১৯৩৯ সালে আজকের এই দিনে জন্ম হয়েছিল বাংলা গানের কর্তা হিসেবে খ্যাত শচীন দেববর্মনের পুত্র রাহুলের
১৯৩৯ সালে আজকের এই দিনে জন্ম হয়েছিল বাংলা গানের কর্তা হিসেবে খ্যাত শচীন দেববর্মনের পুত্র রাহুলের

সুরে–ছন্দে অপার বিস্ময় রাহুল দেববর্মন

উপমহাদেশের সংগীতের কিংবদন্তি রাহুল (আর ডি) দেববর্মন। জন্মগ্রহণ করেছিলেন কলকাতায়, ত্রিপুরার এক সংগীতপ্রেমী রাজপরিবারে। আজ সুবিখ্যাত সুরকার ও শিল্পী রাহুল দেববর্মনের জন্মদিন। ১৯৩৯ সালে আজকের এই দিনে জন্ম হয়েছিল বাংলা গানের কর্তা হিসেবে খ্যাত শচীন দেববর্মনের পুত্র রাহুলের। অসংখ্য জনপ্রিয় হিন্দি, বাংলা আধুনিক ও চলচ্চিত্রের গানের সুরকার ও সংগীত পরিচালক আর ডি বর্মন। জন্মদিনের সূত্রে তাঁকে স্মরণ করেছেন বাংলাদেশের সংগীতজগতের পরিচিত মুখ, অনেক জনপ্রিয় গানের গীতিকার শহীদ মাহমুদ জঙ্গী

রমেশ সিপ্পি পরিচালিত অমিতাভ বচ্চন, ধর্মেন্দ্র, জয়া ভাদুড়ী, হেমা মালিনী অভিনীত ছায়াছবি ‘শোলে’ মুক্তি পায় ১৯৭৫ সালে। সর্বকালের অন্যতম ব্লকবাস্টার হিট হিসেবে বিবেচিত এই ছবির সংগীত পরিচালনা করেন রাহুল দেববর্মন। এই ছবির একটি দৃশ্যে নায়ক বিরু ও নায়িকা বাসন্তীকে নিয়ে ছুটে চলা ঘোড়াকে ধাওয়া করছে ভিলেন গব্বরের লোকজন। শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। কেউ কল্পনা করতে পারে না যে এ ধরনের উত্তেজনাকর দৃশ্যের মিউজিকে তবলার ব্যবহার হতে পারে। সব ধরনের কল্পনাকে হার মানিয়ে রাহুল উত্তেজনাকর ওই দৃশ্যের মিউজিকে তবলা ব্যবহার করেছেন।
কিছুদিন আগে এক সন্ধ্যায় সুরকার নকীব খান ও সংগীতশিল্পী কুমার বিশ্বজিতের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলাম। এই প্রসঙ্গ তুললাম। নকীব রিদমের ওপর রাহুলের অসাধারণ দখলের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘একমাত্র রাহুলই তাল নিয়ে নিত্যনতুন নিরীক্ষা করেছেন। “শোলে” ছবির কথিত দৃশ্যে তবলার ব্যবহার রাহুলের সফল নিরীক্ষাগুলোর একটি।’ বিশ্বজিৎ বলেন, আর ডি বর্মন এশিয়ায় এ ধরনের কাজ প্রথম করেছেন। তুলনাহীন পারফেকশনিস্ট ছিলেন। একমাত্র তাঁর পক্ষেই সম্ভব এ ধরনের কাজ করা।
কুমার বিশ্বজিৎ অনলাইনে যুক্ত করলেন কলকাতার মিউজিশিয়ান রকেট মণ্ডলকে, যিনি রাহুলের সঙ্গে কাজ করেছেন। এ বিষয়ে তিনি একটা শব্দই উচ্চারণ করলেন ‘ঐশ্বরিক’। জানালেন, তবলা বাজিয়েছিলেন সমতা প্রসাদ। রাহুল এবং তবলা প্রসঙ্গ এলে তবলাবাদক ব্রজেন বিশ্বাসের কথা এসে যায়। তবলার ওপর ব্রজেনের ব্যাপক দখল ছিল।

রাহুল দেববর্মন

থাকতেন কুমিল্লায়। খুব ইচ্ছা ছিল শচীনকর্তার সঙ্গে বাজাবেন। শচীনকর্তা সম্পর্কে জানতেন। কিন্তু কর্তাকে সামনাসামনি দেখেননি। ব্রজেন অনেক চেষ্টা করে শচীন দেববর্মনের কলকাতার বাসার ঠিকানা জোগাড় করেন।

