তাঁরা দুজন যদি না জন্মাতেন, তবে কী হতো, তা এখন আর কল্পনা করা সম্ভব নয়। তবে জন্মে ধন্য করেছেন গানের জগৎ। ধন্য হয়েছে গীতিকারের মুক্তার মতো লেখা অক্ষরগুলো। ধন্য সুরকারের সুর। এখনো অনেক মা-বাবা গান শুনিয়েই সন্তানকে ঘুম পাড়ান। সন্তান যখন আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠে, তখনো মান্না আর হেমন্তর গান শুনেই শান্ত হয়ে যায়। সেই শিশু হয়তো তখনো কথা বলতে শেখেনি। কিন্তু এসব গান অজান্তেই তার মনের গভীরে প্রবেশ করে। এ বছর ভারতীয় সংগীতজগতের সেই দুই কিংবদন্তির জন্মশতবর্ষ। হ্যাঁ, তাঁরা মান্না দে আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
সেই যে জন্মেছেন, জন্মে অমর হয়েছেন। যত দিন বাংলায় সন্তানেরা জন্ম নেবে, তত দিন বাজবে ‘আয় খুকু আয়...’ বহু বছর পর বাবা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় চা-কফি খাবেন, আর চশমাটা খুলে হাতে নিয়ে কফি হাউসের সেই দিনগুলোতে ফিরবেন না, তা হবে না। কফি হাউস মানে কেবল মধ্য কলকাতার বইপাড়ায় কলেজ স্ট্রিটের সেই পুরোনো রেস্তোরাঁ নয়, কফি হাউস মানে যে নস্টালজিয়া।
আজি হতে শতবর্ষ আগে
১০০ বছর আগের কথা। তখন বৈশাখের মাঝামাঝি। ১৯১৯ সালের ১ মে জন্ম প্রবোধ চন্দ্র দের। সেই প্রবোধ চন্দ্রই একসময় হয়ে উঠলেন সংগীতজগতের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র, মান্না দে। যাঁর নাম উচ্চারিত হয় মোহাম্মদ রাফি, কিশোর কুমার বা মুকেশ চন্দ্র মাথুরদের সঙ্গে। যেদিন জন্মেছিলেন, সেদিন কি কেউ ভেবেছিল, তাঁর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে রচিত হবে দিস্তার পর দিস্তা প্রেমকাব্য? যেখানে শ্রবণসুখের অনুভবকে পুষ্পস্তবক বানিয়ে অর্পণ করা হয়েছে এই শিল্পীর পদতলে।
তবে সে এক বৃথা চেষ্টা। মান্না দের গান শুনে কেমন অনুভূতি হয়, তা কি পৃথিবীর কোনো ভাষায় শব্দ দিয়ে প্রকাশ করা যায়? সেই উত্তর কেবল হৃদয়ের খুব গভীরে নীরবে পরিতৃপ্তির হাসিমুখ হয়ে থাকে। বাংলা, হিন্দি, গুজরাটি, মারাঠিসহ অসংখ্য ভাষায় ৬০ বছরের বেশি সময় ধরে গান গেয়েছেন মান্না দে। গানের সংখ্যা সাড়ে তিন হাজারের বেশি। প্লেব্যাক করেছেন অসংখ্য ছবিতে। কিন্তু যত দিন যায়, রাত যায়, মান্না দের গানগুলো (নন-ফিল্ম) তাড়া করে বুকের ভেতর তারা হয়ে থাকার জন্য।
মান্না দের একেকটা গান শুনলে অনুভূতি কেমন হয়? উত্তর দেওয়া খুব কঠিন। মাঝেমধ্যে মেঘের ভেতর দিয়ে ঠিকানাহীন এক দ্বীপে হেঁটে যাওয়ার মতো। মেঘের মধ্যে হাঁটতে কেমন লাগে, তাও তো জানা নেই। তাঁর গান মাঝেমধ্যে বিষাদের সব গাঢ় নীল সদলবলে আচ্ছন্ন করে ফেলে হৃদয়কে। কোত্থেকে যেন খুব সূক্ষ্ম একটা ব্যথা করে। সেই ব্যথা হতে পারে সুখের। হতে পারে আশায় আশায় থেকে সুখ পাখির দেখা না পাওয়ার।
সেই হেমন্ত পা দিলেন শতবর্ষে
