আশির দশকে ‘সুপার রুনা’ অ্যালবামের কাজের সূত্রে রুনা লায়লার সঙ্গে বাপ্পি লাহিড়ীর পরিচয়। সেই থেকে তাঁদের সম্পর্ক। পেশার কারণে সম্পর্কের শুরু হলেও, একটা সময় তা পারিবারিক সম্পর্কে রূপ নেয়। রুনা লায়লার মেয়ের সঙ্গেও বাপ্পি লাহিড়ীর মেয়ের দারুণ বন্ধুত্ব। রুনা-বাপ্পির সেই বন্ধুত্ব চার দশকের। সেই বন্ধুর হঠাৎ প্রয়াণে মর্মাহত উপমহাদেশের প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী রুনা লায়লা।
মর্মাহত রুনা লায়লা বলেন, ‘অসাধারণ প্রতিভাবান সুরকার ও সংগীতশিল্পী বাপ্পি লাহিড়ীর মৃত্যুর খবর শুনে আমি ভীষণ মর্মাহত ও দুঃখিত। তাঁর সঙ্গে আমার বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রের গান এবং গানের অ্যালবামে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছে, যার মধ্যে একটি ছিল সুপার হিট অ্যালবাম “সুপার রুনা”। আমরা দুজন একসঙ্গে পৃথিবীর বিভিন্ন মঞ্চে গান গেয়েছি। সবকিছুর ওপরে তিনি ছিলেন আমার বন্ধু। ভীষণ মজার একজন প্রিয় মানুষ। এমন একজন প্রতিভাবানকে বিদায় জানানো কঠিন, তিনি নিজেকে আরও উঁচুতে নিয়ে যেতে পারতেন। গত কয়েক দিনে আমি লতা দিদি, সন্ধ্যা মুখার্জি দিদি এবং এখন বাপ্পিজিকে বিদায় জানিয়েছি। তাঁদের হারানোর শোক প্রকাশের ভাষা নেই আমার। আমি পুরোপুরি স্তব্ধ ও বিষাদগ্রস্ত।’
বাপ্পি লাহিড়ীর সঙ্গে ‘সুপার রুনা’ অ্যালবামে কাজ করা প্রসঙ্গে রুনা লায়লা বলেন, ‘১৯৮২ সালে এই পপ অ্যালবামটির রেকর্ডিং হয় লন্ডনের অ্যাবি রোড স্টুডিওতে। একসময়ের বিখ্যাত ব্যান্ড বিটলসের সদস্যরা সেখানেই তাঁদের গান রেকর্ড করতেন। বাপ্পিজির সঙ্গে সেই স্টুডিওতে রেকর্ডিংয়ের স্মৃতি চিরকাল মনে পড়বে। “সুপার রুনা” অ্যালবামটি প্রকাশের দিনেই এর ১ লাখ কপি বিক্রি হয়েছিল। এ জন্য প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ইএমআই মিউজিক আমাকে উপহার হিসেবে গোল্ডেন ডিস্ক অ্যাওয়ার্ড দিয়েছিল।’
‘সুপার রুনা’ কাজের স্মৃতি রোমন্থন করে রুনা লায়লা আরও বলেন, ‘১৯৭৯ সালে প্রকাশ কাপুর পরিচালিত বলিউডের “জান-এ-বাহার” ছবিতে বাপ্পিজির সুর-সংগীতে একটি গান গেয়েছিলাম। এর শিরোনাম ছিল “মার গায়ো রে রসগোল্লা খিলাই কে মার গায়ো রে”। এতে মোহাম্মদ রফি সাহেব ও আনন্দ কুমারও কণ্ঠ দেন। গওহর কানপুরির লেখা গানটি বেশ আলোচিত হয়েছিল।’
এর ঠিক ৫ বছরের মাথায় ১৯৮৪ সালে বাপ্পি লাহিড়ীর সুর-সংগীতে আরেকটি হিন্দি গান গেয়েছেন রুনা লায়লা। সেই প্রসঙ্গে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘দাসারি নারায়ণ রাও পরিচালিত “ইয়াদগার” ছবিতে ইন্দিবারের লেখা ও বাপ্পিজির সুরে “অ্যায় দিলওয়ালে আও” গানটি গেয়েছিলাম। এতে অভিনয় করেন কমল হাসান ও পুনম ধিলন। এটা আমার পছন্দের একটা গান।’
২০১৮ সালের ১৭ নভেম্বর কলকাতায় নিরিবিলিভাবে জন্মদিন উদ্যাপন করতে চেয়েছিলেন রুনা লায়লা। তাই জন্মদিনের আগেই কলকাতায় যান আলমগীর ও রুনা লায়লা। চাইলেই কি মহাতারকার জন্মদিন এভাবে পালন করা যায়! রুনা লায়লার ক্ষেত্রে তা মোটেও সম্ভব হয়নি। কলকাতার যে হোটেলে রুনা লায়লা উঠেছিলেন, সেই হোটেলেই স্ত্রীসহ ওঠেন ভারতের জনপ্রিয় গায়ক ও সংগীত পরিচালক বাপ্পি লাহিড়ী। একই হোটেলে রুনা লায়লার থাকার খবর জানতে পেরে ফোনে কথা বলেন বাপ্পি লাহিড়ী। তারপর দুজন দেখা করেন। ফুল আর কেক নিয়ে হোটেলে রুনার কক্ষে হাজির হন বাপ্পি লাহিড়ী। সেই স্মৃতি মনে করে রুনা লায়লা বলেন, ‘সেবার জন্মদিন কাটাতে আলমগীর সাহেবকে (নায়ক আলমগীর) নিয়ে কলকাতায় গিয়েছিলাম। আমরা উঠেছিলাম গ্র্যান্ড ওবেরয় হোটেলে। তখন একই হোটেলে সস্ত্রীক ছিলেন বাপ্পিজি। আমি আছি জেনে তিনি প্রথমে ফোনে শুভেচ্ছা জানান। তারপর ফুল ও কেক নিয়ে আমাদের রুমে আসেন স্ত্রীসহ। চারজন মিলে কেক কেটেছি। জন্মদিনে তাঁকে এভাবে পেয়ে যাব, ভাবিনি। ঘটনাটা ছিল আমার জন্য চমক। কেক কাটার পর আমরা আড্ডা দিয়েছি। “সুপান রুনা”র রেকর্ডিং নিয়ে স্মৃতিচারণা করেছিলাম। সেটাই ছিল আমাদের শেষ দেখা।’
ভারতীয় গায়ক, সুরকার ও সংগীত পরিচালক বাপ্পি লাহিড়ী। গতকাল মঙ্গলবার মধ্যরাতে মুম্বাইয়ের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৯ বছর। এনডিটিভির প্রতিবেদনে এসব খবর জানানো হয়েছে। মুম্বাইয়ের ক্রিটিকেয়ার হাসপাতালের পরিচালক দীপক নামজোশি ভারতীয় বার্তা সংস্থা পিটিআইকে বলেন, এক মাস ধরে এই হাসপাতালেই ভর্তি ছিলেন বাপ্পি লাহিড়ী। গত সোমবার হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে তিনি বাড়িতে ফেরেন। পরদিন মঙ্গলবার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে একজন চিকিৎসক বাড়িতে ডেকে নেওয়া হয়। গতকাল মধ্যরাতের কিছু আগে অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়ারের (ওএসএ) এর কারণে মারা যান বাপ্পি লাহিড়ী।