বেতের ভয়ে গেয়েছিলাম গুরুর গান!

আজম খান
আজম খান

স্কুলে পড়ার সময় আমাদের বাসা ছিল আজিমপুরে। উঁচু দেয়ালঘেরা। আম-জাম-কাঁঠালগাছ বাড়ির ভেতর, দেয়াল ঘেঁষে। জামগাছটা আমার সবচেয়ে প্রিয়। বিশাল গাছ। পাকা কালো জাম থোকা থোকা। দুপুরে আব্বা-আম্মার ঘুমের সুযোগে গাছে উঠে জাম পেড়ে খাচ্ছি আর পা ঝুলিয়ে আজম খানের গানটা গাইছি ‘আ-লা-লো দুলাল, আ-লা-লো দুলাল, তাদের বা-বা, হা-জি চা-ন; চানখাঁর পুলে প্যাডেল মেরে পৌঁছে বাড়ি’! হাতে জমানো জামের বিচিগুলো ফেলে আকাশে মুখ তুলে চিৎকার করে চালিয়ে যাচ্ছি ‘আলাল যদি ডাইনে যায়, দুলাল যায় বামে!’ গাছের নিচ দিয়ে যাচ্ছিলেন কেমিস্ট্রির জুনায়েদ স্যার। বিচিগুলো পড়েছে ওনার ওপর! খেয়াল করিনি। হুংকার ছেড়ে চড় দেখিয়ে বললেন, ‘অই জামচোরা। কাইলকে স্কুলে আয়। দেখামু তর আলাল কত্ত সিয়ানা আর দুলালের বাপ কেডা!’ ভয়ে মুখ শুকিয়ে গেল। এর আগে টেস্টে কেমিস্ট্রিতে পেয়েছি ১০০ তে ২৪! ফেল মার্ক!

আজম খান

পরদিন স্কুলে টিচারস রুমে ডাকালেন জুনায়েদ স্যার। তাঁর পাশে আরও তিন স্যার। জুনায়েদ স্যারের হাতে আমার চেয়ে লম্বা এক বেত। বললেন, ‘কাইলকা যেই গানটা গাইতেসিলি আজম খানের, অইটা আবার গাইয়া শুনা। নাইলে বেত দিয়া বাইড়াইয়া হাড্ডি ভাইঙ্গা দিমু!’ এ অবস্থায় আপনি বিপদে পড়বেন। সামনে বেত ঘুরছে, সেটা থেকে বাঁচতে আপনাকে গান গাইতে হচ্ছে। মার থেকে বাঁচতে হবে। আজম খান সেজে গেলাম। হাতটা মাইক ধরার মতো উঁচু করে টিচারস রুমে স্টেজ পারফরম্যান্সের মতো নেচে-নেচে গাইছি, ‘আলাল যদি ডালে থাকে, দুলাল থাকে চালে, পাড়াটা রে জ্বালায় তারা সারা দিন ভরে-এ-এ-!’ তুষ্ট হলেন জুনায়েদ স্যারসহ অন্য স্যারেরা। আদর করে কাছে ডাকলেন। বললেন, ‘তর গলা ব্যাঙের মতো হইলেও স্টাইলটা ভালো। তুই গান গাইস না, ফুটবলই খেলিস। যা, ক্লাসে যা।’ জুনায়েদ স্যার জানতেন, আমি ফুটবল খেলি। আজম খানের পাগলা ভক্ত ছিলেন জুনায়েদ স্যার।

কে ছিল না? গত শতকের শেষ তিন দশকে এ দেশে একঝাঁক পপ গায়ক মাতিয়ে দিয়েছিলেন সারা দেশ। আজম খান, ফেরদৌস ওয়াহিদ, ফিরোজ সাঁই, লাকি আখান্দ, হ্যাপি আখান্দ, ফকির আলমগীর। সবার ছিল আলাদা স্টাইল। কিন্তু বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পপসম্রাট হিসেবে স্বীকৃত আজম খান। তরুণ জেনারেশনের ‘গুরু’!