বেঁচে থাকলে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এত দিনে ৯৯ পেরিয়ে ১০০-তে পা দিতেন। তবে তিনি তো পেরিয়ে গেছেন সময়ের সব বেড়া। তাই শততম শতবর্ষ যদি কোনো দিন আসে, সেদিনও হয়তো পৃথিবীর বাইরের কোনো একটা জায়গা থেকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় দেখবেন, এই পৃথিবীতে রবীন্দ্রনাথের সোনার তরীতে করে ভেসে বেড়াচ্ছেন। গান হয়ে, সুর হয়ে, অশান্ত শহরে প্রশান্তি হয়ে।
হেমন্ত জন্মেছিলেন ঘোর বর্ষায়। ১৯২০ সালের ২৬ জুন। তারপর শরৎ পেরিয়ে হেমন্তের জীবনের এল প্রথম হেমন্ত। ধীরে ধীরে সেই হেমন্তই হয়ে উঠলেন এক মহিরুহ।
এখনো বসন্ত আসে, কোকিল ডাকে, হু হু করে মন
বয়সে তিনি মান্না দের চেয়ে এক বছর দুই মাসের ছোট। ওপারে যাওয়ার তাড়া ছিল কি না, কে জানে! পৃথিবীকে চিরবিদায়ও বলেছেন মান্না দের ২৪ বছর আগে। তবে কেউ যদি বলে তাঁরা মারা গেছেন, তা কতটা সত্যি, তা নিয়ে সত্যি সংশয় আছে। হেমন্তের পরে শীতের কুয়াশা সরে গিয়ে জায়গা করে দেয় বসন্তকে। নাম হেমন্ত হলে কী হবে, কণ্ঠতে তো চিরকাল বসন্ত ঝরেছে। তাঁর গলায় গান ফুল হয়ে ফুটেছে।
বাবা হয়তো বাজার নিয়ে ঘরে ফিরলেন। চা হাতে নিয়ে বসতেই চোখ পড়ল দূরে থাকা ‘খুকু’র ছোটবেলার ছবিতে। সে সময় বাবার চোখ যদি অজান্তেই ভিজে আসে, আর বাবার কথা মনে ভাবতে ভাবতে বর হয়ে যাওয়া সেই মেয়েটির গরম কফি যদি জুড়িয়ে যায়, বাবার কথা, ছেলেবেলার কথা মনে করে তাঁর বুকের ভেতর যদি হু হু করে ওঠে, তবে সেই দায় একান্তই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের। তিনি যদি শ্রাবন্তী মজুমদারকে সঙ্গে নিয়ে ওভাবে ‘আয় খুকু আয়’ না বলতেন, তাহলে হয়তো আজ বাবা আর মেয়ের বুকের ভেতর এমন করে উঠত না।
আর মান্না দে ওই যে গাইলেন, ‘সবাই তো সুখী হতে চায়, কেউ সুখী হয়, কেউ হয় না।’ এই এক গান সবার ভেতরটা নিমেষেই ওলট-পালট করে দিল। এত দিন লোকে জানত, সহজ কথা যায় না বলা সহজে। কিন্তু মানুষটা কীভাবে এত সহজে এই সহজ অথচ ধ্রুব সত্যিটা গাইলেন? তাও আবার এত মধুর করে।
হেমন্তের গানে রোমান্টিকতাকে যেভাবে একরকম নিঃশব্দে ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তা আর কার গানে হয়েছে? ‘আমি দূর হতে তোমারেই দেখেছি, আর মুগ্ধ এ চোখে চেয়ে থেকেছি...’, ‘এই রাত তোমার আমার, ওই চাঁদ তোমার আমার… শুধু দুজনে’, ‘ও আকাশ প্রদীপ জ্বেলো না, ও বাতাস আঁখি মেলো না, আমার প্রিয়া লজ্জা পেতে পারে, আহা, কাছে এসেও ফিরে যেতে পারে’, ‘এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে না তো মন, কাছে যাব কবে পাব ওগো তোমার নিমন্ত্রণ’, ‘মেঘ কালো, আঁধার কালো’—এভাবেও বুঝি কোনো হইচই, শোরগোল ছাড়া প্রিয়কে, প্রিয়াকে গভীরভাবে ভালোবাসা যায়! এই গানগুলো তিনি গাওয়ার আগে কে জানত। তিনিই গেয়েছেন, ‘মা গো, ভাবনা কেন’, এরপরই মায়েরা একটু নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমিয়েছেন।
কফি হাউসের সেই আড্ডাটা