তারপর একদিন শচীনকর্তার বাসায় হাজির হলেন। তিনি দেখলেন, এক ভদ্রলোক গেটের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে কিছু একটা বলছেন। ব্রজেন বিশ্বাস তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। শচীনকর্তার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করে নিজেকে কুমিল্লার লোক হিসেবে পরিচয় দেন এবং স্মরণ করিয়ে দেন যে শচীনকর্তাও একই এলাকার মানুষ। ব্রজেন বিশ্বাসকে বসতে দিয়ে ভদ্রলোক শচীনকর্তাকে খবর দেওয়ার জন্য ভেতরে গেলেন। একটু পর ফিরে এসে বললেন, ‘শচীন দেববর্মন বলেছেন, উনি আপনার সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছুক নন।’ উত্তরে ব্রজেন জানালেন, তিনি কর্তার সঙ্গে দেখা না করে কোথাও যাচ্ছেন না। ভদ্রলোক আবার ভেতরে গেলেন। এবার ফিরলেন হাতে চার আনা (এক টাকার চার ভাগের এক ভাগ) নিয়ে। বললেন, ‘এটা নিয়ে ফিরে যান। শচীন দেববর্মন আপনার সঙ্গে দেখা করবেন না।’ কিন্তু ব্রজেনের একই কথা, তিনি শচীনকর্তার সঙ্গে দেখা না করে যাবেন না। এবার ভদ্রলোক হাল ছেড়ে দিলেন। ব্রজেনকে চমকে দিয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে...বলুন। আমিই শচীন দেববর্মন।’ বিস্মিত ব্রজেন বললেন, ‘আমি তবলা বাজাই, আপনার সঙ্গে বাজাতে চাই।’ শচীনকর্তা তাঁর দিকে তবলা এগিয়ে দিলেন। তিনি বাজালেন। শচীনকর্তা শুনে বললেন, ‘ভালো...ভালো।’ সেদিন তিনটার সময় ব্রজেনকে ভারত নামা স্টুডিওতে যেতে বললেন।

রাহুল দেববর্মন

ব্রজেন সময়ের আগেই স্টুডিওতে হাজির হলেন। শচীনকর্তা তখন বেশ কিছু চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা করছেন। যেমন ‘মাটির পাহাড়’, ‘জজ সাহেবের নাতি’ প্রভৃতি। তিনি চলচ্চিত্র প্রযোজক বাবুল কুলকার্নির সঙ্গে ব্রজেনের পরিচয় করিয়ে দেন। শচীনকর্তার সঙ্গে ব্রজেনের বাজানোর সূচনা এবং একই সঙ্গে ক্যারিয়ারের সূচনা হয় সেদিন। তার পর থেকে তিনি শচীনকর্তার সঙ্গে অসংখ্য কাজ করেছেন। রাহুল দেববর্মনের সংগীত শিক্ষায় ব্রজেনের অবদান অশেষ। রাহুলের বয়স তখন ১১। শচীনকর্তা রাহুলের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত।

শচীন দেব রাহুলের সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ করলেন। তিনি জানতে চাইলেন রাহুল কোন কাজটি ভালোভাবে করতে পারেন। রাহুলের উত্তর ছিল, তিনি খুব ভালো সাইক্লিস্ট এবং তিনি সাইকেল রেসে অল্প কিছুদিন আগেই পুরস্কার পেয়েছেন। উত্তরে শচীনকর্তা রাহুলকে জানালেন, তিনি খুব ভালো টেনিস খেলেন। তুলনামূলকভাবে রাহুলের সাইকেল চালানোর চেয়ে ভালোই টেনিস খেলেন। তারপরও স্পোর্টসকে ক্যারিয়ার হিসেবে বিবেচনায় নেননি।
শচীনকর্তা আবার প্রশ্ন করলেন, ‘এখন আমাকে বলো, কোন কাজটি তুমি তুলনামূলকভাবে ভালো করতে পারো?’ রাহুলের উত্তর, ‘আমি মাউথ অর্গান বাজাতে পারি এবং নিজের করা সুর বাজাতে পারি।’
রাহুল মাউথ অর্গান বাজিয়ে শোনালেন। কর্তা শুনে বললেন, ‘তুমি কি সততার সঙ্গে বলতে পারো এসব সুর তোমার? দেখো, মৌলিক কিছু তোমাকে সৃষ্টি করতে হবে। ভালো-মন্দ যা-ই হোক, নিজের সুর বাজাও। এই মুহূর্তে সুরের মান নিয়ে চিন্তা কোরো না।’ প্রয়োজন বা ফরমায়েশ না থাকলেও প্রতিদিন একাধিক সুর সৃষ্টির জন্য তিনি রাহুলকে পরামর্শ দেন।

