‘যদি রাত পোহালে শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই...’। বছরের নানা সময় এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন, মৃত্যুবার্ষিকীতে অলিগলি–রাজপথ কিংবা মানুষের বাড়িতে গানটি বেজে ওঠে বারবার। টেলিভিশন চ্যানেলে বারবার প্রচার হয় গানের ভিডিও, বেতারে শোনা যায় গানটি। জাতীয় শোক দিবসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অসংখ্য স্ট্যাটাসে দেখা যায় গানের লাইন, ‘যদি রাত পোহালে শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই’। গানটা জাতীয় শোক দিবসের শিরোনাম সংগীতের মতো হয়ে গেছে। খুব আবেগ এবং দরদভরা গান।
এই গান নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে গীতিকার হাসান মতিউর রহমান ও সুরকার মলয় কুমার গাঙ্গুলী দুজনই আবেগাপ্লুত হলেন। কথা হয়েছিল গানটির শিল্পী সাবিনা ইয়াসমীনের সঙ্গেও। তিনজনই জানালেন, তাঁদের সংগীতজীবনের স্মরণীয় সংযোজন এই গান। এই গানের সুবাদে ২৯ বছর ধরে বঙ্গবন্ধুভক্ত অসংখ্য মানুষের ভালোবাসাও পেয়েছেন তাঁরা। যতবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁদের দেখা হয়েছে, ততবারই গানটির প্রশংসা করেছেন তিনি।
গানটি লেখা হয় ১৯৯০ সালে। তথ্যটি দিলেন গীতিকার হাসান মতিউর রহমান। তিনি এখন থাকেন মগবাজারের নয়াটোলায়। স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে গীতিকার হাসান মতিউর রহমান বলেন, ‘আমি তখন থাকতাম ঢাকার সিপাহীবাগে। ভাড়া বাসায়। মলয় কুমার গাঙ্গুলী আমাকে ফোনে গানটির পরামর্শ দিলেন। বিষয়টি বিস্তারিত জানালেন। ওই রাতেই লিখতে বসি। কিন্তু অনেক ভেবেও শুরু করতে পারছিলাম না। সারা রাত কেটে গেল। চোখে ঝিমুনি। ভোরের দিকে একটা সূত্র পেলাম। মনে হলো, বঙ্গবন্ধু তো একজন মহান মানুষ, জনগণের বন্ধু। তিনি কখনো মরতে পারেন না। তিনি বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন। এসব ভাবতে ভাবতে লিখে ফেললাম “যদি রাত পোহালে শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই/ যদি রাজপথে আবার মিছিল হতো বঙ্গবন্ধুর মুক্তি চাই!” এতে কল্পনায় বঙ্গবন্ধুকে যেমন বাঁচিয়ে রাখা হচ্ছে, তেমনি জেল থেকে তাঁকে মুক্ত করার কথা বলা হচ্ছে। লিখতে লিখতে আবেগে ঘন ঘন পুলকিত, শিহরিত হচ্ছিলাম। শেষ প্যারায় লিখলাম, “কে আছে বাঙালি তাঁর সমতুল্য/ ইতিহাস একদিন দেবে তাঁর মূল্য/ সত্যকে মিথ্যার আড়াল করে যায় কি রাখা কখনো তা।” এরপর পুরো গানটা শেষ করি।’
শুরু করে সেদিন এক বসায় গানটি লিখে ফেলেছিলেন হাসান মতিউর রহমান। সকাল ১০টায় মতিঝিলের এজিবি কলোনিতে মলয় কুমার গাঙ্গুলীর বাসায় নিয়ে যান গানটি। হাসান মতিউর রহমান বলেন, ‘আমি ভয়ে ভয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে তাঁকে লেখাটা দিই। বেশ কয়েকবার পড়ে তিনি হারমোনিয়াম নিয়ে বসে পড়লেন সুর করতে।’
স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের শিল্পী মলয় কুমার গাঙ্গুলী এখন থাকেন মিরপুরের পশ্চিম মণিপুরে। নিভৃতচারী। বাসা থেকে খুব একটা বের হন না। প্রথম আলোকে তিনি বললেন, ‘এক বসায় ১৫ মিনিটে গানটি সুর করে ফেলেছিলাম। গানের সুর করতে করতে আমার স্ত্রী, গীতিকার হাসান মতিউর—আমাদের তিনজনের চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি ঝরেছে। পরে আমি ফ্রান্সে গিয়ে একটি অনুষ্ঠানে গানটি গাই। এক বছর পর বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের নামে একটি কলেজের অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) সামনে এই গানটি গাই। তিনিও কেঁদে ফেলেন। এরপর অনেকবার তাঁকে এই গানটি শুনিয়েছি।’
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর মলয় কুমার গাঙ্গুলীর মধ্যে একধরনের তীব্র যন্ত্রণা কাজ করত। তিনি জানালেন, সেই যন্ত্রণারই বহিঃপ্রকাশ এই গান। তিনি বললেন, ‘এই গানটি আমি সুর করেছি এবং আমি নিজে গেয়েছি। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে, একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে জাতির পিতার নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে আমার এই গান প্রতিবাদের ভাষাস্বরূপ প্রতিধ্বনিত হবে।’
১৯৯০ সালে গানটি মলয় কুমার গাঙ্গুলী বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গাইলেও রেকর্ডিং হয়েছে ১৯৯১ সালের শুরুর দিকে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছিল তখন। ওই সময় এই গানের সঙ্গে আরও কিছু গান, বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণসহ ‘জনতার নৌকা’ নামে একটি অ্যালবাম বের হয় হাসান মতিউর রহমানের নিজস্ব প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান চেনা সুর থেকে। এক দিনেই সারা দেশে ছড়িয়ে যায় গানটি।
১৯৯৭ সালে গানটি সাবিনা ইয়াসমীনকে দিয়ে আবার গাওয়ানোর সিদ্ধান্ত নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেবার গানটির সংগীত পরিচালনা করেছিলেন ফরিদ আহমেদ। গানটি নিয়ে সাবিনা ইয়াসমীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই গান আমার হৃদয়ের খুব কাছের। আমি গর্ববোধ করি এটি গাইতে পেরে। এখনো মনে আছে, প্রচুর সাড়া পেয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে করা এই গানে কণ্ঠ দেওয়ার পর। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই গান শুনে প্রশংসা করেছিলেন। আমার সংগীতজীবনের সেরা একটি অর্জন হয়ে আছে “যদি রাত পোহালে শোনা যেত” গানটি।’
কথা প্রসঙ্গে গানের গীতিকার বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচারণা করেন। তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখেছি, তাঁর সঙ্গে হাত মিলিয়েছি। এখনো সেই হাতের স্পর্শ অনুভব করি। মাত্র এক দিন, একমুহূর্তের সে স্মৃতি। ৪৮ বছর আগের কথা, ১৯৭০ সালে। আমি ক্লাস নাইনের ছাত্র। নির্বাচনী প্রচারে গিয়েছিলেন আমাদের থানা দোহারে। আমি ছিলাম স্বেচ্ছাসেবক। তিনি মাঠে ঢোকার সময় হাত বাড়িয়ে দিলাম। আমার হাত ধরে জোরে ঝাঁকুনি দিলেন। সেই স্পর্শ, সেই ঝাঁকুনি আমি এখনো অনুভব করি। কী সুন্দর মানুষ। লম্বা। সাদা পায়জামা আর পাঞ্জাবি, চুল ব্যাক ব্রাশ করা। কাঁচা-পাকা চুল, কালো মোটা ফ্রেমের চশমা।’