মান্না দে নামটা শুনলে প্রথমেই মনে আসে কফি হাউসের কথা। স্মৃতির জাল ছিঁড়ে ছিঁড়ে কল্পনার টাইম মেশিনে মানুষ চলে যায় সাদাকালো সেই সময়ে। যখন বন্ধু ছিল, আড্ডা ছিল, ছিল চোখভর্তি স্বপ্ন। জীবন তখনো এতটা জটিল হয়ে ওঠেনি। যদিও মান্না দে এই গানের কৃতিত্ব নিতে রাজি নন। তিনি সব সময় বলেছেন, গানটির গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার আর সুরকার সুপর্ণকান্তি ঘোষই এই গানের স্রষ্টা। তিনি কেবল গেয়েছেন। মান্না দে এও বলেছেন, গানটি নাকি হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বা শ্যামল মিত্র গাইলেও দুর্দান্ত সুপারহিট হতো। কে জানে, কী হতো। তবে যে হাহাকার নিয়ে মান্না দে ‘আজ আর নেই’ বলেছেন, সেই হাহাকারের উৎস বোধ হয় এই পৃথিবীতে না। অন্য কোথাও।
কফি হাউস গানের জন্মের গল্পটি না বললেই কি জমে। তখন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার একের পর এক লিখছেন প্রেমের গান। আর সেসব আশা ভোসলে গাইছেন, আর হিট। তিনি তখন ক্যানসারে আক্রান্ত। গৌরীপ্রসন্নের মনে আক্ষেপ, তিনি মান্না দে-কে দিয়ে নিজের লেখা গান গাওয়াতে পারেননি। তখন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় মান্না দের জন্য গান লিখতেন। সময়টা ১৯৮৩। সেদিন গৌরীপ্রসন্ন গিয়েছিলেন সংগীত পরিচালক ও সুরকার নচিকেতা ঘোষের বাড়ি। অনেকক্ষণ পর বাড়ি ফিরেছিল নচিকেতার ছেলে সুপর্ণকান্তি। তাঁকে দেখে গৌরীপ্রসন্ন বলে উঠেছিলেন, ‘কী, বাইরে আড্ডা দিয়ে সময় কাটাচ্ছ?’ সুপর্ণকান্তিও পাল্টা উত্তর দিয়ে বললেন, ‘কী সব গদগদে প্রেমের গান যে লেখো। আড্ডা নিয়েই তো একটা গান লিখতে পারো।’ ভাগ্যিস বলেছিলেন।
সেদিন সেখানে বসেই গৌরীপ্রসন্ন বললেন, লিখে নাও, ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই/ কোথায় হারিয়ে গেল সোনালি বিকেলগুলো সেই’। সঙ্গে সঙ্গে সুপর্ণ সুরও বেঁধে দিলেন। সেই সুর মনে ধরল গৌরীপ্রসন্নের। পরদিন সকালেই গৌরীপ্রসন্নের স্ত্রীর ফোন। সুপর্ণকান্তিকে জানালেন, বহুদিন পর অসুস্থ শরীর নিয়ে সারা রাত জেগে গান লিখেছেন গৌরীপ্রসন্ন। সুপর্ণকান্তি সুর দিলেন। তবে তখনো বাকি ছিল শেষ স্তবক।
সুপর্ণকান্তি ওই শেষ স্তবকটা চাইছিলেন। কিন্তু গৌরীপ্রসন্নের মনে হচ্ছিল, ওখানে শেষ করে দেওয়াটাই ঠিক আছে। তারপর কিছুদিন না যেতেই শরীরটা ভেঙে পড়ল গৌরীপ্রসন্নের। সেদিন তিনি চিকিৎসার জন্য চেন্নাই যাচ্ছিলেন। পথের মধ্যে হাওড়া স্টেশনে মৃত্যুচিন্তার মাঝে হঠাৎ তাঁর মাথায় এল গানের শেষ চার চরণ—
‘সেই সাতজন নেই আজ টেবিলটা তবু আছে সাতটা পেয়ালা আজও খালি নেই
একই সে বাগানে আজ এসেছে নতুন কুঁড়ি শুধু সেই সেদিনের মালী নেই
কত স্বপ্নের রোদ ওঠে এই কফি হাউসে কত স্বপ্ন মেঘে ঢেকে যায়
কতজন এল গেল কতজনই আসবে, কফি হাউসটা শুধু থেকে যায়।’
কিন্তু লিখবেন কিসে? হাতে ছিল সিগারেটের প্যাকেট। তারই পেছনে কথাগুলো লিখে পাঠিয়ে দিলেন সুপর্ণকান্তিকে। এভাবেই জন্ম নিল এক মহাকাব্য। স্থান পেল বিবিসির জরিপের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাংলা গানের ছোট্ট তালিকায়।
২০ বছর পর...
