শূন্যতার এক বছর

এন্ড্রু কিশোর প্লেব্যাকে অপরিহার্য এক শিল্পী। যেকোনো ধরনের গান গাওয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল তাঁর। রোমান্টিক, মেলোডিয়াস, বিরহী, ফোক, চটুল—সব ধরনের গানেই ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। সব ফেলে ২০২০ সালের ৬ জুলাই চলে গেলেন না–ফেরার দেশে

এন্ড্রু কিশোর
এন্ড্রু কিশোর

২০১৯ সালের মে মাসের কোনো এক দিন সিআরপিতে গেছি বরেণ্য সুরকার আলাউদ্দিন আলীকে দেখতে। তিনি তখন সেখানে চিকিৎসাধীন। কাকতালীয়ভাবে একই সময়ে এন্ড্রু কিশোরও হাজির। সেই দিনই শেষ দেখা। ঠিক ৯ মাস পর ফেব্রুয়ারিতে দাদার সঙ্গে শেষ কথা। তিনি তখন সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন। সেখান থেকেই এক সকালে হোয়াটসঅ্যাপে কল করেন, 'বাবু কেমন আছিস।' দাদার কণ্ঠ অস্পষ্ট, মৃদু।
আর দেখা হয়নি, কথাও হয়নি। এর মধ্যে দেশে ফিরেছেন। নীরবে চলে গেছেন রাজশাহী। তারপর ২০২০ সালের ৬ জুলাই চলে গেলেন না–ফেরার দেশে। ৯ মাস যুদ্ধ করে শেষে স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করেছিলেন, মৃত্যুটা যেন দেশেই হয়। স্রষ্টা তাঁর প্রার্থনা শুনেছেন। এক বছর আগে এই দিনে রাজশাহীতে শেষ হয় তাঁর 'জীবনের গল্প'। বেশি সময় যে পাবেন না, জানতেন বলেই মৃত্যুর কিছুদিন আগেই বন্ধু হানিফ সংকেতকে ফোনে বলেছিলেন, 'দোস্ত আমার দিন শেষ। আই অ্যাম রেডি টু গো।'

গানে গানে জানিয়ে গিয়েছিলেন 'ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে, রইব না আর বেশি দিন তোদের মাঝারে।' মহামারির কারণে তাঁর কাছের মানুষ, শুভানুধ্যায়ী অনেকেই শেষকৃত্যে অংশগ্রহণ নিতে পারেননি। তাঁকে যোগ্য সম্মানটা আমরা জানাতে পারিনি। সেই গ্লানিবোধ আমাদের অনেকেরই আছে।

হাসপাতালে এন্ড্রু কিশোর। ছবি: সংগৃহীত

এন্ড্রু কিশোর প্লেব্যাকে অপরিহার্য এক শিল্পী। যেকোনো ধরনের গান গাওয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল তাঁর। রোমান্টিক, মেলোডিয়াস, বিরহী, ফোক, চটুল—সব ধরনের গানেই ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। পর্দায় যেকোনো নায়কের ঠোঁটেই তাঁর গান মানিয়ে যেত। সেকালের রাজ্জাক, জাফর ইকবাল থেকে একালের সালমান শাহ, মান্না, রিয়াজ, ফেরদৌস, শাকিব খান—সবার জন্যই তিনি গেয়েছেন। এত কিছু বলার কারণ, গত এক বছরে চলচ্চিত্রের গানে এন্ড্রু কিশোরের শূন্যতা ভীষণভাবে অনুভব করেছি। অনেক গানই সৃষ্টির পর মনে হয়েছে, এই গান শিল্পী এন্ড্রু কিশোরের। সেই গান গাওয়ানোর জন্য বিকল্প কোনো শিল্পী পাওয়া যায়নি।'

আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি, এই চোখ দুটো মাটি খেয়ো না', কিংবা 'হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস দম ফুরাইলে ঠুস', 'আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন শুনেছিলাম গান', 'সবাই তো ভালোবাসা চায়'—কত গান—তাঁর কণ্ঠ যেসব গানকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। তাঁর কণ্ঠ সব শ্রেণির শ্রোতার হৃদয়ে অনুরণন তুলেছে। সমৃদ্ধ করেছে বাংলা গানের ভান্ডার।

এন্ড্রু কিশোর, পুলক ও সাবিনা ইয়াসমিন

গানটাকে তিনি তাঁর ধ্যানে, মনে, জ্ঞানে ধারণ করেছিলেন। বলতেন, 'আমি একজন কণ্ঠশ্রমিক। গান গাওয়াই আমার কাজ।' আর মানুষ এন্ড্রু কিশোরের কথা না বললেই নয়। একজন সজ্জন মানুষ ছিলেন তিনি। কেউ আঘাত পাবে, এমন কথা কখনো বলতে শুনিনি। কখনো কারও সম্পর্কে সমালোচনা করতে দেখিনি। এখন এ মুহূর্তে সংগীতের যেকোনো সংকটে সুপরামর্শ পাওয়ার মানুষ যখন খুঁজি, এন্ড্রু কিশোরের অভাব খুব অনুভব করি।

এন্ড্রু কিশোর

সেই ১৯৭৭ সালে আলম খানের সুরে মেইল ট্রেন ছবির 'অচিনপুরের রাজকুমারী নেই' গানে প্লেব্যাক শুরু। সেই কণ্ঠের ট্রেন থেমেছিল গত বছরের ৬ জুলাই। একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটেছিল সেদিন। আমাদের সংগীতে অনেক শিল্পীই আসবেন। গাইবেন। কিন্তু দ্বিতীয় এন্ড্রু কিশোরকে পাব না আমরা।