দিলীপকুমার রায়, ব্যক্তিপরিচয়ে বাংলার অগ্রণী নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ছেলে। শিল্পী পরিচয়ে বাংলা গানের অন্যতম পথিকৃৎ, অগ্রণী লেখক আর সাধনপরিচয়ে ঋষি অরবিন্দের শিষ্য। বাংলা গান গাওয়ার ঘরানায় তিনি এক নতুন ঘরানার পথিকৃৎ। কেমব্রিজ, বার্লিন থেকে শিখেছেন গান গাওয়ার রীতি-রেওয়াজ। বাংলা গানে কীভাবে সেই নতুন উদ্যম কাজে লাগানো যায়, তার পরীক্ষাও নিজের গানে করেছেন তিনি। তিনি সেই সময়ে কলকাতায় পাবলিক কনসার্ট করছেন। তখনো টিকিট কেটে গান শোনার চল ছিল না বাংলায়। দিলীপকুমারকে তাই অনেকে বাংলা সুরদ্বীপ যাত্রার কলম্বাসও বলতেন। ১৮৯৭ সালের ২২ জানুয়ারি কলকাতায় জন্ম। আজ তাঁর ১২৫তম জন্মবার্ষিকী। জন্মদিনের সূত্রে তাঁকে স্মরণ করেছেন বাংলাদেশের সংগীতজগতের পরিচিত মুখ, অনেক জনপ্রিয় গানের গীতিকার শহীদ মাহমুদ জঙ্গী।
সাহানা দেবীর জন্ম ১৮৯৭। আর উমা বসুর (হাসি) জন্ম ১৯২১। দুজনেই সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান ছিলেন। গানের জগতে তাঁদের আগমন বাংলা গানকে সমৃদ্ধ করেছিল। রবীন্দ্রনাথ সাহানা দেবীকে গায়িকা হিসেবে প্রথম দু-একজনের মধ্যেই গণ্য করতেন। নিজের গানের জন্য সাহানা দেবীকে আদর্শ মনে করতেন। ১৯৩৮ সালের ৪ আগস্ট সাহানা দেবীকে লেখা চিঠিতে তাঁর এই মনোভাবের কথা তিনি অকপটে বলেছেন। রবীন্দ্রনাথ পছন্দ করতেন উমা বসুর (হাসি) কণ্ঠ। দিলীপকুমারকে লেখা চিঠিতে তিনি হাসির প্রশংসা করেছেন।
এই দুজনেই ভিন্ন ভিন্ন সময়ে দিলীপকুমারের সঙ্গে পরিচিত হন। দিলীপকুমারের গান, গায়কি, গানের ওপর পাণ্ডিত্য, প্রাণবন্ত ব্যক্তিত্ব—সবকিছু তাঁদের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। তাঁরা দিলীপকুমারের ভক্তে পরিণত হন। দিলীপকুমারের গান কণ্ঠে তুলে নেন। একসময় তো সাহানা দেবী দিলীপ কুমারের সঙ্গে একই দিনে শ্রী অরবিন্দের আশ্রমে যোগ দেন। আর উমা বসু দিলীপকুমারের কন্যাসম প্রিয় ছাত্রীতে পরিণত হন। রবীন্দ্রনাথ অনুযোগ করে বলেছিলেন, ‘দেশের যত ভালো ভালো মেয়ে আছে, তুমি যদি তাদের এমন ভাঙিয়ে নিয়ে যাও, তাহলে আমার কি অবস্থা দাঁড়ায় বলো তো?’
