নিপীড়িত আর খেটে খাওয়া মানুষের জন্য গান গেয়ে সারা বিশ্বে পরিচিতি পেয়েছিলেন বব মার্লে
নিপীড়িত আর খেটে খাওয়া মানুষের জন্য গান গেয়ে সারা বিশ্বে পরিচিতি পেয়েছিলেন বব মার্লে

গান যাঁর প্রতিবাদের ভাষা, ভালোবাসতেন ফুটবল

গানের জগতে এক জনপ্রিয় নাম বব মার্লে। যিনি একজন সুরকার, গীতিকার, কণ্ঠশিল্পী ও গীটারবাদক, প্রযোজক। যাঁর গানের মূল কথা ছিল ‘মনুষ্যত্ব’ বা ‘মানুষ’। মানবতার কথা, সামাজিক ন্যায় আর সুবিচারের কথা বলেছেন আজীবন। বব মার্লের গানে ছিল অবহেলিত আর বঞ্চিত মানুষের অধিকার, বর্ণবাদী প্রথার বিরোধিতা। নিপীড়িত আর খেটে খাওয়া মানুষের জন্য গান গেয়ে সারা বিশ্বে পরিচিতি পেয়েছিলেন। গানে জনগণের নানা ক্ষোভ ও সমস্যার কথা বলে মন জয় করেছিলেন অসংখ্য তরুণের। তাঁর গানে এমন কিছু ছিল, যা শ্রোতাদের দুঃখ-কষ্ট ভুলিয়ে দিয়ে সুরের তালে নেচে উঠতে বাধ্য করত। জ্যামাইকান এই শিল্পী বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিয়েছেন গানও হতে পারে প্রতিবাদের ভাষা। অনেকেই মনে করেন, তিনি তৃতীয় বিশ্ব থেকে উঠে আসা প্রথম সুপারস্টার।

তাঁর গানে এমন কিছু ছিল, যা শ্রোতাদের দুঃখ-কষ্ট ভুলিয়ে দিয়ে সুরের তালে নেচে উঠতে বাধ্য কর

‘বাফেলো সোলজার ইন দ্য হার্ট অব আমেরিকা’ গানটি আজও যেমন জনপ্রিয়, তেমনই এর স্রষ্টা বব মার্লে সংগীতভুবনের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।
১৯৪৫ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি জ্যামাইকার সেইন্ট এ্যানের নাইন মাইলের এক বস্তিতে জন্মগ্রহণ করেন মার্লে। পারিবারিক নাম রবার্ট নেসটা মার্লে।

তার জন্মের সময় দেশটিজুড়ে সব ক্ষেত্রেই অস্থিরতা চলছিল। শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ বিভেদের কারণে সংঘাতও ছিল নিয়মিত ঘটনা। কৃষ্ণাঙ্গ মা ও শ্বেতাঙ্গ বাবার কারণে ছোটবেলা থেকেই তিনি সাদা-কালো দ্বন্দ্বে ভুগতেন। মার্লে সব সময় কৃষ্ণাঙ্গদের পক্ষে, মানবতার পক্ষে গান গাইতেন। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে কালোদের ওপর চলতে থাকা বর্ণবাদী নির্যাতনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন তিনি গানের কথায় ও সুরের মাধ্যমে। রাজনৈতিক আগ্রাসনের প্রতিবাদও করেছেন মার্লে এই গানের মাধ্যমে। অধিকারবঞ্চিত মানুষের পক্ষ নিয়ে তিনি সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করতেন গানের মাধ্যমে।

গানের জগতে এক জনপ্রিয় নাম বব মার্লে

তৃতীয় বিশ্ব থেকে উঠে আসে রকস্টার বব মার্লের অনবদ্য সৃষ্টি ‘নো ওম্যান, নো ক্রাই’, ‘গেট আপ স্ট্যান্ড আপ’, ‘বাফেলো সোলজার’, ‘ওয়ান লাভ’, ‘ব্ল্যাক প্রগ্রেস’ দখল করে নিয়েছে সবার মন। এই গানের মাধ্যমে একত্র হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে থাকতে বলতেন। গানে গানে বলতেন ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে বব মার্লে গানকে ব্যবহার করলেও মানুষকে উজ্জীবিত করতে তাঁর কিছু বিখ্যাত উক্তিও ছিল।

