বহু জনপ্রিয় ও কালজয়ী গানের শিল্পী তিনি। বরেণ্য সংগীতশিল্পী শাহনাজ রহমতউল্লাহ গত শনিবার রাত সাড়ে ১১টায় মৃত্যুকে বরণ করে নিলেন। এক সংগীত পরিবারে তাঁর জন্ম হয়েছিল। তাঁর দুই ভাই ছিলেন আনোয়ার পারভেজ (সুরকার) ও জাফর ইকবাল (চিত্রনায়ক ও গায়ক)। গান থেকে বহুদিন দূরে থাকা এই মানুষটির হঠাৎ মৃত্যুর খবরে সংগীতাঙ্গন শোকাহত। তাঁকে শ্রদ্ধা জানালেন, স্মরণ করলেন বাংলাদেশের চারজন সংগীতশিল্পী।
আমাদের মধ্যে ছিল আত্মার সম্পর্ক
সৈয়দ আব্দুল হাদী
এ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত! আমার মনে হচ্ছে, এ বছর শিল্পীদের জন্য খুব দুঃসময়। এতগুলো মানুষ অকালে চলে যাওয়ায় মনের ওপর খুব চাপ পড়ছে। তাঁদের জন্য খারাপ লাগছে।
শাহনাজ রহমতউল্লাহর সঙ্গে আমার পরিচয় হয় সেই ষাটের দশকে। আমি তখন টেলিভিশনের প্রযোজক। তাকে নিয়ে এলাম গান গাওয়াতে। তখন থেকে সে টেলিভিশনে গান গাইত। তারপর একবার আমরা দুজন মিলে একটা দ্বৈত গান করেছিলাম। ‘সাগরের তীর থেকে’ গানটি বেশ জনপ্রিয় হয়। এরপর অনেক গানই আমরা একসঙ্গে করেছি। আমরা গানের সহযাত্রী ছিলাম।
আমাদের মধ্যে ছিল আত্মার সম্পর্ক। নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। শেষবার কথা হলো চ্যানেল আইয়ের একটি অনুষ্ঠানে। ওই অনুষ্ঠানেও আমরা খালি গলায় ওই গান পরিবেশন করেছিলাম। তার কিছু অভিমান ছিল। সেসব থাক, শুধু এতটুকু বলব, শাহনাজের মতো এত সুন্দর কণ্ঠের অধিকারী সংগীতশিল্পী আমাদের উপমহাদেশে খুব কম আছে।
মেনেই নিতে পারছি না
সাবিনা ইয়াসমীন
আমি ‘শাহিন’ বলেই ডাকতাম। একেবারেই ছোটবেলার সম্পর্ক আমাদের দুজনের। বয়সে এক–দুই বছরের ছোট–বড় আমরা। কিন্তু বন্ধুর সম্পর্ক। ১৯৬৬ বা ৬৭ সালের দিকে রেডিওতে ‘খেলাঘর’ অনুষ্ঠানে শিশুশিল্পী হিসেবে আমরা দুজন গান করতাম। পরে আমরা দ্বৈতকণ্ঠে ছয়–সাতটি চলচ্চিত্রের গান করেছি। যখন এফডিসিতে গাইতে যেতাম, খুব আড্ডা হতো। তার গাওয়া আমার একটি প্রিয় গান ‘তোমার আগুনে পোড়ানো এ দুটি চোখে’ দেখা হলেই গাইতে বলতাম। শাহিন উল্টো আমাকেই গাইতে বলত। অনেক দিন গান থেকে দূরে ছিল। শেষবার সাত–আট বছর আগে চট্টগ্রামে একটি অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছিল। এরপর ফোনে কথা হতো। কিন্তু আজ হঠাৎ শাহিন এভাবে আমাদের ছেড়ে চলে যাবে, বিশ্বাস হয় না। কারণ এর মধ্যে কোনো দিন তার অসুস্থ হওয়ার খবরও শুনিনি। মেনেই নিতে পারছি না। আমার মনটা খুব খারাপ। তাকে ঘিরে কতশত স্মৃতি। খুব কষ্ট হচ্ছে। এত বড় মাপের শিল্পী, এখনই চলে যাওয়া ঠিক হয়নি। সে এখন গাইত না, কিন্তু এমন শিল্পীর কাছ থেকে অনেক কিছু জানার ছিল, শেখার ছিল।
