জ্যেষ্ঠ শিল্পী থেকে তরুণ প্রজন্মের তারকা শিল্পী—প্রতিষ্ঠিত সব সংগীত প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বর্তমানে তাঁদের গান প্রকাশের হার একেবারেই কম। শিল্পীদের অনেকেই তাই গড়ে তুলেছেন স্বাধীন প্ল্যাটফর্ম। ইউটিউবে ধীরে ধীরে সাবস্ক্রাইবার ও ফেসবুকে ফলোয়ার বাড়ায় শিল্পীরা প্রযোজক হিসেবে শক্ত অবস্থান তৈরি করে নিচ্ছেন দিনে দিনে। এসব প্ল্যাটফর্ম থেকে তাঁরা নিয়মিত নতুন গান প্রকাশ করছেন। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের ব্যানারেও গান প্রকাশে দেখা যায় তাঁদের, তবে তা কদাচিৎ। এদিকে বেশির ভাগ সংগীত প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান এখন নাটক বানানোয় বেশি মনোযোগী। তাদের অনেকেরই বক্তব্য এমন, গানের চাহিদা কম, তাই নাটকের ফাঁকে গান প্রকাশ করছে তারা।
তবে সংগীতাঙ্গনের শিল্পী ও কলাকুশলীদের বক্তব্য, এসব শুধুই অজুহাত। গান শোনা ছাড়া মানুষ কখনোই থাকতে পারেন না। গানের চাহিদা আগের চেয়ে আরও বেড়েছে। নাটকের ভেতরে একটি বা দুটি করে গান প্রকাশ প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের দায় এড়ানো ছাড়া কিছুই নয়, মনে করছেন শিল্পীরা।
দেশের একাধিক সংগীত প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখন যেসব গান বের হয়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ব্যাপারই বেশি প্রাধান্য থাকে। অনেকটা এ রকম কথাও শোনা যায়, তাঁদের (সিনিয়রদের) গান তো এখন আর ‘খায়’ না! অথচ বাস্তবতা ঠিক উল্টো, বরেণ্য শিল্পীদের গান শোনার জন্য এই সময়ের শ্রোতারাও যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন, তা ফেসবুক কিংবা ইউটিউবের মন্ত্যব্যের ঘরে চোখ বোলালেই জানা যায়।
মাইলস ব্যান্ডের অন্যতম সদস্য শাফিন আহমেদের মতে, পৃথিবীব্যাপী সবাই নিউ মিডিয়ার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর বেশিরভাগ শিল্পীই স্বাধীনভাবে কাজ করতে শুরু করেন। সেটার ছোঁয়াও বাংলাদেশে লাগছে। শাফিন আহমেদ বললেন, ‘ডিজিটাল যুগে যেভাবে গান রিলিজ করতে হয়, সেই পদ্ধতিতে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের খুব একটা প্রয়োজন হচ্ছেও না। আগে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের একটা বড় ইনভেস্টমেন্টের বিষয়ও ছিল, ওটা ছিল শিল্পীর নাগালের বাইরে। ডিজিটাল যুগে সবকিছু নিজে নিজে করা সম্ভব।’
তবে শিল্পীরা স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষেত্রে আরেকটা কারণের কথা বললেন শাফিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আগে আমরা কিন্তু অনেকেই প্রভাবিত হয়েছি। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে বলা হতো, মার্কেটে এই গান চলে, এই গান তো চলে না, আপনি এই ধরনের গান করেন, ওই রকম গান করেন। চাপিয়ে দেওয়ার একটা প্রবণতা ছিল। শিল্পীরা অনেক ক্ষেত্রে পছন্দের গান করতে পারত না। অনেকেই তা ফেস করেছে।’