মান্না দে দেহ ত্যাগ করেন ২০১৩ সালে, ৯৪ বছর বয়সে। এর ১০ বছর আগে আর কফি হাউসের ২০ বছর পর, অর্থাৎ ২০০৩ সালে জন্ম নিয়েছিল আরেকটি গান। ‘কফি হাউস টু’। সেই নিখিলেশ, মইদুলদের নিয়ে। সেখানে ২০ বছর পরপর, তাঁরা কে কোথায় কী করছেন, সেসব বলা হয়। এবার গানের কথা লিখেছিলেন শমীন্দ্র রায় চৌধুরী। সুপর্ণকান্তিই সুর দিয়েছিলেন। একই স্কেলে গেয়েছিলেন মান্না দে।
এই দ্বিতীয় গানটি নাকি সুরের বৈচিত্র্যের বিচারে প্রথমটির থেকেও অনেক ভালো হয়েছিল। কিন্তু শ্রোতারা এই গানটিকে আগেরটার সিকিভাগও আপন করে নেননি। মান্না দেও হতাশ। তিনি শুধু বলেছেন, বাঙালি তো জানতেই পারল না সেই গানের কথা, নিখিলেশ, মইদুল, রমা, সুজাতার কথা। তারপর কী হলো সেই কফি হাউসের!
আগের গানটি শুনে প্রশ্ন জেগেছিল, সুজাতা কি আসলেই সুখে আছেন? হিরে, জহরতে আগাগোড়া মোড়া থাকলেই তাকে সুখে থাকা বলে? সুজাতার প্রতি এ কেমন অভিমান কবির! আর সবাই কে কী করতেন, সে কথা একবার হলেও গানে বলা হয়েছিল। শুধু সুজাতাই অবহেলিত। যেন বিয়ে করে মস্ত বড় অপরাধ করে ফেলেছেন তিনি। তবে কি মনে মনে সুতাজাকে ভালোবাসতেন কবি? অনেকে বলেন, কফি হাউসের সুজাতাই নাকি অঞ্জন দত্তের ‘মালা’।
সে যা-ই হোক, ২০ বছর পর কবি লিখেছেন, ১৩ তলা বাড়িতে সবই আছে, তবু কিসের যেন অভাব সুজাতার। লিখেছেন, নিখিলেশ নাকি এবারের পূজাটা প্যারিসে নয়, কলকাতায় কাটাবেন। অমলের ছেলেটা এখন ডি সুজার ফেলে যাওয়া গিটার বাজান। আরও কত কী!
এখন তো বোধ হয় এই সাতজন ওপারে গিয়ে আবার বসিয়েছেন কফি হাউসের সেই আড্ডা। ডি সুজা কি এখনো চোখভরা কথা নিয়ে নির্বাক শ্রোতা হয়ে বসে কী যেন ভাবেন? খুব জানতে ইচ্ছা করে। তাঁরা কি সবাই আগের মতোই আছেন, নাকি অনেকখানি বদলে গেছেন...
