চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালক হিসেবে আবারও পাওয়া যাবে বাপ্পা মজুমদারকে। ‘ভালোবাসা প্রীতিলতা’ নামের একটি ছবিতে কাজ করছেন তিনি। নতুন গান তৈরির কাজও চলছে। এসব নিয়ে গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় কথা হলো তাঁর সঙ্গে।
‘ভালোবাসা প্রীতিলতা’ নামের এই ছবির সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার পেছনে কোন ভাবনা কাজ করেছে?
কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের উপন্যাস অবলম্বনে সিনেমাটি নির্মিত হচ্ছে। এই ছবির প্রেক্ষাপট ইতিহাসনির্ভর। যেহেতু ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, এই ধরনের কাজ আমি আগে করিনি—আমার মনে হলো নতুন এক অভিজ্ঞতা হবে। চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি, কারণ, ইতিহাসনির্ভর কাজে চ্যালেঞ্জটা একটু বেশি। সেই প্রেক্ষাপট ও সময়ের একটা ছোঁয়া রাখতে চাই। আমি সেভাবেই চেষ্টা করছি। প্রস্তুতিও নিচ্ছি। সেই সময় কী ধরনের গান হতো, তা জানার চেষ্টা করছি এবং প্রয়োগের চেষ্টা করছি।
বর্তমান সময়ের আবহ কি থাকবে না?
তা তো থাকবেই। সমসাময়িক সাউন্ড অ্যারেঞ্জমেন্টে ওই সময়কে যেন ধরতে পারি, সেটাই আসল চেষ্টা। বিষয়টা চ্যালেঞ্জিং কিন্তু আমি করতে চাচ্ছি। এরই মধ্যে দুটি গানের কাজ শেষ হয়েছে। সব মিলিয়ে এই ছবিতে গান থাকবে পাঁচটা। তার মধ্যে দুটি মৌলিক, তিনটি পুরোনো গান নতুন আয়োজনে তৈরি হবে।
আপনার সংগীত পরিচালনায় ‘সত্তা’ ছবিটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে একাধিক বিভাগে পুরস্কৃত হয়েছে। চলচ্চিত্রের গানে সংগীত পরিচালনার অভিজ্ঞতা কেমন?
চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা একটু কষ্টসাধ্য কাজ। তারপরও একটা ছবির সংগীতের সব কাজ একজন করলে ভালো হয়। এতে পুরো সিনেমার মধ্যে একটাই সাউন্ড স্কেচ তৈরি হয়, যা পুরো সিনেমাকে ছন্দে রাখে। একটি সিনেমায় দুই থেকে তিনজন সংগীত পরিচালকের ডিরেকশনে কাজ হলে ধারাবাহিকতা থাকে না।
গানের ক্ষেত্রে প্রতিটি দেশের আলাদা স্বকীয়তা আছে। বর্তমান সময়ে কথা, সুর ও গানের ধরনে আমরা স্বকীয়তা ধরে রাখতে পারছি কি?
সময় ও জীবনযাত্রার সঙ্গে আসলে অনেক কিছু পাল্টে যায়। আমরা যে পারিপার্শ্বিকতার মধ্যে আছি, আমাদের চারপাশে যে ধরনের গান হচ্ছে, যে গানগুলো অনবরত কানের কাছে বাজছে, সেগুলো একধরনের প্রভাব তৈরি করে তো বটেই। কিন্তু বড় কথা হচ্ছে, দায়িত্ববোধ নিয়ে কাজ করে নিজের স্বকীয়তা ধরে রাখা। গড্ডলিকা প্রবাহে গা না ভাসিয়ে নিজের স্বকীয়তা ধরে রাখাটা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তা আমরা কতটুকু করতে পারছি, আমি জানি না। তবে ব্যক্তিগতভাবে এটুকু বলতে পারি, আমি চেষ্টা করি।
সার্বিক অবস্থা নিয়ে জানতে চাচ্ছি...
একটু লক্ষ করলে দেখা যায়, আমাদের সিনেমায় এখন যে গানগুলো হচ্ছে, বেশির ভাগই কলকাতার বাণিজ্যিক সিনেমার গানের আদলে। এটা মোটেও আমাদের প্র্যাকটিসের সঙ্গে যায় না। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে কলকাতার প্র্যাকটিসের সঙ্গেও যায় না। পশ্চিমবঙ্গে যে ধরনের গান আগে হতো, তেমনটা এখন হচ্ছে না। ঠিক তেমনিভাবে আমাদের দেশের সিনেমাতেও আগের মতো গান হচ্ছে না। মূল কারণ, যাঁরা চলচ্চিত্র প্রযোজক, তাঁরা এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছেন। প্রযোজকদের নাক গলানোর একটা বিষয় দেখা যায়। পরিচালকের ভাবনার জায়গা বদলে যায়। ‘ওই ধরনের গান’ বানাতে প্রযোজকের কাছ থেকে একটা চাপ থাকে। এতে আমাদের নিজস্বতা কমে যায়। যাঁরা প্রযোজনা করেন, তাঁদের সাহিত্য সম্পর্কে জ্ঞানও অতটা থাকে না, এটা বড় একটা অন্তরায়।
এভাবে পরিচালকের হাত থেকে ক্ষমতা চলে গেলে তিনি কি আসলে পরিচালনা করতে পারেন?
