১২টা পেরিয়ে ১টা বাজিয়ে তাঁরা এলেন। ‘ওল্ড ব্রিগেড’; আরও স্পষ্টভাবে বললে আইনাস তাজওয়ার, সপ্তক খান, রিয়াসাত ইয়াসিন আর ইশমাম রাব্বানী। ‘আমরা সবাই রাজা’র মতো সবাই সমান। এখানে দলপ্রধান বলে কিছু নেই।
আইনাসের মা চিত্রশিল্পী। তাঁর জন্য তাই শিল্পী হওয়ার পথ সহজ ছিল। ফলিত পদার্থবিজ্ঞানে পড়াশোনা শেষ করে ক্যারিয়ার গড়েন শব্দ প্রকৌশলী হিসেবে। সেখান থেকে ওল্ড ব্রিগেডের ভোকাল ও গিটারিস্ট হওয়ার জন্য নিজের সঙ্গে নিজেকে যুদ্ধে বসতে হয়েছে। শেষমেশ জয়ী হয়েছে ওল্ড ব্রিগেড। সপ্তককে না চিনলেও তাঁর দাদাকে একনামে চিনবেন। ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ আর তাঁর বড় ভাই ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁ। পরিবারের সবাই যখন সপ্তকের রক অ্যান্ড রোল ব্যান্ড মিউজিকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন, তাঁর বড় চাচা শেখ সাদি খান গোপনে তাঁর পিঠে হাত রেখেছিলেন। জানিয়েছিলেন, পাশে আছেন। সপ্তক খান এই ব্যান্ডের লিড গিটারিস্ট। এদিকে ইশমাম আবার বাড়ির গ্যারেজে বা বন্ধুর বাসায় গিটার লুকিয়ে রেখে তারপর ভালো ছেলে হয়ে ঘরে ঢোকেন। তিনি বেজ গিটারিস্ট। ওদিকে ইশমামই জানান, মার্কেটিং পড়ুয়া রিয়াসাত ভাই নাকি কখনো ছোটখাটো কোম্পানিতে কাজ করেনি। কিন্তু গানের জন্য একাধিকবার চাকরি ছেড়েছেন। আবার নতুন চাকরি জুটিয়ে নিতে সময় লাগেনি। তিনি এই ব্যান্ডের ড্রামার।
ওল্ড ব্রিগেডের পুরোনো কথা
প্রায় এক দশক আগে আইনাস তাজওয়ারই প্রথম স্বপ্ন দেখেন এই ব্যান্ডের। তারপর কত বসন্ত গেল, কতজন এল–গেল। ২০১২ সালে ইশমামের মনে হলো, ওল্ড ব্রিগেড তাঁর বাকি জীবন। পরের বছর যোগ দেন রিয়াসাত। আবার চলেও গেলেন। যখন ভাবা হচ্ছিল, এই ব্যান্ড আর দাঁড়াচ্ছে না, তখন সপ্তক যোগ দিয়ে শক্তভাবে হাল ধরলেন। রিয়াসাতও কী মনে করে পুরোনো চাকরি ছেড়ে দিয়ে স্থায়ী হন ঢাকা শহরে। দীর্ঘদিন পর ফোন করলেন আইনাসকে। দেখা করতে চান। অভিমানী আইনাসের একটাই শর্ত, ব্যান্ড নিয়ে কোনো কথা নয়। কিন্তু এক ফাঁকে রিয়াসাত ঠিকই আবার ওল্ড ব্রিগেডে যোগ দেওয়ার কথাটা বলেই ফেললেন। অভিমানের বরফ গলতে সময় লাগেনি। ২০১৮ সালের মাঝামাঝি সব উত্থান–পতনের গল্প শেষ করে চার যোদ্ধার ওপর ভর করে উঠে দাঁড়ায় ওল্ড ব্রিগেড। এবার কেবল এগিয়ে যাওয়ার গল্প।
‘ঘুড়ি’ আর ‘কামনা’
অফিশিয়ালি ওল্ড ব্রিগেডের প্রথম গান মুক্তি পায় ২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি। গানের নাম ‘ঘুড়ি’। ইউটিউবে ব্যান্ডের প্রথম গানটি এখন পর্যন্ত দেখা হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার বার। আর এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত গানের নিচে জড়ো হওয়া ৯৯টি মন্তব্য পড়লে আপনি অবাক হবেন। মন্তব্যগুলো এ রকম, ‘আমার ফোনে রিপিটেড মুডে চলছে’, ‘বেশি জোশ’, ‘প্লিজ, আপনারা অন্যদের মতো থেমে যাবেন না’, ‘অ্যামেজিং’, ‘ওয়াও’, ‘গো অ্যাহেড’, ‘শুভকামনা’—এ রকম আরও কত–কী। একজন তো ভবিষ্যদ্বাণী করে দিলেন, ‘আপনারা অনেক দূর যাবেন, লিখে রাখুন।’ ট্রলের এই যুগে অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, প্রতিটি মন্তব্যই এমন, ইতিবাচক, অনুপ্রেরণাদায়ক। আর এসব শুভকামনা একইভাবে সত্যি ওল্ড ব্রিগেডের দ্বিতীয় গান ‘কামনা’র জন্যও। এ পর্যন্ত ইউটিউবে গানটি দেখা হয়েছে প্রায় ৩৫ হাজারবার। এই গানও রক অ্যান্ড রোল ধাঁচের। কিন্তু ‘ঘুড়ি’ থেকে একেবারে ভিন্ন। মানুষের মনের পশুত্ব যেভাবে আলোকে কালো করে দেয়, সেই কথা চিৎকার করে জানান দিয়েছে ওল্ড ব্রিগেড।
