২৫ বছর আগে প্রকাশিত হয় সংগীতশিল্পী মনির খানের প্রথম অডিও অ্যালবাম ‘তোমার কোনো দোষ নেই’। মিলটন খন্দকারের কথা ও সুরে এটি প্রকাশ করে বিউটি কর্নার। ২০১৮ সাল পর্যন্ত তাঁর ৪৩টি একক এবং তিন শতাধিক দ্বৈত ও মিশ্র গানের অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম অ্যালবাম প্রকাশের ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে আজ ঢাকার কেন্দ্রীয় কচি-কাঁচার মেলা ভবন মিলনায়তনে মনির খান সংসদ, মনির খান ফ্যানস ক্লাব টোয়েন্টি ফোর ও মনির খান সংঘ ‘নেপথ্যের নায়ক’ শিরোনামে সম্মাননা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। এসব নিয়ে গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় কথা হলো তাঁর সঙ্গে।
২৫ বছর আগের কিছু মনে পড়ছে?
আমি কখনোই এই মনির খান ছিলাম না। মিলটন খন্দকার আমাকে ২৫ বছর আগে মনির খান হতে সুযোগ করে দিয়েছিলেন। আমি হয়ে ওঠার পেছনে আরও অনেকেরই অবদান আছে। যে ছেলেটি আমাকে ভালোবেসে স্টুডিওতে মাইক্রোফোন এগিয়ে দিয়েছে, চা এনে দিয়েছে, ক্ষুধা লাগলে দূর থেকে খাবার এনে দিয়েছে, নিরলস ভালোবাসা, স্বার্থহীন ভালোবাসা দিয়েছে; যেসব ছেলে ক্যাসেটের কার্টন নিয়ে বিভিন্ন দোকানে গিয়েছে, আমার অ্যালবামের পোস্টার লাগিয়েছে; রাজশাহী, দিনাজপুর, বাগেরহাট, চট্টগ্রাম, খুলনার বিভিন্ন ক্যাসেটের দোকানে গিয়ে ব্যবসায়িক খবর নিয়েছে—কালকের (আজ) অনুষ্ঠানে নেপথ্যের তেমন ১৬ জন নায়ককে সম্মান জানাতে চাই।
অডিও অ্যালবাম হিসেবে আপনার ২৫ বছর, তার কত আগে আপনি গানের জগতে এসেছেন?
১৯৯১ সালে আমার ঢাকায় আসা। গানের হাতেখড়ি ১৯৮৭ সালে, তখন থেকে ওস্তাদের কাছে তালিম নেওয়া শুরু।
এ বছরের জুলাইয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপে বলেছিলেন, কৃষিভিত্তিক চিন্তাভাবনা করছেন। সেটার অগ্রগতি কত দূর?
অনেক দূর। এরই মধ্যে মাল্টা, কমলা, পেয়ারার চাষাবাদ শুরু হয়েছে। মাঝেমধ্যে গাজীপুর গিয়ে পরিচর্যা করে আসি। পানি, ওষুধ ও সার নিয়মিত দিচ্ছি। সবকিছু সুন্দরভাবে এগোচ্ছে। এ বছর অনেক বৃষ্টি হলো, সে কারণে মাছের প্রকল্পটা শুরু করতে পারিনি। সবকিছুই মোটামুটি তৈরি, কিছুদিনের মধ্যে তা শুরু করে ফেলব।
আপনার ছেলেমেয়ে দুজনেই আপনার গান পছন্দ করেন। তাঁদের কাউকে পেশাদার সংগীতশিল্পী হিসেবে পাওয়া যাবে?
গান পছন্দ করে, কিন্তু গাইতে চায় না। আমার অগোচরে গায়। আমার গানের ভিউ বাড়তে দেখলে দুই ভাই-বোন খুব আনন্দ পায়। সকাল-বিকেল-রাতে কত ভিউ হয়েছে, জানায়। আমাকে খুবই উৎসাহ দেয়। ওরা এখন পড়াশোনা করছে। আমার বাবা একটা কথা বলতেন, যে যেদিকে যেতে চায়, সেটাকেই প্রাধান্য দিতে। বাবা বলতেন, ‘তুমি যখন মাঠে-ঘাটে-হাটে-নদীতে চিৎকার করে গান গাইতে, আমি ভাবতাম, এটা তোমাকে হয়তো টানে। তাই আমিও তোমাকে গানে দেখতে চেয়েছি।’ পিতা–মাতার চোখ সন্তানদের ভবিষ্যৎ দেখে। আমিও কিছুদিন পর হয়তো বুঝব কোন দিকে গেলে বাচ্চাদের জীবন সার্থক হবে। এটা সম্পূর্ণ তাদের স্বাধীনতা।
পিতা হিসেবে আপনার চোখ কি দেখছে?
আমি তো চাই তাঁরা প্রথমত ভালো মানুষ হয়ে গড়ে উঠুক। পিতা–মাতার শান্তির প্রতীক হলো সন্তানেরা, যদি তারা সুস্থ সন্তান হয়। আমাদের চিন্তা আছে, পড়াশোনার জন্য দুই সন্তানকে দেশের বাইরে পাঠাব। তারপর তাঁরা চাকরিবাকরি বা ব্যবসা-বাণিজ্য, যা-ই করার করুক।
সংগীতজীবনে আপনার অনেক অর্জন, কোনো অপূর্ণতা আছে?
