বল বীর—
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!
বাংলা একাডেমির কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে প্রবেশ করতেই পঙ্ক্তিগুলো শোনা গেল। চেনা কবিতা। তবে পরিবেশনাটা অভিনব। কেননা নারী কণ্ঠে কবিতাটা আনুষ্ঠানিক কোনো আয়োজনে তেমন শোনা যায়নি। অনুষ্ঠানে আসা কয়েকজন এমনটাই বলছিলেন। নজরুলজয়ন্তীর আয়োজনের সুর গেঁথে গেল এই কবিতার চমৎকার পরিবেশনা দিয়ে।
আজ রোববার দুপুরে বাংলা একাডেমি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২০ তম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন করে নজরুলবিষয়ক একক বক্তৃতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। অনুষ্ঠানের শুরুতে কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা আবৃত্তি করেন ডালিয়া আহমেদ। পিনপতন নীরবতায় পুরো কবিতাটি শোনালেন তিনি। দর্শকের অভিনন্দন পান যথেষ্ট। পরে নজরুলসংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী ইয়াসমিন মুশতারী। শোনালেন ‘আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন’ গানটি।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী। ‘নজরুলের প্রাসঙ্গিকতা’ শীর্ষক একক বক্তৃতা দেন অধ্যাপক সৌমিত্র শেখর। সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। সভাপতির বক্তব্যে তিনি বলেন, প্রত্যেক বড় সাহিত্যিকের রচনার মধ্যে চিরন্তনতা এবং সমকালীনতা—এই দুই বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকে। নজরুলের রচনায়ও আমরা প্রবল সমসাময়িকতা এবং চিরকালীনতা খুঁজে পাই। তাঁর কালজয়ী রচনায় যেসব মানবিক সমস্যার কথা উঠে এসেছে সে সবের অনেক কিছু এখনো বিরাজমান থাকায় নজরুলের প্রাসঙ্গিকতা আরও বিশেষভাবে অনুভূত হয়।
অধ্যাপক সৌমিত্র শেখর বলেন, নজরুল আধুনিকতার মধ্যে বাস্তবতা ও প্রত্যক্ষতার সম্মিলন ঘটানো কবি। এটি তাঁর আগে আর কেউ করেননি, এমনকি রবীন্দ্রনাথও নন। এ যুগের কবিকুল, বিশেষ করে একবিংশ শতাব্দীর কবিরা শব্দ নিয়ে যে জাদুকরি খেলায় মত্ত, নজরুলের চেতনা এখানে যে কার্যকর, সেটা ভাবাই যায়। আধুনিক পঞ্চকবিদের আগেই যিনি সূচনাটা করলেন এবং যাঁকে অনুসরণ করছেন উত্তর-আধুনিক কবিকুল, তাঁর ‘আধুনিকতা’ নিয়ে তাই প্রশ্ন তোলা অবান্তর।
নজরুলকে কেবল ‘বিদ্রোহী’ কবিতা-নির্ভর একজন কবি হিসেবে ব্যাখ্যা করার প্রবণতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে—মন্তব্য করে প্রাবন্ধিক বলেন, কারণ তাঁর সামগ্রিকতা আরও বিচিত্র, ব্যাপক ও বর্ণাঢ্য। তিনি শাস্ত্রের ঊর্ধ্বে উঠে মানব সুন্দরের গান গেয়েছেন। রক্ষণশীল সমাজের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে নারী-পুরুষ সম্পর্ককে তাঁর রচনায় দিয়েছেন ভিন্নতর উদার ব্যঞ্জনা। তাঁর সামগ্রিক সৃষ্টি নন্দনে ‘আমি’র রূপকে মূলত সমষ্টি মানুষের অকথিত বাণী ব্যক্ত হয়েছে। প্রচলিত রাজনৈতিক ডামাডোলে বসবাস করেও তিনি রাজনীতিতে নিজস্ব বিপ্লবী, সমন্বয়বাদী চিন্তাধারার প্রকাশ ঘটিয়েছেন অসমসাহসে। তিনি বলেন, আজকের সাম্প্রদায়িক চিন্তায় কলুষিত বিশ্বে চির প্রাসঙ্গিক, অসাম্প্রদায়িক নজরুলের অগ্রন্থিত লেখা দ্রুত উদ্ধার করে তাঁর রচনাবলি পূর্ণাঙ্গ করা যেমন জরুরি, তার চেয়ে বেশি জরুরি নজরুল-চিন্তার আলোকে আমাদের সমাজ-রাষ্ট্র ও বিশ্বের মানবিক রূপান্তর সম্পন্ন করা। তিনি বলেন, এই সৃষ্টিজগতে বিরাজিত আছে এক অনিঃশেষ কাম-ভাবনা। এটা যৌনতা নয়, সৃষ্টির এষণা। সৃষ্টির এষণা আছে বলেই পৃথিবী সুন্দর এবং চলমান। এটি বন্ধ হয়ে গেলে পৃথিবী থমকে যাবে। দার্শনিক এই গূঢ় সত্য নজরুল ঠিকই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন এবং তাই তিনি তাঁর লেখায় বারবার নারী-পুরুষের সম্মিলিত সত্তাকে ভারতীয় চিরায়ত অনুভাবনার আলোকে তুলে ধরেছেন এবং ইংরেজ ভিক্টোরীয় মূল্যবোধকে অস্বীকার করেছেন। এই নন্দনতত্ত্ব নতুনভাবে চর্চিত হচ্ছে উত্তর-আধুনিক লেখকদের মধ্যে। নজরুলে আছে এর আধার। নজরুল দুঃখকে জয় করা এক প্রবল পুরুষ। তবে তিনি দুঃখের সাগরে সাম্পান নিয়ে সাফল্যের মুক্তো খুঁজেছেন। তাঁর প্রাসঙ্গিকতা কখনো ফুরোবার নয়। কাল যতই অতিক্রান্ত হচ্ছে, তাঁর কালোত্তর প্রাসঙ্গিকতা ততই নিবিড় করে অনুভূত হচ্ছে।