সেই সময়ে কনসার্ট! টাকার বিনিময়ে! চিন্তা করা যায়? এই অসাধ্যসাধন করেছিলেন দিলীপকুমার রায়। তিনি তখন পন্ডিচেরিতে অরবিন্দের আশ্রমে আশ্রয় নিয়েছেন। আশ্রমের জন্য কনসার্ট করে তিনি টাকা সংগ্রহ করতেন। যে কজন ভারতীয় বাংলা সংগীত, তথা সেই সময়ের ভারতীয় সংগীতকে বিদেশের মাটিতে পরিচিত করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে দিলীপকুমার রায়ের নাম প্রথম দিকেই উচ্চারিত হয়। দিলীপকুমারের বাবা প্রখ্যাত কবি, গীতিকার, সুরস্রষ্টা, গায়ক, নাট্যকার, লেখক ডি এল রায় আর মা সুরবালা দেবী। কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে গণিতে পড়াশোনা শেষে ১৯১৯ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান। গণিত, রসায়ন ও সংস্কৃতিতে তাঁর উৎসাহ থাকলেও, দিন শেষে বাবার পথেই তিনি ফিরে আসেন।
কেমব্রিজে থাকাকালে দিলীপকুমার দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল, ফ্রান্সের লেখক রোমা রল্যাঁ, হারমেন হেসের সান্নিধ্যে আসেন এবং ইউরোপীয় মিউজিকের ঐতিহ্য বোঝার চেষ্টা করেন। কেমব্রিজে গণিতের পাশাপাশি ওয়েস্টার্ন মিউজিকের ওপর অধ্যয়ন করেন। এরপর জার্মান ও ইতালিয়ান মিউজিকের ওপর পড়াশোনার জন্য তিনি বার্লিনে যান। ১৯২২ সালে দেশে ফিরে বিভিন্ন ওস্তাদের কাছে তিনি উচ্চাঙ্গসংগীতে তালিম নেন।
যাঁদের মধ্যে ছিলেন ওস্তাদ আবদুল করিম খান, ওস্তাদ ফৈয়াজ খান, পণ্ডিত বিষ্ণু নারায়ণ ভাতখন্ডে। তারপর বাংলা গানের শিকড়ের সন্ধান। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। এমনকি বাইজিরা কী ধরনের গান করেন, তা শোনার জন্য বাইজির ঘরেও গেলেন। দিলীপকুমার সুর সংগ্রহ করতে লাগলেন। স্বরলিপি তৈরি করলেন। নিখুঁত এবং এত বেশি গানের স্বরলিপি ভারতে আর কেউ রেখে যাননি। ডি এল রায় ও অতুলপ্রসাদের বেশির ভাগ গানের স্বরলিপিও দিলীপকুমার রায় করেছেন। গানের ওপর নিরন্তর গবেষণা করে তিনি গানের নিজস্ব এক ধারা তৈরি করেন, যাকে ‘দৈলীপি ঢং’ বলা হতো। বিখ্যাত ওস্তাদ বা গায়ক হবেন, এই ইচ্ছা দিলীপকুমারের মধ্যে ছিল না। তিনি মিড়, গমক, তান ইত্যাদি এনে বাংলা গানকে কীভাবে সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ করা যায়, সেই চেষ্টায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। গোবিন্দ গোপাল মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘দিলীপকুমারের গানে সব সময় লক্ষ করা যায়, রূপ পেতে চায় ভাবের মাঝারে অঙ্গ আবার ভাব পেতে চায় রূপের মাঝারে ছাড়া’, এক হিসাবে যা বাংলা গানমাত্রেরই মূল কথা, প্রাণের