আসছে নতুন অ্যালবাম
২০২০ সালের মাঝামাঝি ওল্ড ব্রিগেড নিয়ে আসবে তাঁদের প্রথম অ্যালবাম, ‘ঘড়ি’। অ্যালবামের নাম ‘ঘড়ি’ কেন? উত্তর এল, ‘কারণ আমরা সময়টাকে ধরতে চাই। আমরা আমাদের সময়ের কথা জানান দিতে চাই। আমাদের সময়ে আমাদের চারপাশের কথা বলতে চাই।’ ‘ঘড়ি’তে থাকবে ১০টি গান। ইতিমধ্যে মুক্তি পেয়েছে ২টি। ‘কামনা’ গানটি তো একেবারেই সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে নির্মিত। সামাজিক দায়বদ্ধতা বিষয়টা কী? উত্তর এল, ‘মানুষ হিসেবে বোধশক্তি হওয়ার পর থেকে আমরা সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ। এটা তো আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক সত্তা থেকে আলাদা কিছু নয়।’
কেন আপনারা সংগীতকেই জীবনসঙ্গী করলেন?
এই প্রশ্নের উত্তরে সবাই একমত হলেন, সংগীত কেবল গান, সুর আর বাদ্য–বাজনা নয়; এটা একটা উদ্যাপন পদ্ধতি। তাঁরা মনে, মননে আর পোশাকও রক অ্যান্ড রোল বিষয়টা ধারণ করেন। স্টুডিও বাক্সের প্রতিষ্ঠাতা ও শব্দ প্রকৌশলী আইনাসের মতে, মিউজিক পদার্থবিজ্ঞানের মতোই একটা বিজ্ঞান। যে পাগলামি না থাকলে ব্যান্ড করা যায় না, সেই পাগলামি এই চারজনের মধ্যেই আছে। কেমন? এই ধরুন, গানের সঙ্গে গিটারের শব্দটা ঠিক যেন মানাচ্ছে না। ইশমাম তাই গিটারটাই বদলে ফেললেন। কিনলেন নতুন গিটার। এটিও যদি তাঁর মনঃপূত না হতো, তবে আবারও নতুন গিটার কিনে বাজাতেন তিনি। রিয়াসাতও পারফেকশনিস্ট। তিনি সাউন্ড রেকর্ড করে নানা ধরনের হেডফোন, স্পিকার, ভালো গাড়ি, খারাপ গাড়ির সাউন্ড সিস্টেম—সবখানে বাজিয়ে দেখেন। আবার সন্তুষ্ট হওয়া না পর্যন্ত সাউন্ডের কাজ করেন। তাঁদের দাবি, টিভি, রেডিও, হেডফোন, লাইভ—সবখানে তাঁদের সাউন্ড একই রকম শোনাবে। পুরো গান যখন তৈরি, তখন সপ্তক এসে বলেন, ‘ভাইয়া, আমার অংশটা আমি একবার এভাবে গাইতে চাই।’ ব্যস, নতুন করে শুরু হলো রেকর্ডিং। মোটকথা, যাতে পরে কখনো মনে না হয়, ‘ইশ্, এইটা যদি করতে পারতাম।’
কোথায় যেতে চায় ওল্ড ব্রিগেড?
এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে ব্যান্ডের নামের সার্থকতা খানিক না বললেই নয়। আইনাসের বাবা ফায়ার ব্রিগেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক । সেখান থেকে ব্রিগেড শব্দটা নেওয়া। আর বিশ্বসংগীতে যখন ১৯৬০ আর ১৯৭০–এর দশকে দাপটের সঙ্গে রক ব্যান্ডের আবির্ভাব ঘটল, বিটলস, পিংক ফ্লয়েড, দ্য রোলিং স্টোনস, দ্য হু, লেড জেপলিন—তাঁদের মতোই পুরোনো সেই ধারাকে নিজেদের সময়ের আঙ্গিকে নতুনভাবে উপস্থাপন করছেন তাঁরা। তাই নাম ওল্ড ব্রিগেড। কোথায় যেতে চায় ওল্ড ব্রিগেড? উত্তর হলো, কোথাও যেতে চায় না ওল্ড ব্রিগেড। কেবল পথ চলতে চায়। আর পথ চলতে চায়। তাঁরা এই পথচলাকে উপভোগ করতে চায়। দিন শেষে তাঁরা প্রত্যেকেই নিজেদের স্বপ্নের জীবনযাপন করতে পারছেন, এটিই তাঁদের আত্মতৃপ্তি। এক জীবনে কোনো আক্ষেপ নিয়ে বাঁচতে চান না তাঁরা। আর কথা দিয়েছেন, আক্ষেপ রাখবেনও না।