‘ওঠো, দাঁড়াও, দাঁড়াও তোমার অধিকারের জন্য’, ‘কেউ না, আমাদের মানসিকতাকে আমরাই মুক্তি দিতে পারি’, ‘তোমার স্বপ্নগুলোর কবর দিওনা, দাঁড়াও, যুদ্ধকরো, বাঁচো’।
তিনি ফুটবল খেলতে ভালোবাসতেন।

তিনি ফুটবল খেলতে ভালোবাসতেন।

তাঁর একটি উক্তি ছিল, ‘ফুটবল স্বাধীনতা, একটি পুরো বিশ্ব। আমি এটা খেলতে ভালোবাসি। কারণ, ফুটবল খেলতে অনেক দক্ষ হতে হয়।’ তিনি যেকোনো চুক্তি করার সময় শর্ত দিতেন, তিনি যখনই চাইবেন তখনই যেন ফুটবল খেলা যায়, এ রকম ব্যবস্থা রাখতে। আর ফুটবল খেলাই তাঁর কাল হলো। ১৯৭৭ সালে ফুটবল খেলতে গিয়ে ডান পায়ের বুড়ো আঙুলে হালকা আঘাত পেয়ে বসেন তিনি। আঙুলের ক্ষতটি না শুকিয়ে আরও বাড়তে থাকে। চিকিৎসক পরীক্ষা করে সেটা ক্যানসার হিসেবে শনাক্ত করেন। তবে তাঁর অসুস্থতার খবর সাধারণ মানুষকে জানতে না দিয়েই তিনি তাঁর কাজ চালিয়ে যেতে থাকলেন। ১৯৭৯ সালে একটি সফল ইউরোপ সফরের পরপরই জ্যামাইকায় তিনি প্রকাশ করেন ‘সারভাইভাল’ শিরোনামের একটি অ্যালবামও।

১৯৮০ সালে সফলতার চূড়ায় থাকা ওই সময়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে সফর শুরু করেন এবং ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে তিনি দুটি শো করেন। নিউইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্কে জগিং করতে করতে পড়ে গেলে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার আগেই শনাক্ত হওয়া ক্যানসার মস্তিষ্কসহ সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি মিয়ামির একটি হাসপাতালে ১৯৮১ সালের আজকের দিনে অর্থাৎ ১১ মে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে থেমে যায় মার্লের কণ্ঠ।

মার্লে সব সময় কৃষ্ণাঙ্গদের পক্ষে, মানবতার পক্ষে গান গাইতেন

সারা জীবন তিনি ছিলেন সংগ্রামী এক শিল্পী। জীবনঘনিষ্ঠ গান গাইতেন বলে তিনি পেয়েছেন আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা। ‘বব মার্লে অ্যান্ড দ্য ওয়েইলার্স’ অ্যালবামকে ১৯৯৯ সালে ‘বিশ শতকের সেরা অ্যালবাম’ নির্বাচিত করে টাইম ম্যাগাজিন। ‘গেট আপ অ্যান্ড স্ট্যান্ড আপ’ ষাট ও সত্তরের দশকে বিভিন্ন দেশে উত্তাল জাতীয়তাবাদী ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনে বিদ্রোহী মানুষের বুকে সাহস জুগিয়েছে এ গান। এরপর অনেক বছর পার হয়ে গেল। এখনো গণমানুষের কাছে তিনি পরিচিত নাম, গানের ভূবনে কিংবদন্তি শিল্পী।

অধিকারবঞ্চিত মানুষের পক্ষ নিয়ে তিনি সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করতেন গানের মাধ্যমে