সত্যি তা–ই। এই কারণে পরিচালনায়ও একধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। কারণ, তিনি যা করতে চাচ্ছেন, শেষ পর্যন্ত তা পারেন না। সিনেমায় অর্থলগ্নির একটা বিষয় থাকে, তাই চলচ্চিত্র পরিচালনার সঙ্গে যাঁরা থাকেন, তাঁরা ক্ষেত্রবিশেষে আপস করেন।
বিশ্বসংগীতের যে ট্রেন্ড চলছে, সে অনুযায়ী আমরা কতটা এগিয়ে যেতে পারছি?
আমাদের দেশে অনেক ভালো গান হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, সেই ভালো গানগুলোকে সামনে আনা হয় না। ভালো গানগুলো আসলে এগিয়ে নিতে হয়, এগিয়ে দিতে হয়। শ্রোতার সামনে পরিবেশন করতে হয়। খারাপটা পরিবেশন করতে হয় না। ভালোর জন্য নানাভাবে মানুষকে বলতে হয়, এটা নাও, ওটা নাও। ভালোর প্রচারও বেশি হওয়া উচিত। ভালো গান, ভালো শিল্পী, ভালো নাটক, ভালো সিনেমার প্রচারণা বেশি হওয়া দরকার। যা ভালো নয়, ‘ভালো নয়’ বলতে ভালো নয়ই বলতে চাইছি, অর্থাৎ যে কাজগুলো আমাদের বোধ ও সংস্কৃতির সঙ্গে যায় না, সেই ধরনের কাজের প্রচার ও প্রসার ইদানীং একটু বেশি।
করণীয় কী?
আমাদের বুঝতে হবে—এটা সবার দায়িত্ব। সংবাদমাধ্যমের দায়িত্ব অনেক বেশি। দর্শক–শ্রোতারও ভূমিকা আছে। দর্শকেরা ভালো কাজ সামনে এলেও গ্রহণ করছেন না। সস্তা প্রযোজনার দিকে যাচ্ছেন। যাঁরা ভালো কাজ করছেন, তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা করছি না, আর যাঁরা খারাপ কাজ করছেন, তাঁদের বাধা দিচ্ছি না।
গানের কপিরাইট নিয়ে মাঝেমধ্যে কিছু অস্থিরতার খবর শোনা যায়। এই সংকট নিরসনে উপায় কী?
প্রথমত, একজন শিল্পী, গীতিকার ও সুরকারকে তাঁর কাজের ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। সবকিছুর আগে তাঁর কাজটা কপিরাইট করতে হবে। মাথার মধ্যে কোনো ভাবনা এলেই তা কপিরাইট করে ফেলা উচিত। কপিরাইট করলে সৃজনশীল কাজ সুরক্ষিত হয়। অস্থিরতার প্রধান কারণ, আমরা কেউ কাউকে শ্রদ্ধা করছি না। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ যদি না থাকে, তাহলে বড় বিপদ। আমার যদি কারও সঙ্গে যুদ্ধ লাগিয়ে দেওয়া কিংবা ঝগড়া করার মানসিকতা থাকে, যেকোনো ইস্যুতে তা করতে পারি। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকলে আলোচনার মাধ্যমে অনেক বড় সমস্যারও সমাধান সম্ভব। সমস্যাগুলো করোনা মহামারিতে বেড়েছে বেশি। কারণ, এই করোনায় স্বাভাবিকভাবে মানুষের আয় কমে গেছে। জীবনও কেমন যেন অনিশ্চিত হয়ে গেছে। জিনিসপত্রের দাম কিন্তু মোটেও কমেনি। যে আগে ২০ হাজার টাকা ভাড়া দিত, তাঁর এর অর্ধেক দিতেও কষ্ট হচ্ছে। পুরো ব্যাপারটা চক্রাকারে আবদ্ধ।
সংগীতাঙ্গনে কাছাকাছি সময়ে অনেকগুলো সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। এত সংগঠন দিয়ে গানের অঙ্গন কতটা উপকৃত বা সমৃদ্ধ হবে বলে মনে করছেন?
সংগঠনগুলো হওয়া উচিত ছিল আরও অনেক আগে। ঠিক একই বিষয়ে বলতে চাই, আমাদের যদি পারস্পরিক শ্রদ্ধা না থাকে, একে অপরকে যদি ভালোবাসতে না পারি, তাহলে সংগঠন করেও সমস্যার কোনো সমাধান হবে না। সংগঠন করে একে অপরকে শ্রদ্ধা না করলে, যুদ্ধংদেহী মনোভাব তৈরি হবে আরও বেশি। আমরা সংগঠন কেন করি, সবাই যেন একটাই কণ্ঠস্বর হয়। কারণ, সমবেতভাবে কথা বললে, তার অন্য রকম আবেদন তৈরি হয়। তাই সবারই একত্রিত হওয়া উচিত। সংগঠন যেহেতু হয়েছে, সবার যেহেতু চাওয়া সংগীতাঙ্গনের উন্নতি—তাই সবাই মিলে আরও বড় একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা উচিত।
সিনেমার কাজের বাইরে শ্রোতারা আপনার কাছ থেকে নতুন গান পাবে কবে?
বেশ কয়েকটি গান তৈরি করা আছে। পর্যায়ক্রমে সেগুলো প্রকাশ পাবে আমার ইউটিউব চ্যানেলে।