গানের জগতে শান্তনু বিশ্বাসের বড় স্বাতন্ত্র্য তাঁর নিজের লেখা গানের কথা ও সুর। যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতাকে কথা-সুরে সাজিয়ে গান তৈরি করেছেন তিনি। তাঁর গানে উঠে এসেছে মানুষ, মানবতা, চলমান জীবনের আনন্দ-বিষাদের নানা দিক। যার ফলে অন্য অনেকের গানের ভিড়ে শান্তনুর গান চিহ্নিত করা যায় আলাদাভাবে। তাঁর জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কেটেছে শিল্প-সান্নিধ্যে, সৃষ্টির উন্মাদনায়। কখনো নাটকে, কখনো গানে।
এসব কিছু ফেলে গুণী এই শিল্পী চলে গেলেন চিরকালের জন্য, না ফেরার দেশে। তবে তাঁর কাজ রেখে গেছেন সবার জন্য। পুরোনো কাজের পাশাপাশি ছিল অপ্রকাশিত কাজও। সেখান থেকে আটটি গান নিয়ে সাজানো হয়েছে একটি সংকলন। নাম ‘স্মৃতির শহরে’। এই অ্যালবামের মোড়ক উন্মোচন হলো গতকাল শনিবার।
শনিবার বিকেলে রাজধানীর নিউ এলিফ্যান্ট রোডের জি সিরিজের কার্যালয়ে ‘স্মৃতির শহরে’ অ্যালবামের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী বাপ্পা মজুমদার, শান্তনু বিশ্বাসের স্ত্রী শুভ্রা বিশ্বাস, সাগর লোহানী এবং জি সিরিজের কর্ণধার নাজমুল হক ভূঁইয়াসহ আরও অনেকে।
‘স্মৃতির শহরে’ সংকলনের সংগীত আয়োজন করেছেন সুদীপ্ত সাহা। এর প্রতিটি গানই শান্তনু বিশ্বাসের লেখা ও সুর করা। আর তাতে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি নিজেই।
ভালোবাসা নিয়ে শান্তনু বিশ্বাসের মন্তব্য ছিল এ রকম, ‘ভালোবাসা, এই বোধ ও অনুভবের একটা অবাধ উন্মোচন হয়তো থাকে। যৌথ জীবনের শুরুটা একটা অন্তঃশায়ী টান থেকে জন্ম নেয় যেখানে আগুনে বা অসুখে দুজনকে পুড়তে হয় পোড়ার সমুজ্জ্বল আনন্দে।’
অ্যালবামের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে জি সিরিজের উদ্যোক্তা নাজমুল হক ভূঁইয়া জানান, ‘স্মৃতির শহরে’ সংকলন মূলত ভালোবাসার গান নিয়েই তৈরি। গানগুলোর শিরোনাম হলো—‘স্মৃতির শহরে’, ‘সময়ের চাকাটা’, ‘আমার সকাল বেলার পাখি’, ‘কৃষ্ণকলি’, ‘এমন দিনে তারে’, ‘ঢেউ তোলো’, ‘দেখছি আর ভাবছি’ ও ‘বললে আমি যাই’ গানগুলো। ইতিমধ্যে গানের অ্যালবামটি জি সিরিজের ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশ করা হয়েছে।
শান্তনু বিশ্বাসের জন্ম ১৯৫৪ সালের ২৫ অক্টোবর। পড়াশোনা করেছেন চট্টগ্রামে সেন্ট প্লাসিড স্কুলে। সংগীত ও নাটকের প্রতি শান্তনুর আগ্রহ স্কুলজীবন থেকেই। সংগীতে ওস্তাদ সৌরীন্দ্রলাল দাশগুপ্ত, ওস্তাদ নীরদ বড়ুয়া ও ব্রাদার হ্যামেলের কাছে তালিম নিলেও নাটক নিয়ে ব্যস্ত থাকায় দীর্ঘকাল মঞ্চ-টিভিতে গান করেননি, অ্যালবামও বের করেননি। ২০০৭ সালে তাঁর কথা ও সুরে কয়েকটি গান করেন শিল্পী সুবীর নন্দী ও কলকাতার ইন্দ্রানী সেন। এর পরের বছরই নিজের লেখা ও সুরে অরুণিমা ইসলামের সঙ্গে দ্বৈত গানের সংকলন বের হয় তাঁর। তখন থেকেই তাঁর গানের আলাদা বৈশিষ্ট্য বুঝতে পারেন সংগীতপিপাসুরা। এরপর একে একে শিল্পী বাপ্পা মজুমদারের সঙ্গে যৌথ এবং আরও দুটি একক অ্যালবাম প্রকাশিত হয় শান্তনুর। মঞ্চ ও বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে তখন থেকে একক সংগীত অনুষ্ঠান করে শ্রোতা-দর্শকদের নিজের জাত চিনিয়েছেন তিনি।
