পার্থ বড়ুয়ার সংগীতায়োজনে নতুন করে তৈরি ‘যুবতী রাধে’ গানটি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। এই গান নতুন করে গেয়ে প্রশংসিত হয়েছেন চঞ্চল চৌধুরী ও মেহের আফরোজ শাওন। কিন্তু সরলপুর নামের একটি ব্যান্ড এই গানের কপিরাইট তাদের দাবি করার পরই শুরু হয় জটিলতা। আপত্তির মুখে ইউটিউব থেকে সরিয়ে ফেলতে হয়েছে চঞ্চল ও শাওনের গাওয়া গানটি। সরলপুর ব্যান্ড সদস্যদের এমন আচরণে কষ্ট পেয়েছেন চঞ্চল চৌধুরী।
চঞ্চল জানালেন, গান নিয়ে এই ধরনের জটিলতা একেবারেই কাম্য নয়। তিনি বলেন, ‘আমাদের লোকগানের পদরচয়িতা কে বা কারা, তা জানা যায় না। লোকমুখে শুনতে শুনতে একটা পর্যায়ে এসেছে। ঐতিহ্যবাহী পদগুলো আমাদের সংস্কৃতির বিশাল শক্তি। এটাকে আমাদের রক্ষা করতে হবে। চুরি–ডাকাতি করে নিজের দখলে নেওয়া, আমি করেছি কিংবা লিখেছি, এমন ভাব দেখানো মোটেও উচিত না। চাইলেই কোনো মানুষ এই ধরনের পদ লিখতে পারে না! এই ধরনের পদ, একটু কারেকশন করে আমার বলা খুবই অন্যায়। এ রকম অসংখ্য গান, কবিতা ছোটবেলায় প্রচুর শুনেছি। সবার মুখে মুখে ছড়িয়েও আছে। কেউ যদি ব্যক্তিগত ফায়দার জন্য নিজের বলে চালিয়ে দেয়, তাহলে সেটা খুবই দুঃখজনক।’
কপিরাইট নিবন্ধন কর্মকর্তা জাফর রাজা চৌধুরী জানান, সরলপুর ব্যান্ড ‘যুবতী রাধে’ গানটি নিজেদের লেখা, সুর করা ও তৈরি হিসেবে ২০১৮ সালের ৪ জুন কপিরাইট রেজিস্ট্রেশন নেয়। কয়েক মাস পর ২০১৯ সালের ১০ এপ্রিল সুমি মির্জা নামের একজন শিল্পী আপত্তি তুলে বলেন, গানটি ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’–এর ‘যুবতী রাধে’ গানের নকল।
এরপর কয়েকটি শুনানি হয়। তখন সরলপুর ব্যান্ড ২০১২ সালের একটি রেফারেন্স দেয়, যেখানে দেখা যায়, চ্যানেল নাইনের একটি অনুষ্ঠানে তারা গানটি গাওয়ার সময় বলেছে, এই গানের ৩০ পারসেন্ট তাদের সংগ্রহ আর ৭০ পারসেন্ট তাদের রিমেক করা।
কপিরাইটের বিষয়টি তুললে চঞ্চল চৌধুরী বললেন, ‘আইনগতভাবে “যুবতী রাধে” গানের এখন কপিরাইট যেহেতু সরলপুর ব্যান্ডের, এ জন্য তাদের কিন্তু নিজেদের ইউটিউবে আপলোড করার সময় কপিরাইটের বিষয়টি উল্লেখ করা উচিত ছিল। কিন্তু তারা যা করেছে, এটা আশা করিনি। আমরা কেউ কিন্তু জানি না, এই গানের কপিরাইট অন্য কারও। জানি না বিধায় তাদের কৃতজ্ঞতা দেওয়া হয়নি। আর জানবই–বা কী করে, এই গান তো সরলপুর ব্যান্ড নিজেদের ইউটিউবের ক্রেডিট লাইনে কথা ও সুর নিয়ে কিছুই বলেনি।’
এ প্রসঙ্গে আগের দিন প্রথম আলোকে ব্যান্ডের সদস্য মারজিয়া তুরিন বলেন, ‘দ্যাট ওয়াজ আওয়ার মিসটেক। আমরা কখনো ভাবিনি যে গানটি আমরা রিলিজ করার আগে, অ্যালবাম আকারে বের করার আগে এভাবে কেউ করে ফেলবে। আমরা তো আসলে খুব ইয়াং একটা ব্যান্ড। অনেক কিছু জানতাম না। এখন সেগুলোর মাশুল দিচ্ছি আরকি। অনেক কিছু শিখেছি।’