দ্য বেস্ট সিঙ্গার ইন বাংলাদেশ
খুরশীদ আলম
আমি বলব, শাহনাজ রহমতউল্লাহ দ্য বেস্ট সিঙ্গার ইন বাংলাদেশ। এটা আমার ব্যক্তিগত অভিমত, কারও সঙ্গে দ্বিমত হতে পারে। তিনি সংগ্রাম করে তাঁর এই জায়গা তৈরি করেছেন। তাঁর পরিবার ছিল সংগীতের। আনোয়ার পারভেজ তাঁর বড় ভাই, ছোট ভাই জাফর ইকবাল। তাঁর এই শিল্পী হয়ে ওঠার পেছনে বড় অবদান ছিল তাঁর মায়ের। দেশের গানে তিনি অনবদ্য। শাহনাজ রহমতউল্লাহ যতগুলো গান গেয়েছেন, কোনো গান ফেলা যাবে না। তিনি বড় মাপের শিল্পী ছিলেন। সবাইকে যতটুকু শ্রদ্ধা, যাকে যতটুকু আদর করা দরকার, তিনি করতেন। তাঁর চলে যাওয়া একটা অপূরণীয় ক্ষতি। তাঁকে আমি ছোট বোনের মতো স্নেহ করি। তিনি থাকতেন নয়াপল্টনে, আমি পুরানা পল্টনে। তাঁর স্বামী অবসরপ্রাপ্ত মেজর রহমতউল্লাহ আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তিনি আমার বাবার ছাত্র ছিলেন। আমরা ছিলাম খুবই কাছের। আমি বেতার ও টেলিভিশনে গান করেছি তাঁর সঙ্গে। আপনজন সিনেমাতে একসঙ্গে গান করেছিলাম।'
সরলতা তাঁর সবচেয়ে বড় সম্পদ
ফাহমিদা নবী
শাহনাজ রহমতউল্লাহ আমার আদর্শ। ছোটবেলা থেকেই তাঁর প্রতি আমার একটা অদ্ভুত মুগ্ধতা ছিল। যেভাবে তিনি তাকাতেন, যেভাবে অভিব্যক্তি প্রকাশ করতেন, তা হৃদয় ছুঁয়ে যেত। তিনি ছিলেন প্রাণের শিল্পী। হৃদয় দিয়ে গাইতেন তিনি। তাই হৃদয় ছুঁয়ে যেত তাঁর গান। প্রতিটি সুর, প্রতিটি এক্সপ্রেশন ফিল করতে পারতাম। তাঁর নতুন কোনো একটা গান আসা মানেই ছিল সেটা আমার তুলতে হবে। আমি আর সুমা (সামিনা চৌধুরী) প্রথমবার যখন তাঁর বাসায় একটি গানের আসরের জন্য গিয়েছিলাম, আমাদের সে কী উত্তেজনা! কোনো সাজগোজ করিনি, কোনো উচ্চকিত প্রস্তুতিও ছিল না। কারণ, তাঁর গানের সামনে সব ধরনের অলংকার ম্লান। আমরা তাঁর বাড়ি গিয়ে দেখলাম, তিনি অত্যন্ত সরল আর সহজ একজন মানুষ। এক হাতেই অতিথিদের আপ্যায়ন করছেন, রাঁধছেন, আবার গানের আসরে এসে গান গেয়ে মুগ্ধ করছেন। সরলতা তাঁর সবচেয়ে বড় সম্পদ। তিনি যে আমার মতো অনেক অনেক শিল্পীর আদর্শ ছিলেন, এই অভিব্যক্তি তাঁর ভেতর কোনো দিন দেখিনি।