মন্ত্র। কিন্তু দিলীপকুমার চেয়েছেন, রূপের মধ্যে অলংকরণ ঐশ্বর্য আর ভাবের মধ্যে ফোটাতে চেয়েছেন আন্তরিকতার মাধুর্য। এইখানে তিনি ব্যতিক্রমী। অন্যান্য বাংলা গীতিকার-সুরকার থেকে আলাদা। গানের মূল জিনিস ছিল তাঁর কাছে ভাব বা অনুভূতি, যা তাঁর প্রাণ, হৃদয় থেকে উৎসারিত। পিতা দ্বিজেন্দ্রলালের কাছ থেকেই এই ভাব, প্রাণের দীক্ষা তিনি লাভ করেছিলেন।
নিজের একটি সুরকে কতটা বাড়ানো যায়, একই কলির ভেতর থেকে কত রকমের সুরের সম্ভাবনার হদিস নেওয়া যায়, কত রকম করে সুর ও গায়কির পথে নিজের ভাবনা ও ভাবগুলিকে প্রকাশ করা যায়, তারই একটি চ্যালেঞ্জ তিনি যেন নিজের দিকেই ছুড়ে দিতেন সমানে। চকিতে মোকাবিলা করতেন সেই চ্যালেঞ্জের। ফলে দিলীপকুমারের সুরগুলি একদিকে যেমন এক-একটি নির্মাণ, অন্যদিকে তেমন এক-একটি সম্ভাবনার খনি। এটিও তাঁর সুর রচনাশৈলীর একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য।’ দিলীপকুমারের জন্ম ১৮৯৭ সালের ২২ জানুয়ারি। মাতা সুরবালা দেহত্যাগ করেন, যখন দিলীপকুমারের বয়স ৬। আর পিতা দ্বিজেন্দ্রলাল দেহত্যাগ করেন, তখন তাঁর বয়স ১৬। ডাকনাম ছিল মন্টু। প্রাণোচ্ছল স্বভাবের জন্য কাছের মানুষ মন্টুদা বলতেই পাগল ছিলেন। ভীষণ জনপ্রিয় মানুষ। মজা করতে ভালোবাসতেন। তাঁর কৌতুকপ্রিয়তা নিয়ে সেই সময়ের প্রখ্যাত অভিনেত্রী লীলা বলেছেন, ‘কত রকম মজাই না করতেন মন্টুদা। একদিন তাঁর গান শুনতে গিয়েছি, একটু পরেই সুভাষচন্দ্র এলেন। আমি তো সন্ত্রস্ত তাঁকে দেখে, সসম্ভ্রম দূরে সরে বসেছি, কিন্তু মন্টুদা বললেন, তুমি ওর পাশে বসো, গল্প করো ওর সঙ্গে। মন্টুদা ভালো করেই জানতেন, বন্ধুটি তাঁর রাশভারী লোক এবং চিরকুমার দেশব্রতী, তিনি নারী সঙ্গ থেকে দূরে থাকাই পছন্দ করেন।
বন্ধুকে বিব্রত করার জন্যই জোর করে আমাকে তাঁর পাশে বসিয়ে ছাড়লেন, যে কিনা সিনেমার তখন এক নামজাদা নায়িকা। তাঁরও যেমন অস্বস্তি, আমার তেমনি অস্বস্তি বোধ হচ্ছে ঐভাবে তাঁর পাশে বসে থাকতে। কিন্তু মন্টুদা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই, বসে কেবল মজা দেখছেন।’
দ্বিজেন্দ্রলাল কয়েকটি ছত্রে গানের প্রাণভোমরার কথা ব্যক্ত করে দিয়েছেন অনবদ্য ভঙ্গিতে: ‘হোক না শুদ্ধ ভাবের ভঙ্গি হোক না শুদ্ধ তান ও লয় গানের সঙ্গে নেইকো প্রাণ যার তাহার সে-গান গানই নয়।’ সংগীত সমালোচক ও বন্ধু ধূর্জটি প্রসাদকে লক্ষ্য করে একবার দিলীপকুমার বলেছিলেন, ‘আমি আমার অনুভবকেই প্রকাশ করি গানে। সুরের ফুলঝুরি ফোটানো বা তালের কসরত দেখানো আমার লক্ষ্য নয়।’