কথায় কথায় চঞ্চল বললেন, ‘বেশি কষ্ট পেয়েছি, আমরা সবাই সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কাজ করছি। তারাও শিল্পী, গান গায়; আমরাও টুকটাক গান করি। আলোচনার মাধ্যমে তাদের ক্রেডিট দেওয়ার প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তারা অসম্মতি জানিয়েছে। এখন তো অবস্থা যা দেখছি, এই ক্রেডিট তাদের মোটেও প্রাপ্তি না। এটা তারা কপিরাইট করিয়েছে, কেমনে করেছে সেটা পরের কথা। ইউটিউব থেকে মুছে না দিয়ে আলোচনায় বসতে পারত।’
কিন্তু সরলপুর ব্যান্ডের সদস্যরা তো বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, গানের লেখা ও সুর করা তাঁদের। এই বিষয়ে আপনি কিছু বলতে চান? ‘এই গানের মোটাদাগের কিছু অংশ বহু বছর আগের। বলতে পারেন, শত বছর আগের। আমার কাছে বহু বছর আগের যে ডকুমেন্ট আছে, তার সঙ্গে এই গানের ৮০ ভাগ মিলে যায়। কিছুদিনের মধ্যে এই গান বিষয়ে আরও অনেক কিছু পরিষ্কার হবে, সময়ের অপেক্ষা শুধু। আমি শখে টুকটাক গান করি।
সবার কাছে অনুরোধ, আমাদের প্রকৃত বাংলা গানের যে ইতিহাস, তা যেন কখনো বিকৃত না হয়। অন্যায়ভাবে লোকগানগুলো অন্য কারও দখলে না যায়, শিল্পীদেরই এ জন্য সচেতন হতে হবে। শিল্পীসমাজেরও এসবের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে’, বললেন চঞ্চল চৌধুরী।
চঞ্চল বলেন, ‘একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে সরলপুর ব্যান্ডের সদস্যরা নিজে মুখে স্বীকার করছে, “যুবতী রাধে” গানের ৩০ ভাগ সংগৃহীত আর সংগৃহীত হলে কপিরাইট হয় কীভাবে? তারা এ–ও পরিষ্কার করে বলুক, কোন অংশ সংগৃহীত, কোন অংশ তাদের লেখা। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, ৭০ ভাগই সংগৃহীত, বাকি ৩০ পার্সেন্ট হয়তো তাদের লেখা। নিজেদের গাওয়ার জন্য গানটি এদিক–সেদিক করছে। তার মানে এই নয় যে মালিকানা তাদের।’
‘আইপিডিসি আমাদের গান’ নামে একটি ইউটিউব চ্যানেলে পার্থ বড়ুয়ার সংগীতায়োজনে ‘যুবতী রাধে’ গানটি প্রকাশিত হয়েছে। ইউটিউবে গানের ক্রেডিট লাইনে লেখা হয়, কথা ও সুর ‘সংগৃহীত’। এতেই বাধে বিপত্তি। গানটি নিজেদের তৈরি করা দাবি করে সরলপুর ব্যান্ড, তাদের কাছে গানটির কপিরাইট সনদও আছে বলে জানায়। একই সঙ্গে অনুমতি ছাড়া তাদের গান প্রকাশের প্রতিবাদ জানায়, ইউটিউব থেকে সরিয়ে নেওয়ার অনুরোধও করে। গান সরিয়ে ক্ষমা না চাইলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান সরলপুর ব্যান্ডের মুখপাত্র এবং লিড গিটারিস্ট মারজিয়া তুরিন।