রফিকুল আলম ও শাহিন সামাদ
রফিকুল আলম ও শাহিন সামাদ

স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের দুই শিল্পীর কথা

মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র অনন্য অবদান রেখেছে, এটা সর্বজনবিদিত এবং অনস্বীকার্য। বলা হয়ে থাকে মুক্তিযুদ্ধকালীন স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র ছিল মুক্তিপাগল সব বাঙালির হৃৎপিণ্ড। যুদ্ধের সময়ে প্রতিদিন মানুষ অধীর আগ্রহে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের অনুষ্ঠান শোনার জন্য অপেক্ষা করত। সমর দাস, আবদুল জব্বার, আপেল মাহমুদ, রথীন্দ্রনাথ রায়, লাকী আখন্দ, বুলবুল মহালনবীশ, ফকির আলমগীর, তিমির নন্দী, মলয় গাঙ্গুলী, রফিকুল আলম, শাহিন সামাদ প্রমুখের মতো শিল্পীরা ঋদ্ধ করেছিলেন উদ্যোগটিকে। তাঁদের মধ্যে দুজন শিল্পীর কথা আবার শুনব আজ।রফিকুল আলম
সে সময় আমার ভেতর একটা অনুভূতিই কাজ করত, আমার জন্মই হয়েছে যুদ্ধজয়ের জন্য। মনে হতো পৃথিবীতে আমি একা, আমার কেউ নেই। সত্যিকার অর্থে অন্য কোনো ধরনের চিন্তা কাজ করত না। পরিবার-পরিজনের কথাও মনে হতো না। কেবল একটাই অনুভূতি কাজ করত, তা হলো যুদ্ধে জয়লাভ করা। কীভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লেন, সেই বর্ণনায় তিনি বলেন, যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, তখন আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।

যখন বোমা হামলা শুরু হলো, তখন বুঝলাম শহর এলাকায় আর থাকা যাবে না। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভারতের মুর্শিদাবাদ এলাকায় চলে গেলাম। সেখানে থাকার সময় পত্রিকায় একটা বিজ্ঞাপন দেখলাম। ওই বিজ্ঞাপনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ভারতে চলে যাওয়া শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের ভারতে অবস্থিত আন্তর্জাতিক শান্তি পরিষদে যোগাযোগ করতে বলা হয়। আমি তখন রাজশাহীর রেডিওর তালিকাভুক্ত শিল্পী ছিলাম। যাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম, তাঁদের নিয়ে ‘বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সহায়ক সমিতি’ নামের একটি সংগঠন গঠন করা হলো। ঠিক হয় সংগঠনের শিল্পীরা মুক্তাঞ্চলে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গান গাইবেন। সেখান থেকেই স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে যোগদান করি। তখন আমাদের সঙ্গে ছিলেন কাদেরী কিবরিয়া, অজিত রায়, আপেল মাহমুদ, আবদুল জব্বার এবং অনেকে।

রফিকুল আলম । ছবি: ফেসবুক থেকে

তখনকার সময়ের গান সম্পর্কে রফিকুল আলম বলেন, যে গানটিতে প্রথম কণ্ঠ দিই, সেটি হলো, ‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি... ’ এরপর আমাকে একটা গান করতে বলা হয়। আমার বড় ভাই ড. সারওয়ার জাহান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি একটি গান লিখেন ‘সাত কোটি আজ প্রহরী প্রদীপ’—এই গানটি রেকর্ডিং করি। আরও অনেক গান আছে, যা হৃদয়ে উত্তেজনা আনত।

একজন কণ্ঠসৈনিক হিসেবে নিজের ভূমিকা নিয়ে রফিকুল আলম বলেন, সে সময় আমরা কয়েকজন মিলে গিয়েছিলাম অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করতে। কিন্তু আমাদের বলা হয়, আমাদের আরও অনেক বড় দায়িত্ব আছে। যুদ্ধ পরিচালনা করার জন্য মানুষকে অবহিত করা, উদ্দীপিত করা—গানের মাধ্যমে। তাই পরে কণ্ঠসৈনিকের দায়িত্ব নিই।
স্বাধীনতা–পরবর্তী কাজ সম্পর্কে রফিকুল আলমের বক্তব্য, শব্দসৈনিক মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার বক্তব্য—একটা দেশ যখন গড়ে ওঠে, তার হৃতগৌরব ফিরে পেতে চায়, এটা বলা যাবে না তার শেষ কবে, কোথায়। আমাদের সর্বক্ষণ এটাই মনে রাখতে হবে, আমরা একটা স্বাধীন দেশের নাগরিক, দেশ গড়ার দায়িত্ব আমাদের সবার।

