হ‌ুমায়ূন ভাই যখন গানবাজনায় নেই, তখন আমার গানবাজনা শুরু

আদিতে বারী সিদ্দিকী ছিলেন বংশীবাদক। কিন্তু বাঁশি তাকে পরিচিতি এনে দিতে পারেনি, উল্টো কপালে জুটেছে নিন্দামন্দ। মনের কষ্টে তাই গান গাইতে শুরু করেন। তাঁর গান শুনে অনেকেই অবাক, এত বছর কেন নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিলেন! শুনে তিনি দুঃখে হাসতেন। বলতেন, বাঁশি বাজিয়ে তাহলে বড় শিল্পী হওয়া যায় না। দেশের বাইরে কিন্তু বাঁশির জন্যই বেশি পরিচিত ছিলেন বারী সিদ্দিকী। ১৯৯৯ সালে বিশ্ব খাদ্য সম্মেলনে এই উপমহাদেশ থেকে তিনি প্রতিনিধিত্ব করেন। চার বছর আগে আজকের দিনে মারা যান গুণী এই সাধক।

শৈশবে পরিবারের সবাই একটু একটু গানবাজনা করতেন। তাঁর মা গান জানলেও করতেন না। মহিলাদের গান করা তখন নিষেধ ছিল। মা তাঁকে উৎসাহ দিতেন। পরে তাঁর ভাইয়েরা বাঁশি বাজানো শেখেন। এভাবে সংগীতের প্রতি তাঁর ভালোবাসা জন্মে
ছবি:সংগৃহীত
ডিগ্রি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রন্থাগার বিজ্ঞান ও ইসলামের ইতিহাস বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। কিন্তু পড়াশোনা শেষ না করেই ভারতের পুনেতে চলে যান। সেখানে মিউজিকের ওপর পড়াশোনা করেন
ফিরে এসে ঘরোয়া মজলিশে গান করা শুরু করেন। আনুমানিক ১৯৯৩ সালের দিকে হ‌ুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। পরে এই প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ৯৩/৯৪ সালের দিকে শ্রদ্ধেয় হ‌ুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে আমার মাখামাখি শুরু হয়
বাঁশিই ছিল তাঁর প্রথম প্রেম। এই বাঁশির জন্য অনেক নিন্দামন্দও হজম করতে হয়েছে। কাছের অনেকের কাছে এটাও শুনতে হয়েছে, ও বাঁশিওয়ালা, গানের কী বোঝে? গান হচ্ছে প্রশান্ত মহাসাগর। আর বাঁশি বাজানো বুড়িগঙ্গার মতো ছোট বিষয়
৫. সুবীর নন্দী, আলম আরা মিনু, ডলি সায়ন্তনী, বেবি নাজনীন, বাদশা বুলবুল, মনির খান, আসিফসহ অনেকের গানে একসময় সুর করা শুরু করেন। তখন তাঁর গুরুত্ব বেড়ে যায়। এই ঘটনাও তাঁকে কষ্ট দিয়েছিল। কারণ, নিজের কাছে তাঁর বড় পরিচয় ছিল বাঁশিবাদক
বাঁশিবাদক হিসেবে মূল্যায়িত না হওয়ায় একসময় গান করা শুরু করেন। এই ঘটনা প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘জীবন–যৌবন বাঁশির পেছনে ধ্বংস করলাম। হাত বাঁকা হয়ে গেছে। এত কিছু করে লাভ কী হলো? গান গাইতে হবে। আচ্ছা, ঠিক আছে। শুরু করলাম নিজের টাকা দিয়ে গান রেকর্ড করা। দুই–তিনটা গান হ‌ুমায়ূন আহমেদ ভাইকে শোনাই। পরে হ‌ুমায়ূন ভাই “পুবালি বাতাস”সহ দুটি গান তাঁর সিনেমায় ব্যবহার করেন। গানগুলো তুমুল জনপ্রিয় হয়।’
অনেকেই মনে করেন, হ‌ুমায়ূন আহমেদ তাঁকে মিডিয়ায় এনেছেন। কিন্তু এটা সত্য নয়—দাবি বারী সিদ্দিকীর। এই গায়ক এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘হ‌ুমায়ূন ভাই আমার যে গান সিনেমায় ব্যবহার করেছিলেন, তার তিন বছর আগে গানটি রেকর্ডিং করা। হ‌ুমায়ূন ভাই যখন গানবাজনায় নেই, তখন আমার গানবাজনা শুরু। তিনি অনেক ট্যালেন্ট মানুষ ছিলেন। আমার কাছে মনে হয়েছিল, হ‌ুমায়ূন ভাই যদি গান দুইটা ব্যবহার করেন, তাহলে কিছু একটা হবে। পরে আমি হ‌ুমায়ূন আহমেদের কাছে ধরা দিই। তবে আমার গাওয়ার পেছনে তিনি যথেষ্ট উৎসাহ দিয়েছিলেন। মূলত তাঁর সাহস নিয়েই সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রয়াস পেয়েছি।’
বারী সিদ্দিকীর জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে রয়েছে—‘শুয়াচান পাখি, আমি ডাকিতাছি, তুমি ঘুমাইছ নাকি’, ‘পুবালি বাতাসে’, ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়’, ‘ওলো ভাবিজান নাউ বাওয়া’, ‘মানুষ ধরো, মানুষ ভজো’সহ একাধিক গান। ছবি:সংগৃহীত
তিনি মনে করতেন, শিল্পী হিসেবে তিনি কিছুটা অস্বাভাবিক জীবন যাপন করেন। গান ছাড়া অন্য কিছু বুঝতেন না। গানের কারণে গভীর রাতে বাসায় ফিরতেন
মূল্যায়ন নিয়ে সব সময়ই আফসোস করতেন। তবে কাজে বিশ্বাসী ছিলেন, কোনো দুঃখ ছিল না। আর নিজের গান প্রস্তুত করার পর কখনোই দুই–একবারের বেশি সেটি শুনতেন না। তিনি মনে করতেন, কিছুই হয়নি। তিনি আফসোস করে এক সাক্ষাৎকার বলেন, ‘প্রতিবারই মনে হতো, কী ভাবলাম, আর কী হলো!’