁকে ডেকে নিলেন। বললেন, ছয়টা গান রেকর্ড করবেন। ছয়টা গানই তাঁকে লিখতে হবে। গৌরীকে আর কে পায়, সারা রাত জেগে গান লিখলেন। কিন্তু একটা গানও পছন্দ হলো না শচীনকর্তার।
গৌরীর মুখ ভার, চোখের কোণে জল। সবটা বিবেচনা করে শচীনকর্তা একটা সুর শুনিয়ে কথা লিখতে বললেন। ‘যেন আলেয়ারে বন্ধু ভাবিয়া হায়, সহেলী গো যে কাছে গেলে দূরে সরে যায়’ লিখলেন গৌরী। গানের কথা শুনে আনন্দিত হলেন শচীন দেববর্মন।
কিন্তু গান তো ছয়টা, বাকিগুলোর কী হবে? হাতে সময় অল্প। মাথায় রাতে লেখা গানগুলোর কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে। কী করি কী করি ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফেরার সময় চালাকি করে বাতিল হওয়া গানের একটি শচীন দেববর্মনের গানের ডালায় রেখে দিলেন। বিকেলে গিয়ে দেখলেন ওই গানেই সুর করছেন শচীনকর্তা। আজীবন স্নেহ ও শ্রদ্ধার সম্পর্ক অটুট ছিল তাঁদের। ‘মেঘ কালো আঁধার কালো’, ‘প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে,’ ‘বাঁশি শুনে আর কাজ নাই’...গৌরীপ্রসন্ন ও শচীন দেববর্মন জুটির উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা কেন্দ্র থেকে গান লেখার অনুরোধ পেতেই কিছু সময়ের মধ্যে লিখেছিলেন কালজয়ী এক গান। ‘মাগো ভাবনা কেন/ আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে/ তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে ধরতে জানি/ তোমার ভয় নেই মা আমরা প্রতিবাদ করতে জানি।’ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে গানটা শক্তি জুগিয়েছিল। আজও দ্রোহে, সংগ্রামে প্রতিবাদী উচ্চারণে গানটা একইভাবে আপন হয়ে ওঠে।
অমল মুখোপাধ্যায় সংগীত পরিচালনার সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু গান কোথায়, সেই গান যে গান সময়ের স্রোতে চিরদিন অমলিন হয়ে থাকবে। নিস্তার পেতে গৌরীর কাছে দৌড়ে এলেন। বললেন, ‘গৌরীদা, এমন একটা গান লিখে দিন, যেন আমি চিরদিন থেকে যেতে পারি বাংলা গানে।’ কাগজে–কলমে সুন্দর কারুকার্যময় অক্ষরে গৌরী লিখলেন, ‘এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায় এ কী বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু’। কালের পরিক্রমায় গানটা যে কতটা জনপ্রিয় হয়েছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
১৯৫১ সালের সিনেমা ‘অমর ভূপালী’। পরিচালক ভি শান্তারাম। সিনেমায় গান গাইবেন জগন্ময় মিত্র। কিন্তু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন শিল্পী। শান্তারামের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। গান গাইবে কে? উতরে দিলেন গৌরীপ্রসন্ন। মান্নাদের নাম প্রস্তাব করলেন। বাংলা গান গাওয়ার জন্য মান্না দেকে উৎসাহ দিতেন গৌরী। মান্নাদেও রাজি হলেন। গৌরী তাঁর জন্য লিখেছিলেন ‘তীর ভাঙা ঢেউ আর নীড় ভাঙা ঝড়’। এরপর ‘হাজার টাকার ঝাড়বাতিটা’, ‘যদি কাগজে লেখো নাম’, ‘আমি যামিনী তুমি শশী হে’, ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা’…একটার পর একটা গান। গৌরী-মান্না জুটির বেশির ভাগ গানই শ্রোতাদের মন জিতে নিয়েছে।
নিজের মতো লেখার পাশাপাশি সুরের ওপর কথা বসিয়ে গান লেখার কাজটিও সুনিপুণ হাতে করেছেন গৌরীপ্রসন্ন। সিনেমার ক্ষেত্রে বরাবরই গান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এমনকি কথিত আছে যে গান হিট তো সিনেমা হিট। আর গৌরীপ্রসন্নর শব্দের দীপ্তি এতটাই প্রবল ছিল যে তাঁর গানের জন্য প্রশংসা কুড়িয়েছে অনেক সিনেমা, সুপারহিট হয়েছে। বিশেষ করে গৌরীপ্রসন্ন ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায় জুটির স্পর্শে সিনেমা ও সংগীতাঙ্গন আলোকিত হয়েছে। ‘এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে না তো মন’ গানটির কথাই বলা যাক।
১৯৬০ সালের ‘শেষ পর্যন্ত’ সিনেমার প্রযোজকের অনুরোধে গানটা লিখেছিলেন তিনি। প্রযোজক একদিন তাঁর কাছে গিয়ে বললেন, ‘আমার সব ছবি ফ্লপ করছে। এবার আপনাকে আর হেমন্তদাকে নিয়েছি। এ ছবি হিট না করলে আমি পথে বসে যাব।’ গৌরী তাঁকে নিরাশ করলেন না। বাংলা গানের সবচেয়ে আলোচিত গানের একটি লিখে দিলেন। এ ছাড়া ‘কেন দূরে থাকো শুধু আড়াল রাখো’, ‘এই বালুকাবেলায় আমি লিখেছিনু’…গৌরীর গান আলো ছড়িয়েছে সিনেমাটিতে। সিনেমাটি কিন্তু বাজিমাত করে দিয়েছিল।
‘এবারে যাওয়াই ভাল/ তুমি থাকো, আমি যাই’ গানটি লিখেছিলেন শ্যামল মিত্রের জন্য। ১৯৮৬ সালের মে মাসে। গৌরী তখন অসুস্থ। গানটা রেকর্ডিংয়ের পর স্টুডিওতে দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। এভাবে দিন বাড়তে বাড়তে একসময় শরীরের অবস্থাও ক্রমেই খারাপ হতে থাকে গৌরীর। ১৯৮৬ সালের ২৫ জুন চিকিৎসার জন্য তাঁকে বোম্বে নিয়ে যাওয়া হয়। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগে গৌরী লিখেছিলেন ‘যেতে দাও আমায় ডেকো না, কবে কি আমি বলেছি মনে রেখো না’। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে লিখেছিলেন শেষ গান, ‘এবার তাহলে আমি যাই, সুখে থাক ভালো থাক, মন থেকে এই চাই’। অসংখ্য কালজয়ী গানের স্রষ্টা, বাংলা সংগীতের আকাশের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র এই গীতিকবি ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৮৬ সালের ২০ আগস্ট ৬২ বছর বয়সে না–ফেরার দেশে পাড়ি জমান।