প্রাপ্তির তো আসলে শেষ নেই। মানুষ বাঁচে আশায়। বাংলাদেশের সংগীতজগৎ নিয়ে ইদানীং একটা প্রশ্নের সম্মুখীন প্রায়ই হতে হয়, আগের মতো আর গান হচ্ছে না। যা হচ্ছে, তা মেশিনগান; প্রাণজুড়ানো ব্যাপার সেই অর্থে নেই। এ থেকে উত্তরণের জন্য মিলটন ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ করেছি। একটা মিউজিক ইনস্টিটিউট করার কথা ভাবছি। আমাদের চিন্তাভাবনা অনেক দূর এগিয়েছে। এখানে দেশের প্রতিভাবান ও ইচ্ছাশক্তি থাকা তরুণেরা গানের তালিম নিতে পারবে। ওস্তাদদের সান্নিধ্য পাবে।
২৫ বছরে অনেক শিল্পীর সঙ্গে গেয়েছেন। এর মধ্যে কোন শিল্পীর সঙ্গে আপনার কণ্ঠ বেশি মানিয়ে যেত বলতে শুনতেন?
সিনেমাতে দ্বৈত গান বেশি করা হয়েছে। এর মধ্যে কনক আপার সঙ্গে দ্বৈত গান সবচেয়ে বেশি। তাঁর সঙ্গে গাইতে খুবই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। তিনি নিজেও খুব হেল্পফুল একজন মানুষ। গান গাইতে গেলে, কোথাও আটকে গেলে, বড় বোনের মতো দেখিয়ে দেন। আমাদের অনেকগুলো গান শ্রোতাদের পছন্দের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। সাবিনা আপার সঙ্গেও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। তিনি আমাকে ভীষণ আদর করেন। একটা গল্প বলতে চাই। একবার আলী চাচার (আলাউদ্দিন আলী) একটা গান গাইতে গিয়ে একটা জায়গায় এমনভাবে আটকে গেলাম, কোনোভাবে উতরে যেতে পারছিলাম না। চাচা বারবার ধমক দিচ্ছিলেন। তখন সাবিনা আপা বললেন, ‘আলী ভাই, বকা দিয়েন না। এ রকম ঘটনা আমাদের জীবনেও ঘটছে। আপনি বরং ১০ মিনিট ব্রেক দেন। আমি ওর সঙ্গে চা খাই। আমি-আপনিই তো শিখিয়ে দিতে হবে।’ সাবিনা আপা আমার কাছে এসে গায়ে হাত বুলিয়ে বললেন, ‘তুই একদমই চিন্তা করিস না। এটা একেবারেই সহজ জিনিস। এইভাবে তুই গা, দেখবি হয়ে গেছে।’ বিশ্বাস করবেন না, এরপর সাবিনা আপা আমাকে বুঝিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে দিলেন। কী এক ম্যাজিক কাজ করল, এক টেকে গান ওকে করেছি। এই ধরনের সহযোগিতা সবার কাছ থেকে পেয়েছি। কেউ আমাকে কখনো চুল পরিমাণ অসহযোগিতা করেনি।
আপনি অনেকেরই প্রিয় শিল্পী। আপনাদের প্রিয় শিল্পী কারা?
আমাকে একজন ওস্তাদ বলেছিলেন, ‘তুমি যদি ভালো কিছু করতে চাও, তাহলে বেশি বেশি শোনো। যত শুনবে, ততই তুমি ভালো করবে।’ শোনার বিষয়টা আমি মানি। সবার গানই শুনি। অনেকেই হয়তো মন খারাপ করবে, কিন্তু মানুষের ব্যক্তিগত পছন্দও তো থাকে। আমি পাগলের মতো ভক্ত কিশোর কুমারের, তিনি প্রাণখোলা একজন গায়ক।
নব্বইয়ের দশকে আপনারা যখন শুরু করলেন, তখন একটা অন্য রকম প্রতিযোগিতা হতো। আপনাদের ওই সময়ের তুলনায় এখন কি সংগীতাঙ্গন এগিয়েছে, নাকি পিছিয়েছে?
আমি তো বলব অবশ্যই পিছিয়েছে। আগেও বলেছি, আমরা প্রতিনিয়ত প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছি, আগের মতো গান হচ্ছে না। আমি বলতে চাই, সবাই সময়ের পেছনে দৌড়াতে গিয়ে সৃষ্টির পেছনে দৌড়ানো ভুলে গেছি। যুক্তরাষ্ট্রে কী হচ্ছে, লন্ডনে কী হচ্ছে, কোন রকশিল্পী কী করছে, আর আমি কার পায়ে পা দিয়ে এগিয়ে যেতে পারব; কীভাবে দ্রুত নামধাম হবে; কীভাবে পরিচিতি লাভ করব—এসব শর্টকাট উপায় ভাবি। কিন্তু সবাইকে বুঝতে হবে, সংগীত গুরুমুখী বিদ্যা। পুঁথিগত বিদ্যার গুরুত্বও এখানে আছে কিন্তু আমরা মোটেও ওস্তাদের কাছে যাচ্ছি না। ভালো গানের জন্য ছুটছি না। এগিয়ে যাওয়ার কোনো কারণ নেই।
এগোলে কোন কোন ক্ষেত্রে, পিছিয়ে থাকলে কোন কোন ক্ষেত্রে? উন্নতি না হলে কী করা উচিত?
সবচেয়ে বড় কথা, যাঁরা যোগ্য, যাঁরা গুণী, যাঁরা বাংলাদেশের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারবেন, তাঁদের নিয়ে কাজ করতে হবে। আর এখন যে ‘বাবু খাইছ’, এই ধরনের গান যদি ভাইরাল হয়, এ দেশের সংগীতের, সংস্কৃতির, সমাজের উন্নতি কোনো দিনই হওয়া সম্ভব নয়। ‘বাবু খাইছ’ ধরনের গান প্রচারে সেন্সরবোর্ড বসানো দরকার। সরকারি তদারকি দরকার। সমাজকে নষ্ট করার জন্য এই ধরনের গানের প্রচারণাও বন্ধ করতে হবে।