শহীদ মাহমুদ জঙ্গী

কর্তা তাঁকে কম্পোজার হতে হলে রিদম সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান থাকার প্রয়োজনীয়তা জানালেন এবং তবলা শেখার জন্য ব্রজেন বিশ্বাসকে মনোনীত করলেন। একই সঙ্গে ব্রজেন যে সাধারণ গুরু নন এবং ব্রজেনের কাছে শিখলে তবলাশিক্ষার গুরুত্ব রাহুল নিজেই বুঝতে পারবে বলে জানালেন। রাহুল তবলাশিক্ষার গুরুত্ব অল্প দিনেই বুঝতে পেরেছিলেন।

শচীনকর্তা থেকেই তিনি শিখেছেন

১৯৩৯ সালের ২৭ জুন, রাহুল দেববর্মন কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতা শচীন দেববর্মন, মা মীরা দেববর্মন। মীরা দেববর্মন খ্যাতিমান গীতিকার। রাহুলের ডাকনাম পঞ্চম। ছোটবেলা থেকে বাসায় অসাধারণ সব মিউজিশিয়ানের আনাগোনা ছিল। সংগীতের মধুর পরিবেশে তিনি বড় হয়েছেন। ওস্তাদ আলী আকবর খানের কাছে রাহুল সরোদ বাজানোয় তালিম নেন। অন্নপূর্ণা ছিলেন ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁর কন্যা। রবিশংকরের প্রথম স্ত্রী। বিয়ের পর একসঙ্গে তাঁরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতেন। খ্যাতির শীর্ষে থাকা অবস্থায় অন্নপূর্ণা দেবী সব ধরনের প্রকাশ্য অনুষ্ঠান থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন।

হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান তুলছেন রাহুল দেব বর্মন। তাঁর সামনে গানের খাতা হাতে বসে আছেন মোহাম্মদ রফি। আর মেঝেতে শোয়া কালো চশমা পরা লোকটি অভিনেতা দেব আনন্দ। ছবি: ফেসবুক

তবে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর থেকে প্রাপ্ত তালিম তিনি যোগ্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার মহান ব্রত নিয়ে কাজ করছিলেন। রাহুল অন্নপূর্ণা দেবীর স্নেহও পেয়েছিলেন। এভাবে রাহুল উচ্চাঙ্গসংগীতে দক্ষ হয়ে ওঠেন। শচীনকর্তার কাছ থেকে রাহুল সংগীতের বিভিন্ন বিষয় জানতে পারতেন, শিখতে পারতেন। রাহুলের উৎসাহ-উদ্দীপনার মূল কেন্দ্রেও ছিলেন কর্তা। চলচ্চিত্র ‘ফান্টুস’, ১৯৫৬ সালে মুক্তি পায়। চেতন আনন্দ পরিচালিত ছবির নায়ক ছিলেন দেব আনন্দ। ছবির সংগীত পরিচালক ছিলেন শচীনকর্তা। রাহুল দেব ‘ফান্টুস’ ছবিটি দেখতে সিনেমা হলে গিয়েছিলেন। তিনি বিস্ময়ের সঙ্গে সিনেমার একটি গান শোনেন, যেটি ১৩ বছর বয়সে তিনি সুর করেন। রাহুল সিনেমা দেখে বাসায় ফিরলে শচীনকর্তা বলেন, ‘“ফান্টুস”-এ তোমার করা সুর ব্যবহার করায় তোমার সম্মানিত বোধ করা উচিত।’

তিনি যোগ করেন, ‘“ফান্টুস” ছবির জন্য তোমার সুর পছন্দ করার অর্থ হচ্ছে, তোমার সুর একটা মানসম্মত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।’ গানটি ছিল, ‘এই মেরি টুপি পলাট গ্যায়া’। সে সময়ের হিট গান। লিখেছেন শাহির লুধিয়ানভি। সন্দেহ নেই, শচীনকর্তা এই গান ছবিতে ব্যবহার করার কারণে কিশোর বয়সের রাহুলের আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে গিয়েছিল।