কথা প্রসঙ্গে কয়েকজন শিল্পী জানালেন, ২০০৬ সাল থেকে ধীরে ধীরে নিউ মিডিয়ার সঙ্গে পরিচিত হতে শুরু করেন অনেকে। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানও বুঝতে পারে, পরিবর্তন কিছু একটা হচ্ছে। এরপর তাদের কাছে থাকা শিল্পীদের শত শত গান অনুমতি ছাড়াই একসঙ্গে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে তুলে দিল। শিল্পী, গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালকের সঙ্গে দ্বন্দ্ব শুরু হলো। এখন এটাকে ব্যালান্স করার চেষ্টা চলছে। শিল্পীরাও বুঝতে পেরেছেন তাঁদের অধিকার কী। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানও বুঝতে পেরেছে, ওভাবে কাজ করা ঠিক হয়নি।
সংগীতশিল্পী কুমার বিশ্বজিৎও চার দশক ধরে গানের জগতে আছেন। অডিও, সিডি হয়ে ইউটিউবে এখনো নিয়মিত গান প্রকাশ করে চলেছেন। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানবিমুখের কারণ হিসেবে এই শিল্পী বললেন, ‘আমরা তো একটা সময় অ্যালবামের জন্য গান তৈরি করেছিলাম। সেটা থেকে ডিজিটাল মাধ্যম আসার পর শিল্পীদের সঙ্গে রিকন্ট্রাক্টও করেনি। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে আমাদের সৃষ্টিশীল কাজের আয়ের হিসাব দিচ্ছিল না। একটা সময় এ–ও মনে হয়, আমার নিজের তৈরি গানগুলো যদি দলিল আকারেও রাখতে হয়, তাহলে নিজস্ব প্ল্যাটফর্ম ছাড়া তো উপায় নেই। আমরা তখন তো শুধু ক্যাসেটের জন্য বাধ্য ছিলাম। সিডি করা, অনলাইনে মুক্তি দেওয়া, অন্য সময়ে হয়তো লিরিক ভিডিও আকারে দেওয়া, সিনিয়র শিল্পীদের গান অনুমতি ছাড়া নতুন প্রজন্মকে দিয়ে গাইয়ে ছেড়ে দেওয়া—এসবের কারণে অনেক তারকা শিল্পী কোম্পানির সঙ্গে গান প্রকাশে বিরত থাকতে শুরু করে।’
দেশের অডিও মাধ্যমের ব্যবসাসফল শিল্পী আসিফ আকবর। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সাউন্ডটেকের ব্যানারে প্রকাশিত তাঁর প্রথম অ্যালবাম সুপারহিট। আসিফ বললেন, ‘যখন আমি সাউন্ডটেক থেকে গান প্রকাশ করছি, হঠাৎ ভাবলাম, এই যে এত এত গান প্রকাশ করছি, এসবের সঙ্গে আমার ভবিষ্যতের কোনো স্বপ্ন নেই। আজকে আমি গান গাইছি, হিট আছি, কালকে আমার এ অবস্থা হয়তো থাকবে না। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেখেছি—দেশের গান, নজরুলসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত, লোকসংগীত, এক্সপেরিন্টাল গান প্রোমোট করে না। তারা ব্যবসা ছাড়া কিছুই বোঝে না। সিনিয়র শিল্পীদের গান প্রকাশের ক্ষেত্রেও তাদের নানা অনীহা। তাদের ভাবনাটা এমন, যে ফর্মে আছে, তারে নিয়ে দৌড়াও। যে ফর্মে নেই, তারে অবজ্ঞা করো। আমার মনে হলো, শিল্পীদের উচিত প্রত্যেককে একজন করে প্রডিউসার হওয়া। তাই আমি ২০০৮ সালে আর্ব এন্টারটেনইমেন্ট চালু করলাম। আমার নিজের মালিকানায় সাড়ে ৩০০ গান প্রকাশ করেছি। প্রত্যেক শিল্পীকে বলছি, নিজের ইচ্ছেমতো গান বানাও। ভবিষ্যতে কাজে দেবে।’ সামিনা চৌধুরী জানালেন, ‘ভালো মানের গান, পছন্দের গানের পৃষ্ঠপোষকতা করত না। এতে শিল্পীদের একরকম মানসিক টর্চার করত। এটা কিন্তু সত্যি কথাই। মানহীন গানকে প্রাধান্য দিয়েছে।’
মনের মতো গান করা, আয়ের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও স্বাধীনভাবে কাজ করার জন্য শিল্পীরা ধীরে ধীরে নিজেদের মতো করে প্ল্যাটফর্ম চালু করেন। স্বাধীন প্ল্যাটফর্মের সুফল এরই মধ্যে অনেক তরুণ ও জ্যেষ্ঠ শিল্পী ভোগ করা শুরু করেছেন। ভবিষ্যতে যে শিল্পী স্বাধীনভাবে কাজ করবেন, নিজের প্ল্যাটফর্ম শক্তিশালী করবেন, তাঁরাই নিজেদের সৃজনশীল কর্মে অর্থনৈতিকভাবেও রাজত্ব করবেন, এমনটাই মনে করছেন সংগীতাঙ্গনের অনেকে।