বেশ চলছিল সবকিছু। ছেলে কানাডার একটি কলেজে ডিজিটাল মার্কেটিংয়ে পড়াশোনায় ব্যস্ত। বাবা উত্তরার বাড়িতে বসে একদিন একমাত্র ছেলেকে নিয়ে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে অনেক স্বপ্ন ও আশার কথা শুনিয়েছিলেন। কথাগুলো বলতে বলতে গর্বে বুক ভরে যাচ্ছিল তাঁর। জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী বাবাও দেশ–বিদেশে গানে গানে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছিলেন। শ্রোতাদের মাতিয়ে চলছিলেন।
হঠাৎ একটি দুর্ঘটনা যেন মুহূর্তেই সব হিসাব–নিকাশ পাল্টে দেয়। কানাডায় ঘটে যাওয়া সেই দুর্ঘটনায় ছেলে কুমার নিবিড় এতটাই মারাত্মকভাবে আহত হন, এর পর থেকে বাবা ডাক শোনা থেকে বঞ্চিত হন কুমার বিশ্বজিৎ। ১৪ মাস ধরেই এমন অবস্থা চলছে। সন্তানের মুখে বাবা ডাক শোনার প্রহর গুনছেন দেশের জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী বাবা কুমার বিশ্বজিৎ। আশায় বুক বেঁধেছেন বাবা। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকা নিবিড়কে এখন চেয়ারে বসানো যাচ্ছে। চোখ মেলে তাকিয়ে বাবা–মাকে দেখছেনও। আজ মঙ্গলবার দুপুরে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে এমনটাই জানালেন কুমার বিশ্বজিৎ।
১৪ মাস ধরে কুমার বিশ্বজিৎ অবস্থান করছেন কানাডার টরন্টোয়। সেখানে সেন্ট মাইকেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তাঁর একমাত্র সন্তান কুমার নিবিড়। গত বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মকভাবে আহত হন নিবিড়। তার পর থেকেই বাবা–মা দুজনেরই ঠিকানা সেই সেন্ট মাইকেল হাসপাতাল। দীর্ঘ ১৪ মাস কুমার বিশ্বজিৎ ছিলেন সুরের বাইরে। ১৮ এপ্রিল সপ্তাহ তিনেকের জন্য ঢাকায় এসেছেন তিনি। গত বছরের নভেম্বরেও একবার এসেছিলেন।
ছেলের সর্বশেষ শারীরিক অবস্থা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কুমার বিশ্বজিৎ বললেন, ‘শারীরিক অবস্থা কিছুটা উন্নতির দিকে। কিন্তু কবে যে পুরোপুরি সুস্থ হবে, তা বলা মুশকিল। এখনো হাসপাতালে থাকতে হচ্ছে। আমি কানাডায় যাওয়ার পর হাসপাতাল থেকে রিহ্যাবে নেওয়া হবে।'
কুমার বিশ্বজিৎ বললেন,‘ রিহ্যাবে নেওয়ার পর ফিজিওথেরাপি, স্পিচথেরাপি, স্টিমিউলেটেড থেরাপি। এসব থেরাপি হাসপাতালে ওইভাবে হয় না। নিবিড়ের চিকিৎসা এখন আর হাসপাতালের নয়, তাই কানাডায় ফিরে রিহ্যাবে নেওয়ার সব ধরনের ব্যবস্থা করতে হবে। রিহ্যাবের সময়টাও দীর্ঘ। তাই ওটা শুরুর আগে দেশের কিছু কাজ গুছিয়ে নিতে এলাম।’
কুমার বিশ্বজিৎ জানালেন, ‘নিবিড়ের মা অনেক কষ্ট করছে। সকালে হাসপাতালে আসা, এরপর রাতে আবার বাসায় যাওয়া—সব মিলিয়ে কঠিন সময় কাটছে। যদিওবা আমাদের আত্মীয়স্বজনও আছেন। তাঁরাও হাসপাতালে বিভিন্ন সময় আসেন, নিবিড়ের দেখাশোনায় সময় দেন।’
কানাডার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছেলে নিবিড়ের মুখে বাবা–মা ডাক শোনার জন্য তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকেন কুমার বিশ্বজিৎ ও তাঁর স্ত্রী নাঈমা সুলতানা। কবে নিবিড়ের কণ্ঠে বাবা–মা ডাক শোনা যাবে, তা এখই বলা যাচ্ছে না। তবে চিকিৎসাবিদ্যার সব ধরনের চেষ্টা চলছে। এখন কিছুটা উন্নতির দিকে শারীরিক অবস্থা।
এ প্রসঙ্গে কুমার বিশ্বজিৎ বললেন, ‘এত মাস তো হাসপাতালের বিছানায় শোয়া ছিল। এখন নিবিড়কে তুলে চেয়ারে বসানো যায়। ঘাড় ঘোরায় সে। হাত-পা ফ্লেক্সিবল হয়েছে আরকি। এত লম্বা সময় বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে হাত–পা সব অসাড় হয়ে গিয়েছিল। মাস দুয়েক ধরে চেয়ারে তুলে বসানো হচ্ছে। সবকিছু আস্তে আস্তে হচ্ছে, খুবই ধীরে ধীরে। খাবার এখনো কৃত্রিম উপায়ে খাওয়ানো হচ্ছে।’
কুমার নিবিড় এখন চোখ মেলে তাকান। তাকিয়ে মা–বাবাকে দেখেন, জানালেন কুমার বিশ্বজিৎ। প্রশ্ন ছিল নিবিড় কি তাঁর বাবা–মাকে চিনতে পারেন?
‘নিবিড়ের এক্সপ্রেশনে দেখে মনে হয়, বাবা-মাকে চিনছে। আমাদের চেনে। অনেক সময় তাকানো, ৩৬০ ডিগ্রিতে ঘোরা। এরপর যখন বলা হয়, “বাবা আসছে, মা আসছে”, তখন বোঝা যায়, আমাদের চেনে। মা যখন বলে, “আমাদের চিনতে পারো?” তখন তার এক্সপ্রেশনে বুঝতে পারি, হয়তো চিনছে। অপেক্ষায় আছি কখন বাবা বলে ডাকবে।’ বললেন কুমার বিশ্বজিৎ।