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের একটি গল্প
দক্ষিণ কলকাতার তখন সন্ধ্যা নামবে নামবে করছে। ২০ থেকে ৩০টি গান গেয়ে সন্ধ্যাকে গভীর রাত বানিয়েছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। ক্লান্ত হয়ে মঞ্চ থেকে নামলেন। তখনই ৮০-ঊর্ধ্ব এক বৃদ্ধা আকুলভাবে হেমন্তর হাতটা ধরলেন। একটা ঠোঙা দিয়ে বললেন, ‘মন ভরে গেছে, বাবা। কিন্তু তুমি তো আমার সবচেয়ে প্রিয় গানটাই গাইলে না।’ সেই ঠোঙায় করে তিনি অনেকটা দূর থেকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জন্য নাড়ু বানিয়ে এনেছিলেন। আগ্রহভরে হেমন্ত জিজ্ঞেস করলেন, কোন গানটি? বৃদ্ধা বললেন, ‘ওই যে বিষ্ণুপ্রিয়া গো আমি চলে যাই, তুমি আছ ঘুমঘোরে...।’
ঠোঙা হাতে আবার মঞ্চে উঠলেন হেমন্ত। ততক্ষণে পরের শিল্পীর জন্য মঞ্চে অর্কেস্ট্রা তৈরি। তৈরি শিল্পীও। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সেই শিল্পীকে নিচু গলায় কী যেন বললেন। তারপর জলসার সব দর্শক দেখলেন, সেই শিল্পী সসম্মানে মঞ্চ ছাড়লেন। তারপর সেই ঠোঙা মাথায় ঠেকিয়ে হেমন্ত বললেন, ‘আমি কি এত ভালোবাসার যোগ্য?’ এরপর উপস্থিত দর্শক শুনলেন, বাতাস চিরে ভেসে আসছে জাদুকরি শব্দতরঙ্গ, ‘বিষ্ণুপ্রিয়া গো, আমি চলে যাই, আমি চলে যাই...।’
চিরতরুণ মান্না দে
মান্না দে যে চিরতরুণ, এটা কেবল কথার কথা না। ইউটিউবে মান্না দের গানের ভিডিওর নিচে জড়ো হওয়া মন্তব্যগুলো পড়ুন। মান্না দের সময়কার হাজারো প্রবীণ লিখেছেন, তাঁদের বুকের ভেতরে কেমন সবুজ তারুণ্যের অনুভূতি হচ্ছে। ওই যে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম যেমনটা বলেছেন। অনেক তরুণও মন্তব্য করেছেন, এ বয়সে এই গান কীভাবে গাইলেন মান্না দে! এ তো তাঁদের মনের কথা। মান্না দে তখন কীভাবে বুঝলেন? মান্না দে নাকি ছোট্ট করে শুধু বলতেন, ‘প্রেমের কি বয়স হয়?’
এসব প্রশ্নের উত্তরে একটা গল্প বলি। সুরকার মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে দিয়ে ‘তুমি কত সুন্দর’ সিনেমায় ‘তোমার বাড়ির সামনে দিয়ে আমার মরণযাত্রা যেদিন যাবে’ গাওয়াতে চেয়েছিলেন। গানের কথা শুনেই মুখের ওপর ‘না’ করে দিলেন মান্না দে। সাফ জানিয়ে দিলেন, এসব গান তিনি গাইবেন না। আর পরে দেখা গেল, সেই গান কিশোর কুমারের গলায় সুপারহিট। আর তা নিয়ে কোনো দিন বিন্দুমাত্র আক্ষেপ করেননি মান্না দে।
কফি হাউসের গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন ক্যানসারের সঙ্গে লড়ে মারা যান ১৯৭৬ সালে। এরপর তাঁর কথাতেই মান্না দে গেয়েছিলেন, ‘আমি কি আর ভালো হব না, ডাক্তার রায়?’ পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় স্টিমারের ওপর থেকে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করার পরে গেয়েছিলেন, ‘পৃথিবীকে বিদায় জানিয়ে চলে গেছে বন্ধু আমার/ দরজায় কড়া নেড়ে কোনো দিন সে এসে গেছি বলবে না আর’।
