‘শরীরের গাছে পাঁচখানি ডাল/চঞ্চল মনে ঢুকে পড়ে কাল’ বাংলা ভাষার প্রাচীনতম কাব্য সংকলন ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’-এ সংকলিত কবি লুইপাদের কবিতার আধুনিক অনুবাদ এটি। অনুবাদ হলেও হুট করে নতুন কারও পক্ষে বুঝতে কষ্টই হবে। কিন্তু শনিবার সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটারে যখন এটি গান আকারে গাওয়া হলো, তখন সমবেতরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনলেন। বেশির ভাগ শ্রোতার কাছে নতুন অভিজ্ঞতা ছিল আয়োজনটি।
শ্রোতাদের যেমন অভিজ্ঞতা যেমন নতুন ছিল, আয়োজনটিও অভিনব। অপরিসর মঞ্চের চারদিকে প্রদীপের টিমটিম আলো ভিন্ন আবহ তৈরি করেছিল মিলনায়তনটিতে। মাঝে ধবধবে সাদা পোশাকের ১৬জন শিল্পী। কারও কারও হাতে দোতারা,একতারা, ডুগডুগিসহ দেশীয় বাদ্যযন্ত্র। এক তারা হাতে মাঝে দাঁড়িয়ে গাইলেন বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগের একমাত্র নিদর্শন ‘চর্যাপদ’। বাংলা ভাষাকে নতুন করে অনুবাদ করে, গ্রাম বাংলার সহজিয়া সুরকে ধারণ করে চর্যাপদের পদগুলোকে গীতলরূপে উপস্থাপনের এ আয়োজনটি ছিল ভাবনগর ফাউন্ডেশনের।
আজ শনিবার শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার স্টুডিও থিয়েটার হলে ‘চর্যাগানের পুনর্জাগরণ’ শিরোনামের এ আয়োজনে চর্যাগানের পাশাপাশি ছিল নৃত্যও। অনুষ্ঠানে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত প্রাচীন চর্যার ৫০টি পদের সমকালীন বাংলা রূপান্তরিত গীত বাণী সংগীত আকারে উপস্থাপন করা হয়। যা পরিকল্পনা, গবেষণা, প্রাচীন চর্যার সমকালীন বাংলা রূপান্তর ও গ্রন্থনা করেছেন সাইমন জাকারিয়া।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই ছিল চর্যাপদের প্রথম পদ ‘কাআ তরুবর’ গানের পরিবেশনা। এ গানটির সুরারোপিত হয়েছে ভাওয়াইয়া গানের ঢঙে। দ্বিতীয় পরিবেশনা ছিল ‘নাও বয়ে যায় গঙ্গা-যমুনায় হায়’। তৃতীয় পরিবেশনা ছিল কাহ্নপা রচিত বিবাহ বিষয়ক রূপক পদ ‘জয় জয় ধ্বনি’।
গানের মাঝে মাঝে ছিল কথন। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে মুখ্য আলোচক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ। আর বক্তব্য দেন কবি অসীম সাহা, কবি ও রাজনীতিবিদ নূহ-উল-আলম লেনিন প্রমুখ। স্বাগত বক্তব্য দেন শিল্পকলা একাডেমির সংগীত, নৃত্য ও আবৃত্তি বিভাগের পরিচালক সোহরাব উদ্দীন।
সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, চর্যার এসব গানে চিরায়ত বাংলা গানের সুর ব্যবহার করা হয়েছে। চর্যাপদের ভাষা অনেকের বোধগম্য নয়। চর্যাপদের গানগুলো সহজ ভাষায় অনূদিত হলে এবং ভাব ঠিক থাকলে এই রূপান্তর ভালোই হয়।
ড. আনিসুজ্জামান বলেন, চর্যাপদের পদগুলোতে আদিতে রাগ-রাগিণীর উল্লেখ ছিল। সেসব রাগের অনেকগুলো এখনো লুপ্ত হয়ে যায়নি। সেসব রাগ অনুযায়ী গানগুলোকে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। চর্যাপদের আলাদা উচ্চারণরীতি ছিল, সেই উচ্চারণ রীতিও অনুসরণ করা যেতো। এ ছাড়া পদগুলো সহজ বাংলায় রূপান্তরিত করলেই সবাই যে বুঝতে পারবে তা নয়, কারণ এসব পদ রূপক।
চর্যাপদের পদগুলোতে নতুন ভাষা ও সুরারোপ প্রসঙ্গে অধ্যাপক সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ বলেন, চর্যার সুরারোপ ও ভাষা আরও মূলানুগ করতে পারল ভালো ছিল। নেপালের রাজদরবারে চর্যাপদের যে পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত ছিল, এখন সেটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। চর্যাপদের পাণ্ডুলিপি উদ্ধারের জন্য বাংলাদেশেরও উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত।
নূহ-উল-আলম লেনিন বলেন, আজ শুধু চর্যাপদ আবিষ্কারের শতবর্ষ নয়, বুদ্ধপূর্ণিমাও। বৌদ্ধ ধর্মীয় সাধনা যেহেতু বৌদ্ধ ধর্মের মূল উপজীব্য, ফলে আজ এই পরিবেশনা খুব প্রাসঙ্গিক। এই গানগুলোর সুর ও উচ্চারণ যদি মূলানুগ হতো, তবে আরও উপভোগ্য হতো।
চর্যাগানে অংশ নেন শাহ আলম দেওয়ান, অন্তর সরকার, সরদার হীরক রাজা, রবীউল হক, মোবারক হোসেন, জসীম উদ্দীন, সরদার শাহাদাত হোসাইন, ফারজানা আলম লীনা, নাদিরা ইসলাম, ফারুক নূরী ও রাশিদুজ্জামান। অতিথি শিল্পী ছিলেন গবেষক সাইম রানা। তাদের কণ্ঠে গীত হয় ‘শরীর গাছে পাঁচখানি ডাল’, ‘এ ভব নদী গম্ভীর বেগে’, ‘মোহে কেটে যেই লাগাই তিনটি পাট’, ‘হাওয়া-দমে পথ বন্ধ কেন হয়’, ‘আলিঙ্গন দাও যোগিনী গো তুমি’, ‘কাছিম দুয়ে পাত্রে না ধরা যায়’, ‘সহজ মহাতরু স্ফুরিত এ ত্রিলোক’, ‘শূণ্যে শূন্যে যখন মিলিত’, ‘আপনাতে নেই আপনা আমার’সহ চর্যাপদের প্রায় প্রতিটি পদই। অনুষ্ঠানে চর্যানৃত্য পরিবেশন করেন ওয়ার্দা রিহাব।