দ্বিজেন্দ্রলালের গানের স্বরলিপি দিলীপকুমার প্রকাশ করেন। তার ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, ‘স্বরলিপি দেখে গান শিক্ষা সম্বন্ধে আমার একটা কথা বলবার আছে। সেটা এই যে কোন গানের মধ্যে রস সঞ্চার কর্ত্তে হলে শুষ্ক হুবহু অনুকরণে হয় না। কোন গানকে প্রাণে মূর্ত করে তুলতে হলে তাকে নিজের সৌন্দর্য-অনুভূতি অনুসারে একটু-আধটু বদলে নিতেই হয়।’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘গানকে নকল করার চেষ্টার মতন বিড়ম্বনা আর্টে অল্পই আছে।’ রবীন্দ্রনাথের গানে স্বরলিপির কঠিন মান্যতার মধ্যে থাকতে হয় বলে দিলীপকুমার রবীন্দ্রসংগীত গাইতে উৎসাহী ছিলেন না। একবার দিলীপকুমার ‘হে ক্ষণিকের অতিথি’ গানটি একটু অন্যভাবে গেয়ে রবীন্দ্রনাথকে শোনালে রবীন্দ্রনাথ সামনাসামনি প্রশংসাই করেন। কিন্তু রেকর্ড কোম্পানি গানটি রেকর্ড করতে চাইলে তিনি সম্মতি দেননি। কবির সুমন তাঁর লেখা প্রবন্ধ ‘দিলীপকুমার রায়ের সুরকাঠামো ও গায়কি’তে লিখেছেন, ‘দিলীপকুমারের সুরগুলি নিয়ে আলোচনা করার সময়ে তাঁর গাওয়ার ভঙ্গি একদম এড়িয়ে যাওয়া খুবই কঠিন কাজ। সুখের বিষয়, কিছু গানের স্বরলিপি আমি পড়ার সুযোগ পেয়েছি। স্বরলিপি থেকে সুরের কাঠামোটা বুঝে নেওয়া যায়। যদিও নিজে গানগুলি গাইতে গিয়ে দিলীপকুমার থেকে থেকেই সুরবিহারের পথ ধরতেন, স্বরলিপিতে নেই এমন স্বর ও সুরের টুকরো জুড়ে দিতেন। সন্ধানে সতত অস্থির এই শিল্পীকে বাঁধা ছকে বিচার করা দুঃসাধ্য। নিজের ছক তিনি নিজেই ভেঙেছেন, গড়েছেন বারবার। আখর জুড়ে দিয়েছেন। কথার টুকরো নিয়ে খেলায় মেতেছেন। গাওয়ার অপার ক্ষমতা ছিল। তাঁর অত প্রবল ক্ষমতাও সৃজনশীলতাকে আসরে গাইতে বসে বেঁধে রাখা দুষ্কর। তিনি বোধ হয় তা চাইতেনও না।
দিলীপকুমার নিজেকে কোনো নিয়মে বেঁধে রাখতেন না, সে সংগীতে হোক কিংবা সংগীতের বাইরে ব্যক্তিজীবন। আনন্দ-উল্লাসে ভরপুর থাকতে ভালোবাসতেন। তিনি বিভিন্ন লেখায় অতুলপ্রসাদ ও নজরুলের আসর-কাঁপানো হাসির কথা লিখেছেন। তাঁদের প্রাণশক্তির কথা লিখেছেন। নিজের বাবা ডি এল রায়ের দিলখোলা হাসি ও সেন্স অব হিউমারেরও ভক্ত ছিলেন তিনি। নজরুল সম্পর্কে লিখেছেন, ‘মনে পড়ে তাঁর দিলদরিয়া প্রাণের কথা। এমন প্রাণ নিয়ে খুব কম মানুষই জন্মায়। মজলিশি সভাসদ, হাসি-গল্পের নায়ক, ভাবালু গায়ক, বলিষ্ঠ আবৃত্তিকার, বিশিষ্ট সুরকার, গুণীর গুণগ্রাহী, উদার-সরল মানুষ যে রেখে-ঢেকে কথা কইতে জানত না, যখনই আমাদের সভায় আসরে আসত ছুটে, হেঁটে নয়—অট্টহাস্যে ঝাঁকড়া চুল দুলিয়ে, এসেই জড়িয়ে ধরত দিলীপদা বলে—এমন মানুষ কটাই-বা জীবনে দেখেছি?’ আসলে নজরুল সম্পর্কে দিলীপকুমার যা বলেছেন, তার প্রায় সবই তাঁর মধ্যেও ছিল। ডি এল রায়ের মতো সেন্স অব হিউমারও ছিল, ছিল অতুলপ্রসাদের মতো গতি। এই সব পেছনে ফেলে, তুমুল জনপ্রিয়তাকে তুচ্ছে করে, গুণমুগ্ধ ভক্তদের হতাশ করে ১৯২৮ সালে স্থায়ীভাবে থাকার জন্য পন্ডিচেরিতে শ্রী অরবিন্দের আশ্রমে চলে গেলেন। অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছেন, ‘এমন একজন সংগীতসাধক, তথা সাহিত্যরসিক বাংলাদেশ ছেড়ে পন্ডিচেরি চলে গিয়ে আশ্রমবাস করছেন, এটা বাংলাদেশের পক্ষে দুর্ভাগ্য।’ পন্ডিচেরিতে আশ্রমে যাওয়ার আগে দিলীপকুমার দুটি গান রেকর্ড করে যান। তার মধ্যে একটি ছিল দ্বিজেন্দ্রলালের গান, ‘ছিল বসে সে কুসুম কাননে’, অন্যটি ছিল, ‘রাঙাজবা কে দিল তোর পায়ে’। ‘রাঙাজবা কে দিল তোর পায়ে’ গানটি লিখেছেন গিরীশ ঘোষ। সুর করেছেন দিলীপকুমার। দিলীপকুমারের এই দুটি গানের রেকর্ড বিপুল পরিমাণে বিক্রি হয়। মানুষের মুখে মুখে ছিল দিলীপকুমারের গান। তবে সুখের বিষয়, দিলীপকুমার আশ্রমেও গান বন্ধ করেননি। পন্ডিচেরি থেকে দীর্ঘদিন পর যখন কলকাতায় আসেন, তখন গ্রামোফোন কোম্পানি তাঁকে গান রেকর্ড করার জন্য অনুরোধ করে। তিনি নিজে লিখতেন, তাঁর বাবার গানও ছিল, কিন্তু গাইলেন নিশিকান্তের লেখা ‘এই পৃথিবীর পথের পরে’ এবং ‘জ্বলবার মন্ত্র দিলে মোরে’ গান দুটি। রেকর্ড প্রকাশের পর গান জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। নিশিকান্ত চৌধুরীর লেখা বেশ কিছু গানের সুর করেছেন, গেয়েছেন। এই সব গানের সুবাদে নিশিকান্ত গীতিকার হিসেবে বিখ্যাত হয়ে যান। শুধু অন্যের লেখা গানে সুর করেছেন তা নয়, নিজের লেখা গানও অন্যকে দিয়ে সুর করিয়েছেন।
যেমন ‘তব চিরচরণে দাও শরণাগতি’, এই গান লিখেছেন দিলীপকুমার রায়, ১৯৪৪ সালে গেয়েছেন দিলীপকুমার রায় ও মঞ্জু গুপ্তা। গানের সুর করেছেন হিমাংশু দত্ত। সুর করতে গিয়ে একই গানে তালফেরতায়, কখনো সুরের মেজাজে পরিবর্তন এনে দিলীপকুমার গানকে নিয়ে গেছেন অন্যমাত্রায়। যেমন গানের সঞ্চারিতে পরপর দুই তালের ব্যবহার, যা বাংলা আধুনিক গানে খুব সম্ভবত তিনিই প্রথম প্রয়োগ করেছেন।‘যদি দিয়েছ বঁধুয়া’র কম্পোজিশনে উনি এই সফল পরীক্ষা করেছিলেন। ডি এল রায়ের নাটকের গান ‘আজ এসেছি এসেছি বঁধু হে’-এর সুরের সঙ্গে যায়, এমনভাবেই গানের কথা লিখেছিলেন লালগোলার মহারাজা ধীরেন্দ্র নারায়ণ রায়। সেই কথার ওপরই সুর করেছেন দিলীপকুমার রায়। ডি এল রায়ের কম্পোজিশনের স্টাইলকে ছেলে দিলীপকুমার রায় মাঝেমধ্যে অপরূপ দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করতেন। এই গানে তার কিছুটা প্রয়োগ আমরা দেখতে পাই।
