বিয়ের দিনেও স্টুডিওতে ছুটে গিয়েছিলেন এন্ড্রু কিশোর

বিয়ের দিন এন্ড্রু কিশোর। ছবি: সংগৃহীত
বিয়ের দিন এন্ড্রু কিশোর। ছবি: সংগৃহীত

নিজের শহরে ফিরতে চেয়েছিলেন এন্ড্রু কিশোর। ফিরেছেন। সে ফেরা শেষ ফেরা। গতকাল সোমবার রাতে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের হিমঘরে ঘুমিয়েছেন। শেষ ঘুম। অপেক্ষা দুই সন্তানের। ছেলে জে এন্ড্রু সপ্তক ও মেয়ে মিনিম এন্ড্রু সংজ্ঞা অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরলে আনুষ্ঠানিকতা। শেষযাত্রা রাজশাহী শহরে খ্রিষ্টান কবরস্থানে, মা–বাবার কবরের পাশে হবে এন্ড্রু কিশোর শেষ ঠিকানা। যাওয়ার আগে যিনি রেখে গেলেন অসংখ্য গান। একটা জীবন কাটিয়ে গেলেন শুধু গানে গানে।

এই রাজশাহী শহর থেকেই সাধারণ এন্ড্রু কিশোর হয়েছেন দারুণ জনপ্রিয় অসাধারণ এক গায়ক। গায়কিতে, মায়াবী কণ্ঠে তিনি শীর্ষে পৌছে ছিলেন। শ্মশ্রুমণ্ডিত এই প্লেব্যাক জাদুকরের গান গেয়ে দেশে নানা প্রজন্মের গায়ক জনপ্রিয় হয়েছেন। গান ছাড়া মানুষটা জীবনে আর তেমন কিছু করেননি। যেন শুধু গানেরই জন্য দুনিয়াতে এসেছিলেন তিনি। বাংলাদেশে এমন পেশাদার কণ্ঠশিল্পী দ্বিতীয়জন আছে কি না, সে ব্যাপারে প্রশ্ন থেকে যায়।

এ কথা সহজেই বলা যায়, এন্ড্রু কিশোরের পেশা ও নেশা দুটোই ছিল গান। গান গাওয়া ছাড়া অন্যদিকে মনোযোগ দেননি। মূলত চলচ্চিত্রের গানেই ছিল তাঁর মূল দখল। বাংলা চলচ্চিত্র, বিশেষ করে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্প তাঁর কাছে ঋণী থাকবে। অবাক হলেও সত্যি, মানুষটা বিয়ের দিনেও চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিয়েছেন স্টুডিওতে গিয়ে। প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নিজেই এ কথা বলেছেন তিনি।

তখন সবে এন্ড্রু কিশোর উঠতি তারকা। সেদিনের স্মৃতিচারণা করে এন্ড্রু কিশোর বলেছিলেন, ‘বিয়ের দিন যে গান করব, এমন পরিকল্পনায় ছিল না। হয়ে গেছে। সেদিন আমি নিজেই অভ্যর্থনাকারী। সব দায়িত্ব আমাকে নিতে হয়েছে। এর কারণ, বিয়েতে যাঁরা আমন্ত্রিত, তাঁদের কাউকেই আমার মা–বাবা কিংবা একমাত্র বড় বোন চেনেন না। এ কারণে সবকিছু দেখভাল করতে করতে রাত একটা বেজে গেল। এর মধ্যে বিয়ের আসরেই সংগীত পরিচালক আলী হোসেন আমাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলে গেলেন, সকালে রেকর্ডিং মনে থাকে যেন। প্রথমে গুরুত্ব দিইনি। ভেবেছিলাম দুষ্টামি করছেন। কারণ, উনি জানতেন আমি কতটা গানপাগল। কিন্তু রাত ফুরিয়ে সকালেই সত্যি সত্যি তিনি ফোন করে ডন স্টুডিওতে চলে আসতে বললেন। তখনো আমি বিছানায়। হুড়মুড় করে উঠে গেলাম। চোখ ডলতে ডলতে ছুটলাম।’
শুধু এটা না, গানের জন্য বাসা থেকে অসময়ে বেরিয়ে যাওয়া বা না থাকার ঘটনা জীবনে অনেকবার হয়েছে। ছেলের প্রথম জন্মদিনে তিনি ছিলেন আমেরিকায়। দ্বিতীয় জন্মদিনের দিন স্টুডিওতে। তাই বলে সংসারজীবনে যে মনোযোগী ছিলেন না, তা নয়। অবশ্য সংসার দেখভালের কাজটি মূলত তাঁর স্ত্রীই করতেন।