গুণী সংগীতজ্ঞ শচীন দেব বর্মন ও তাঁর ছেলে রাহুল দেব বর্মন। ছবি: ফেসবুক

১৯৬১ সালে ‘ছোটে নবাব’-এর সংগীত পরিচালনা দিয়ে আর ডি বর্মনের যাত্রা শুরু। ‘তিসরি মনজিল’ ছবির সংগীত পরিচালনা রাহুলকে ব্যাপক পরিচিতি এনে দেয়। ‘তিসরি মনজিল’-এ অন্যদের মধ্যে শাম্মি কাপুর ও আশা পারেখ অভিনয় করেন এবং পরিচালনা করেন বিজয় আনন্দ। ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৬৬ সালে। ছবির গান লিখেছেন মাজরুহ সুলতানপুরি। ছবির চারটি গান ছিল দ্বৈত। গেয়েছেন মোহাম্মদ রফি ও আশা ভোসলে। দুটি মাত্র একক গান ছিল মোহাম্মদ রফির কণ্ঠে। ছবির গান হিট, সঙ্গে রাহুলও ব্যাপক হিট। ছবির গান ‘ও হাসিনা জুলফোওয়ালি জানে জাহাঁ’, ‘ও মেরে সোনা রে সোনা রে’, ‘আ জা আ জা, ম্যায় হু পেয়ার তেরা’ এখনো শ্রোতাদের মুখে মুখে ফেরে। শচীনকর্তা রাহুলের সাফল্যে ভীষণ খুশি। তিনি রাহুলকে বললেন, ‘যাও, নিজের মিউজিক করো। আমি ভিত্তি করে দিয়েছি। আমার কাজ করেছি। এখন তুমি ভালোই করছ। তোমাকে শেখানোর মতো অবশিষ্ট কিছুই আমার কাছে নেই।’ তিনি বলেছিলেন বটে, কিন্তু এরপরও প্রয়োজন মনে করলেই রাহুলকে শিখিয়েছেন। যেমন ১৯৭২ সালে শক্তি সামন্ত তৈরি করলেন চলচ্চিত্র ‘অমর প্রেম’। ছবির জন্য গান লিখেন আনন্দ বকশি। গানের সুর করছিলেন রাহুল।

ছবির তিনটি গান গেয়েছেন কিশোর কুমার ‘চিঙ্গারি কোয়ি ভরকে’, ‘কুছ তো লোগ কাহেঙ্গে’ ও ‘ইয়ে ক্যায়া হুয়া’। লতা মঙ্গেশকর গেয়েছেন দুটি গান, ‘রাহ না বিতি যায়’ ও ‘বড়া নটখট’। শচীনকর্তা গেয়েছেন একটি গান, ‘ডোলি মে বিঠায় কিকাহার’। প্রতিটি গানই সুপার-ডুপার হিট। ‘রাহ না বিতি যায়’ গানটিকে হিন্দি ছবির জগতে ক্লাসিক্যাল মিউজিকের রত্ন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে রাহুল যখন সুর করছিলেন, একটি গানের সুর নিয়ে শচীনকর্তা আপত্তি করেন। ‘বড়া নটখট’ গানটি ছিল ভজন ধরনের গান। সুর ছিল সরল। কোনো মুর্কি ছিল না। ছবির প্রযোজক শক্তি সামন্ত তা-ই চেয়েছিলেন। ছবির গল্প সম্পর্কে শচীনকর্তার ধারণা ছিল। গানের সুর শুনে তিনি বললেন, ‘এ কী করেছ পঞ্চম? একদম স্ট্রেইট। ফিলিংস কই? ছবিতে নায়িকার পেশাই শুধু বিবেচ্য নয়। ছবিতে তাঁর আরও একটি পরিচয় আছে, সে একজন মা এবং এখানে নায়িকা শর্মিলী ঠাকুর প্রথমে মা। তারপর তাঁর পেশা। সুরে এর প্রতিফলন থাকতে হবে।’ তারপর তিনি গানটির সুর ঠিকঠাক করতে শুরু করলেন।

রাহুল দেববর্মন

রাহুলের মতে, শেষ পর্যন্ত গানের ভিত্তিটা তাঁর ছিল, বাকি সব শচীনকর্তার। রাহুলের ভাষ্য অনুযায়ী, কর্তা থেকেই তিনি শিখেছেন, সিনেমার গানের ভালো সুর করতে হলে শুধু সিকোয়েন্স নয়, চরিত্রের ভেতর ঢুকতে হয়। ছবির পাণ্ডুলিপি পড়তে হয়। চরিত্রকে অনুভব করতে হয়। তবেই ভালো গান তৈরি করা সম্ভব।