‘যদি দিয়েছ বঁধুয়া’ গানটির কথা উল্লেখ করে কবির সুমন লিখেছেন: তালফেরতা কীর্তনের একটি অন্যতম কাঠামোগত বৈশিষ্ট্য। এটাকে আরও স্পষ্ট করে দেখাতেই যেন দিলীপকুমার রায় স্থায়ীও অন্তরার চার মাত্রা থেকে সঞ্চারিতে প্রথমে তিন মাত্রায় এসে সেই সঞ্চারিই আরেকবার রচনা করেছেন সাত মাত্রায়। এ এক অনবদ্য অভিজ্ঞতা। প্রচলিত কীর্তনকে সুর বা সুরগত আবহ পরিহার করেও তাল-ছন্দের নকশায় কীর্তন আঙ্গিকের একটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে কাজে লাগিয়ে দিলীপকুমার আধুনিক রচনাশৈলীর একটি নতুন পাঠ দিল যেন। আধুনিক গানের সুরের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বহুধারায় অবাধে বিচরণ করে, শ্রেষ্ঠটুকু বেছে নেওয়া বা শ্রেষ্ঠদের সমন্বিত উপস্থাপন। দিলীপকুমারের সুরে উদারতার ব্যাপক উপস্থিতি আমরা দেখতে পাই। কোনো গানের সুরে উচ্চাঙ্গসংগীতের সঙ্গে কীর্তনের চমৎকার মিশ্রণ যেমন করেছেন, তেমনই গানের সুরে পাশ্চাত্যে সংগীতের ব্যবহারও করেছেন দক্ষতার সঙ্গে। এই প্রসঙ্গে তাঁর বিপুল জনপ্রিয় গান ‘সেই বৃন্দাবনে লীলা অভিরাম’-এর কথা উল্লেখ করা যায়। ‘আলোছায়া আঁকা পাখি’-এর কথা লিখেছেন নিশিকান্ত। গানের স্থায়ী মাত্র দুই লাইনের। তারপর তিনটি স্তবক। প্রতিটি স্তবক পাঁচ লাইনের। আধুনিক বাংলা গানে এই ধরনের পঙ্ক্তিভাগ বড় একটা দেখা যায় না। এই গানের সুর দিলীপকুমারের পাণ্ডিত্যের নিদর্শন হয়ে আছে। দিলীপকুমার যেখানে যেতেন, সেখানেই যেন উৎসব শুরু হতো। তাঁকে ঘিরে ভক্তদের উচ্ছ্বাস যেন কিছুতেই শেষ হতে চাইত না। ১৯৩৭ সালে দীর্ঘ ৯ বছর পর তিনি পন্ডিচেরির আশ্রম থেকে কলকাতায় আসেন। তাঁর মধ্যে আশ্রমে থাকার কারণে কোনো পরিবর্তন হয়েছে, এমনটি কারও মনে হলো না।
সেই আগের মতো উদ্দাম, প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরপুর দিলীপকুমার। কলকাতায় উঠেছিলেন তাঁর মেজো মামার বাসায়। যিনি তকু মামা নামে পরিচিত ছিলেন। সকাল থেকে বিভিন্ন ধরনের মানুষের আনাগোনায় বাড়ি সরগরম। শিল্পী, লেখক, বাদক, সাহিত্যিক, সমালোচক, সাংবাদিক থেকে শুরু করে আধ্যাত্মিক জগতের মানুষ, কেউ বাদ নেই। গানবাজনা, গল্প-আড্ডায় মেতে আছেন দিলীপকুমার। সেই সময়ের হাসির গানের জনপ্রিয় গায়ক নলিনীকান্ত সরকার এসব দেখে একদিন তকু মামাকে বললেন, শ্রী অরবিন্দর ওপর তাঁর প্রগাঢ় শ্রদ্ধা ছিল, এখন তার আর কোনো অবশিষ্ট নেই। কারণ, দিলীপকুমার ৯ বছর আশ্রমে ছিলেন, কিন্তু তাঁর সামান্য পরিবর্তনও হয়নি। সেই হইচই। সেই আড্ডা, সেই