বহুরৈখিক নিভৃতচারী শিল্পী ছিলেন শান্তনু বিশ্বাস। মুক্তিযুদ্ধ–পরবর্তীকালে থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নাটক লেখা, অভিনয় ও নির্দেশনা শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধে নিজের বড় ভাইকে হারান শান্তনু। সেই ক্ষোভ ও বেদনা বুকে নিয়ে সর্বকনিষ্ঠ শিল্পী হিসেবে যোগ দেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। স্বাধীনতার পর সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে যুক্ত হন নাটকের সঙ্গে। গণায়ন নাট্য সম্প্রদায়, অঙ্গন থিয়েটার ইউনিটের বিভিন্ন নাটকে অভিনয়ের পর নিজেই গড়ে তোলেন নাট্যদল ‘কালপুরুষ’। তাঁর প্রথম লেখা নাটক ‘কালো গোলাপের দেশ’। এরপর একে একে লিখেছেন ‘নবজন্ম’, ‘দপ্তরি রাজদপ্তরে’, ‘ইনফরমার’, ‘ভবঘুরে’, ‘নির্ভার’ প্রভৃতি নাটক। এসব নাটকে অভিনয় করেছেন তিনি। কোনোটির নির্দেশনার দায়িত্বও পালন করেছেন। মৌলিক নাটকের পাশাপাশি কিছু নাটকের অনুবাদ ও রূপান্তর করেছেন। তাঁর নির্দেশিত ‘জুলিয়াস সিজারের শেষ সাত দিন’, ‘মানুষ ও নিয়তি’ এবং ‘মৃণালের চিঠি’ এই অঞ্চলের নাট্য দর্শকদের নতুন চিন্তার খোরাক জুগিয়েছে।
মৌলিক নাটকের পাশাপাশি অনুবাদ বা রূপান্তরেও তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। কবি মনিরুল মনিরের ‘খড়িমাটি’ থেকে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হয় শান্তনু বিশ্বাসের গানের বই ‘গানের কবিতা-খোলাপিঠ’। ২০০৭ সালে শান্তনু বিশ্বাসের কথা ও সুরে এটিএন মিউজিক থেকে একটি সংকলন বের হয়। তাতে কণ্ঠ দেন শিল্পী সুবীর নন্দী ও কলকাতার ইন্দ্রাণী সেন। ২০০৮ সালে ইমপ্রেস অডিও ভিশন থেকে শান্তনুর লেখা ও সুরে শিল্পী অরুণিমা ইসলাম ও নিজের গাওয়া যৌথ অ্যালবাম বের হয়। ২০০৯ সালে জি সিরিজের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান অগ্নিবীণা বের করে শান্তনু ও বাপ্পা মজুমদারের যৌথ অ্যালবাম। ২০১২ সালে বের হয় একক সংকলন ‘পোস্টম্যান’ ও ২০১৪ সালে ‘খড়কুটো’।
ছিলেন সংগীতের সংগঠকও। এ বিষয়ে তিনি গবেষণা করেছেন, প্রবন্ধও লিখেছেন। কালপুরুষ নাট্য সম্প্রদায়ের উপদেষ্টা শান্তনু বিশ্বাস নিজের রচনা, নির্দেশনা ও অভিনয় নিয়ে সবশেষ মঞ্চে ওঠেন গত ২৮ জুন। ‘নির্ভার’ নামে সেই নাটকে তিনি অভিনয়ও করেন। ‘প্রসেনিয়াম’ নামের একটি মনন ঋদ্ধ নাট্যপত্রিকা সম্পাদনা করেন দীর্ঘদিন।
গত ১২ জুলাই শান্তনু বিশ্বাস প্রয়াত হন। মৃত্যুর অনেক আগে ২০১৫ সালে মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকার করে যান এই শিল্পী। শান্তনু বিশ্বাসের সেই ইচ্ছানুযায়ী তাঁর স্ত্রী ও দুই কন্যার সম্মতিতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে তাঁর মরদেহ দান করা হয় চিকিৎসাবিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা উপকরণ হিসেবে।