সংগঠন, রাজনীতি, সভা, সমিতি—এসবে খুব একটা দেখা যেত না তাঁকে। এন্ড্রু কিশোর নিজেই বলেছেন, ‘আমি জীবনকে সব সময় কাছ থেকে দেখার চেষ্টা করি। জীবনের সুখ, শান্তি সূক্ষ্মভাবে দেখার চেষ্টা করি। খুব ক্ষুদ্র আকারে চিন্তা করি। বউ, বাচ্চা আর ঘরেই সীমাবদ্ধ আমার চিন্তা। আমাকে এ ব্যাপারে স্বার্থপর বলা যায়। আমি আমার মধ্যেই সুখী।’

দুই সন্তান যখন ছোট ছিল। ছবি: সংগৃহীত

সংগীতজগতে পুরোদস্তুর পেশাদার মনোভাব নিয়ে চলতেন এন্ড্রু কিশোর। এ জগতের সঙ্গে পরিবারকে মেলাননি। আবার নিজেও গান গাওয়ার পাশাপাশি সমসাময়িক অনেকের মতো গান লেখা বা সুর করার দিকে কখনো মনোযোগ দেননি। এ প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আসলে আমি নিজেকে এত প্রতিভাবান মনে করি না। কথা কিংবা সুরের ওপর আমার এতটা জ্ঞান আমার আছে বলে মনে করি না। আমার জ্ঞান শুধু গায়কিতে। গাইতে পারি। তাই আমি গীতিকার কিংবা সুরকারের ব্যাপারে মাথা ঘামাই না। এটা পেশাদারির মধ্যেও পড়ে। আর আমি চাই, একটা অ্যালবামে সব ধরনের সুরকার বা গীতিকারের গান থাকা উচিত। তাহলে সব শ্রেণির শ্রোতার কাছে পৌঁছানো যাবে।’

প্রায় ১৫ হাজার গানে কণ্ঠ দেওয়া এই শিল্পী আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। বললেও বাড়াবাড়ি হবে না, তাঁর গাওয়া গান বছরের পর বছর টিকে থাকবে এই বাংলায়। শুধু ব্যক্তি এন্ড্রু কিশোরকে পাওয়া যাবে না কোনো আয়োজনে, প্রয়োজনে। টানা ১০ মাস ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করে গতকাল সোমবার সন্ধ্যা ৬টা ৫৫ মিনিটে রাজশাহীতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন এন্ড্রু কিশোর। গতকাল রাত সাড়ে নয়টায় এন্ড্রু কিশোরের মরদেহ মহিষবাথান থেকে নগরীর লক্ষ্মীপুরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হিমঘরে নেওয়া হয়। তখনো লাশবাহী গাড়ির পেছনে ছিল ভক্ত ও আত্মীয়স্বজনের শোকের ‘মিছিল’। শিল্পীর এক ছেলে জে এন্ড্রু সপ্তক ও এক মেয়ে মিনিম এন্ড্রু সংজ্ঞা থাকেন অস্ট্রেলিয়ায়। তাঁরা দেশে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। টিকিট মিললেই চলে আসবেন দেশে। তাঁরা ফিরলেই এন্ড্রুর শেষকৃত্য হবে। শিল্পীকে সমাধিস্থ করা হবে নগরীর শ্রীরামপুর এলাকায়।