নিয়মছাড়া জীবন। তকু মামা উত্তরে বলেছিলেন, তাঁর ঠিক উল্টো প্রতিক্রিয়া হয়েছে। আগে শ্রী অরবিন্দের প্রতি তাঁর কোনো শ্রদ্ধা বা ভক্তি ছিল না। কিন্তু মন্টুকে দেখে এখন শ্রী অরবিন্দের প্রতি তাঁর অপরিসীম শ্রদ্ধা জন্ম নিয়েছে। তাঁর মতে, মন্টুকে এতগুলো বছর যিনি আশ্রমে আটকে রাখতে পারেন, নিশ্চয় তাঁর অলৌকিক কোনো শক্তি আছে। গান্ধীজি দিলীপকুমারের গান শুনেছিলেন। দিলীপকুমার নিজের থেকে শোনাতে যাননি। গান্ধীজি তাঁকে ডেকে নিয়েছিলেন গান শোনার জন্য। কার্তিকেয় চন্দ্রের নাতি, দ্বিজেন্দ্রলালের পুত্র উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত প্রচুর সম্পত্তি আগেই বিক্রি করে আশ্রমে দান করেন। শ্রী অরবিন্দের আশ্রমে ছিলেন। শ্রী অরবিন্দ মারা যাওয়ার পর আশ্রম ছেড়ে চলে আসেন। এরপর তিনি শ্রী অরবিন্দের যোগধর্মও ছেড়ে দেন। নিজেকে ট্র্যাডিশনাল বৈষ্ণব হিসেবে দাবি করেন। দিলীপকুমার নিজের সম্পর্কে বলতেন, ‘স্বভাবে আমি ঝোঁকালো মানুষ।’
কোনো বিষয় বা কাউকে পছন্দ হলে তিনি তার জন্য মনপ্রাণ সঁপে দিতেন। শ্রী অরবিন্দের জন্য তা-ই করেছিলেন। পারিবারিক সূত্রে প্রচুর সম্পত্তির অধিকারী ছিলেন। প্রাচুর্যের মধ্যে বড় হয়েছেন, কিন্তু সবই তো বিলিয়ে দিয়েছেন। স্বাধীনচেতা দিলীপকুমারের চাকরি করার ধৈর্য ছিল না। ব্যবসায়ের কথা চিন্তাও করতেন না। শেষ বয়সে পুনেতে ইন্দিরা দেবীর হরেকৃষ্ণ মন্দিরে স্থান হয়। দিলীপকুমারের আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে অবগত অন্নদাশঙ্কর লিখেছেন, ‘আমার মনে হয়, তাঁর সামনে দুটি মাত্র বিকল্প ছিল। একটি হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে শান্তিনিকেতনে আশ্রমিক হওয়া, অপরটি শ্রী অরবিন্দের কাছে গিয়ে পন্ডিচেরিতে থাকা। গ্রেটদের প্রতি তাঁর একটা আকর্ষণ ছিল। আর আশ্রম ছাড়া তাঁকে আশ্রয় দেবে কে? শেষ বয়সেও তাঁকে আশ্রয় নিতে হলো ইন্দিরা দেবীর হরেকৃষ্ণমন্দির নামক আশ্রমে। তত দিনে তিনি নিজেই তাঁর ভক্তদের কাছে গ্রেট হয়েছিলেন।’ ১৯৮০ সালের ৬ জানুয়ারি তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। অন্নদাশঙ্কর লিখেছেন, ‘দিলীপদা মানুষটির মূল্যায়ন করা আমার সাধ্য নয়। এই পর্যন্ত বলতে পারি, তিনি ছিলেন অনন্য। তাঁর মতো দ্বিতীয়টি দেখেনি।’ তথ্যসূত্র: অন্নদাশঙ্কর রায়ের ‘দিলীপকুমার জন্মশতবর্ষ’, কবির সুমনের ‘দিলীপকুমারের সুরকাঠামো ও গায়কি’, গোবিন্দ গোপাল মুখোপাধ্যায়ের ‘দিলীপকুমার গানে, প্রাণে ও প্রেমে’, চৈতালী বিশ্বাসের ‘জ্বলবার মন্ত্র দিলে মোরে’ ও আনন্দবাজার পত্রিকা।