সবচেয়ে কাছের বন্ধুদের হারিয়েও মৃত্যুচিন্তা দূরে রাখতেই পছন্দ করতেন মান্না দে। প্রবলভাবে ভালোবাসতেন জীবন। ৯০ পেরিয়েও গেয়েছেন আকুল প্রেমের গান। গেয়েছেন, ‘তুমি চিঠি লিখে ভুলে গেলে জুড়ে দিতে খাম, আমার হলো না সে চিঠি পড়া, শুধু হলো বদনাম’। এমনি বয়স্কদের সঙ্গে মেলামেশা, ওঠাবসাও করতে পছন্দ করতেন না। বলতেন, ‘ওদের সঙ্গে আমার মেলে না। শরীরটা বুড়িয়ে গেলে কী হবে, আমার মন যে তরুণ।’
হেমন্ত যেভাবে বসন্ত হলেন
তিনি কেবল নামেই হেমন্ত। আর কণ্ঠ চিরবসন্ত। কিন্তু গান করবেন, ছেলেবেলায় এমন ভাবনা ছিল না তাঁর। উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বেন বলে। কলেজেই কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। সুভাষই জহুরির চোখে চিনে নিয়েছিলেন এই খাঁটি সোনাকে। তাঁরই অনুপ্রেরণায় ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্নটাকে সুতা কাটা ঘুড়ির মতোই উড়তে উড়তে হারিয়ে যেতে দিলেন। সেই জায়গা নিল গান।
তারপর বহু জল গড়াল। একদিন প্রযোজক শশধর মুখোপাধ্যায় মুম্বাইয়ের এক স্টুডিওতে চাকরি দিলেন হেমন্তকে। সেখানে ‘আনন্দমঠ’, ‘শর্ত’, ‘সম্রাট’ ছবিতে গাইলেন। কিন্তু ছবির গানগুলো হিট করলেও সিনেমা ফ্লপ! হেমন্তের বিবেক বলল, এভাবে বেতন নেওয়া যায় না। যে ভাবা সেই কাজ। হতাশ হয়ে পদত্যাগপত্র লিখে কলকাতায় পালিয়ে যেতে চাইলেন। ব্যাগপত্র গুছিয়ে সোজা চলে এলেন স্টেশনে। কিন্তু স্টেশন থেকে স্ত্রী বেলা মুখোপাধ্যায় ফোন করলেন প্রযোজক শশধর মুখোপাধ্যায়কে। সব বলে দিলেন। শুনে প্রযোজক হেমন্তকে বললেন, ‘তুমি হেরে যাওয়া মানে আমার হেরে যাওয়া। আমার হাতে একটা নতুন ছবি এসেছে। এই শেষ।’ রাজি হেমন্ত। আর সেই ছবির নাম ‘নাগিন’ (১৯৫৪)। আর ‘নাগিন’-এর গানের রেকর্ড ভাঙতে সময় লেগেছিল ২০ বছর। আর পেছনে তাকাতে হয়নি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে। অথচ একসময় রেকর্ড স্টুডিও থেকেও হেমন্তকে শুনতে হয়েছিল, ‘তুমি আর যা-ই করো বাপু, গানটা শুধু বাদ দাও।’
ওল্ড কি সত্যিই গোল্ড?
মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানের নিচে লেখা মন্তব্যের একটা বড় অংশজুড়ে দেখবেন, মানুষ ভুগছে নস্টালজিয়ায়। সেখানে মন্তব্যগুলোর একটা বড় অংশের অর্থ করলে দাঁড়ায়, ‘আহা, কী দিন ছিল।’ একদল আবার বলেন, গান তো গেয়েছেন তাঁরাই। এখনকার যুগে শিল্পীরা যা গান, তাকে অনেক কিছু বলা যাবে, তবে গান নয়। এ যুগের ছেলেমেয়েরা আবার পাল্টা তর্ক জুড়ে বসবে। কিন্তু এসব তর্ক-বিতর্ক কিছুই স্পর্শ করতে পারবে না এই শিল্পীদের কালজয়ী গানগুলোর। আলাপ চলবে, চায়ের কাপে উঠবে ঝড়। এর মধ্যেই হঠাৎ কোত্থেকে বেজে উঠবে, ‘আগামী পৃথিবী শোনো, আমি বলে যাই, ভালোবাসবার কোনো দিনক্ষণ নাই...।’
তথ্যসূত্র: মান্না দের আত্মজীবনী ‘জীবনের জলসাঘরে’, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘কথায় কথায় যে রাত হয়ে যায়’, দ্য স্টেটসম্যান, কবিতা কৃষ্ণমূর্তি ও আরতি মুখোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার, প্রবীর মিত্র ও দেবপ্রসাদ চক্রবর্তীর লেখা অবলম্বনে