আজম খান

‘ওরে সালেকা, ওরে মালেকা’ থেকে ‘অভিমানী, তুমি কোথায় হারিয়ে গেছ’—সব গানই ছিল তাঁর জনপ্রিয়। আজম খানই বাংলাদেশের একমাত্র পুরুষ গায়ক, যাঁর স্টেজ পারফরম্যান্স দেখতে কিশোর-তরুণেরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতেন। পুরুষ বললাম এ জন্য যে, কিশোর-তরুণেরা আবেদনময়ী গায়িকাদের দিকে একটু বেশি ঝুঁকে থাকেন। আজম খান ব্যতিক্রম। শুধু গান না, তাঁকে দেখার জন্যও অনেকে বসে থাকতেন। অথচ দেখতে ছিলেন আমেরিকার ওয়েস্টার্ন গানহ্যান্ডেড কাউবয়দের মতো। রাফ অ্যান্ড টাফ। আমেরিকায় জন্মালে হলিউডের কোনো ডিরেক্টর তাঁকে ওয়েস্টার্ন মুভির অফার দিতেন, আমি শিওর।

আজম খান তরুণদের মধ্যে কতটা জনপ্রিয় ছিলেন, তা একটা ঘটনা বললেই পরিষ্কার হবে। মতিঝিল এজিবি কলোনিতে পোলাপাইনেরা গুরু আজম খানের কনসার্টের আয়োজন করেছে। আমার বন্ধু বান্টি তাদের একজন। আরামবাগে গেছি এক কাজে। বান্টির সঙ্গে দেখা। বাইকে বসা বান্টির মুখ কালো। বললাম, ‘কী রে? তগো না গুরুর কনসার্ট চলতাসে?’ অভিমানী গলায় বলল, ‘চলতাসে কই? গুরু বাইরই হইতাসে না।’ বললাম, ‘মানে?’ বলল, ‘দুই ঘণ্টা হইয়া গেল, গুরুর নাকি মুডই আসে না। মুড আসলে বাইর হইব।’ যেন সুন্দরবনে বাঘ দেখতে গেছে সবাই, কখন বাঘ বের হয়, তার অপেক্ষায়। বললাম, ‘তুই গিয়া অবস্থান নে। যখন-তখন বাইর হইতে পারে।’ বলল, ‘অইটা বুঝমু।’ বলা মাত্রই বুঝে গেলাম। তুমুল হইহল্লাড় আওয়াজ আসতে লাগল। মুহূর্তে চেঞ্জ বান্টি। বলল, ‘যাই রে দোস্ত, বাইর হইসে, তুই চইলা আহিস!’ বাইক ঘুরিয়ে বান্টি দিল টান। দূর থেকে ড্রাম-গিটারের শব্দ আসছে। উন্মাদনার চিৎকার! বুঝলাম, বাঘ দেখা গেছে।

আজম খান

বাংলাদেশে এমন সুরের লিজেন্ড আর আসেনি। তিনি গবেষক ছিলেন না, ছিলেন হৃদয়ের গায়ক। নিরহংকার, সাধারণ জীবনযাপন, নির্লোভ। ওটাই হয়তো হয়েছে গুরুর কাল।

একটা দেশের লিজেন্ড গায়ক, বব মার্লে বা জন লেননের চেয়ে কোনো অংশে গুণেমানে কম না, অথচ শেষ জীবনে যা প্রাপ্য, তাঁকে আমরা তা দিতে ব্যর্থ হয়েছি। হয়েছি বললে ভুল হবে, আমরা ব্যর্থ হই। আর সেটা শিল্পী-সাহিত্যিক হলে তো কথাই নেই। এই প্রজন্মের কয়জন ছেলেমেয়ে জানে যে, তাদের একজন বিশ্বমানের লিজেন্ড গায়ক ছিলেন, যাঁর নাম আজম খান? নতুন প্রজন্ম কি এখন চান খাঁর পুল চিনে? অথবা সালেকা-মালেকা?

ফেরদৌস ওয়াহিদ ও ফকির আলমগীরের সঙ্গে আজম খান

বাই দ্য ওয়ে, আজিমপুরের বাসার জামগাছে যাঁর গান গেয়ে টিচারের মাইরের ফাঁদে পড়েছিলাম, সেই আজিমপুরেই কিন্তু তাঁর জন্ম। আর যে কেমিস্ট্রির জুনায়েদ স্যার আমাকে আজম খানের গান দিয়ে টিচারস রুম জমিয়েছিলেন, তাঁর স্নেহেই আমি কেমিস্ট্রিতে স্কুলের ফেল মার্ক থেকে এসএসসিতে লেটার মার্ক পেয়েছিলাম!

আজ গুরু আজম খানের মৃত্যুবার্ষিকী। কিংবদন্তির এই মহাপ্রয়াণের দিনে সবাই কি তাঁর জন্য দোয়া করবেন?

পপসম্রাট বেঁচে আছেন আমাদের হৃদয়ে! বেঁচে থাকবেন। থাকতেই হবে!