শাহীন সামাদ । ছবি: ফেসবুক থেকে

শাহীন সামাদ
প্রথম যখন আমরা স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের শিল্পীরা যাত্রা শুরু করি, তখন আমাদের সংখ্যা ছিল মাত্র ১৭। ধীরে ধীরে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭৭-এ। শুধু প্রতিষ্ঠিত শিল্পীরাই নন, যাঁরা গান গাইতে পারতেন, তাঁরাও আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। সে সময় আমাদের সঙ্গে গান গাইতেন বিপুল ভট্টাচার্য, তারেক আলী, মিলি, আলী, ফ্লোরা, শারমি, নায়লা, মোসাদ আলী—বলছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সময়কার স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের কণ্ঠশিল্পী শাহীন সামাদ।

সেই সময়ের কথা, মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতে গিয়ে শাহীন সামাদ বলেন, আমরা গানের মাধ্যমে যুদ্ধ করতাম। অস্ত্র নিয়ে হয়তো যুদ্ধ করা হয়নি। কিন্তু কণ্ঠ দিয়ে যুদ্ধ করতে পেরেছিলাম। যুদ্ধক্ষেত্র হয়তো দেখতে পেতাম না, কিন্তু সে সময়ে দেশের গানগুলো শুনতে, গাইতে অসম্ভব ভালো লাগত, একটা উদ্দীপনা কাজ করত। সেই উদ্দীপনা ছড়িয়ে পড়ত সাধারণ মানুষের ভেতর।

কীভাবে তিনি স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে জড়ালেন? জানালেন শাহীন সামাদ, মাত্র ১৩ বছর বয়সে আমি আমার বাবাকে হারিয়েছি, মাকে একা ফেলে চলে গিয়েছিলাম। যোগাযোগের কোনো উপায় ছিল না। চিঠিপত্র লেখার ব্যবস্থা ছিল না। জীবনের কোনো নিশ্চয়তা ছিল না, তবু কী এক আকর্ষণে সবকিছুকে তুচ্ছ করে যুদ্ধে, দেশের গান গাইতে গিয়েছিলাম। আজ নিজে মা হয়ে বুঝতে পারছি, মাকে কত কষ্ট দিয়েই তখন দেশমাতার কাজে গিয়েছিলাম।
মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর কথা জানতে চাইলে শাহীন সামাদ বলেন, আমরা তখন বিভিন্ন জায়গায় গান গাইতাম, স্টেজ করতাম। সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা, তাদের সহযোগিতা ছিল অসাধারণ। যখন কোনো স্টেজে গান গাইতাম সেখানে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করত। আমাদের স্টেজ শো করতে সাহায্য করতেন সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবীরা পর্যন্ত।

স্টেজ শোর অর্থ দিয়ে আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কাপড়চোপড়, কম্বল থেকে শুরু করে খাদ্যদ্রব্য, এমনকি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যও কিনতাম। তাঁদের মধ্যে গোপনে বিলি করতাম, শরণার্থী ক্যাম্পে দিয়ে আসতাম।মুক্তিযুদ্ধের সময়কার গানগুলো কেমন ছিল? কণ্ঠসৈনিক শাহীন সামাদের কথায়, সে সময়ের গানগুলোয় অন্য রকম একটা আবেদন ছিল। সাধারণ মানুষের কাছে গেলে বোঝা যেত গানগুলো তাদের কেমন আলোড়িত করত। যেমন ‘একী অপরূপ রূপে মা তোমায়’, ‘জনতার সংগ্রাম চলবেই’, ‘ওরে উঠরে জগদ্বাসী’, ‘ নাই নাই ভয়’, ‘আমি তোমায় ছাড়ব না’, ‘দেশে দেশে ভ্রমি তব দুঃখে গান গাহিয়ে’ আরও অনেক গান। আমরা ট্রাকে করে যেতাম গান গাইতে গাইতে। আর বিজয়ের দিনে সাধারণ মানুষের যে সম্মান আমরা পেয়েছি, তা বলে বোঝানো যাবে না। সেই সম্মানের তুলনা হয় না। সব সময়ই শঙ্কা কাজ করত, যাদের ফেলে এসেছি তাদের পাব কি না, আবার তাদের মুখ দেখব কি না।’

(প্রথম আলোতে প্রকাশিত সাক্ষাৎকার থেকে নেওয়া)