বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব ২০১৭

চোখ থাকবে যাঁদের দিকে

মেঘ সরে গেছে বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের আকাশ থেকে। এখন ঝকঝকে রোদ্দুর। আগামীকালই শুরু হচ্ছে এ উৎসব। সামনের পাঁচ রাত সুরমূর্ছনায় অবগাহন করবেন সংগীতপ্রেমীরা।

সুরের আকাশের শুকতারা যাঁরা, তাঁরা আসছেন এবারও। আছেন ঢাকার মঞ্চে নতুন, এমন শিল্পীরাও। তাঁদেরই মধ্য থেকে কয়েকজনের কথা বলছি আজ। চোখ-কান খোলা রাখুন, পরিবেশনার সময় খেয়াল রাখুন এই মুখগুলোকে। এঁরা নিজ নিজ ভুবনে এক একটি উজ্জ্বল প্রদীপ।
প্রথমেই বলি ড. এল সুব্রামানিয়ামের কথা। ভারতের বেহালা সাম্রাজ্যে তিনি মুকুটহীন সম্রাট। ইতালির অষ্টাদশ শতাব্দীর সেরা বেহালাবাদক নিকোলো পাগানিনির সঙ্গেই তুলনা করা হচ্ছে সুব্রামানিয়ামকে। বলা হচ্ছে ‘ভারতের বেহালার ঈশ্বর’। তাঁর এক একটি পরিবেশনা দর্শক-শ্রোতার মনে সুরের যে রেশ ছড়িয়ে দেয়, তার অনুরণন চলতে থাকে অনেকটা সময়জুড়ে। তিনিই একমাত্র শিল্পী, যিনি দক্ষিণ ভারতীয় উচ্চাঙ্গসংগীত, পশ্চিমা ধ্রুপদি সংগীত বাজিয়ে চলেছেন। রেকর্ডিং করেছেন ইয়েহুদি মেনুহিন, স্টেফান গ্রাপ্পেল্লি, স্টিভ ওয়ান্ডার, জঁ পিয়ের, রামপালসহ বিশ্ব উচ্চাঙ্গসংগীত জগতের তাবড় তাবড় তারকার সঙ্গে।
এল সুব্রামানিয়াম ব্যক্তিজীবনে সফল সংগীতশিল্পী কবিতা কৃষ্ণমূর্তির স্বামী। তাঁর বেহালার সঙ্গে এবারই প্রথম আসছে পুরোদস্তুর এক অর্কেস্ট্রা। আস্তানা সিম্ফনি ফিলহারমনি অর্কেস্ট্রার সঙ্গে সময়টা কাটবে ভালো। দৃষ্টিটা রাখুন তাঁর দিকে। উৎসবের প্রথম দিনই তাঁকে শুনতে পাবেন।
ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক পদ্মবিভূষণপ্রাপ্ত শিল্পী পণ্ডিত যশরাজ এবারই প্রথম আসছেন ঢাকার উচ্চাঙ্গ আসরে। পৃথিবীর জন্য পণ্ডিত যশরাজ ভারতের অন্যতম সেরা উপহার। অন্য বড় শিল্পীরা সরোদ বা সেতারের মতো যন্ত্রে ঢেলে দেন মন। যশরাজের ঈশ্বর-প্রদত্ত যন্ত্র হলো তাঁর কণ্ঠ। কণ্ঠসংগীতকে তিনি এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, যা শোনার পর বিস্ময় জাগে মনে।
চার পুরুষ ধরে যশরাজেরা সংগীতে নিমগ্ন। চার বছর বয়সে বাবা মতিরামকে হারান। এরপর শেখেন বড় ভাই মনিরামের কাছে। দারিদ্র্যের কারণে তবলা বাজাতেন শুরুতে। এরই মধ্যে একসময় বেগম আখতারের গান শুনে মোহিত হয়ে পড়েন। ছেড়ে দেন পড়ালেখা। গানের প্রতি প্রণত হন।
কোন কনসার্টে কী গান গাইবেন, তা আগেভাগে ঠিক করে রাখেন না জীবন্ত কিংবদন্তি যশরাজ। যেখানে গাইতে যান, সেখানে সময় ও বাতাসের মধ্যে যে সুর খেলা করে, সেই সুরকে নিজের করে নিয়ে তিনি গান পরিবেশন করেন। যশরাজের কণ্ঠের গান শোনার জন্য ব্যাকুল মানুষ পৃথিবীর আনাচকানাচে ছড়ানো। উৎসবের চতুর্থ দিন তিনি পরিবেশন করবেন খেয়াল।
বিদ্বান বিক্কু বিনায়করামের কথাও বলতে হয়। বিক্কু বিনায়করাম বাজান ঘটম (এটা একধরনের পট)। গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড জয় করেছেন তিনি। তিনি পদ্মশ্রী পদক লাভ করেছেন। এরপর সংগীত নাটক একাডেমির ফেলো হয়েছেন, যা পরিবেশনা শিল্পের জন্য সর্বোচ্চ অর্জন। পদ্মভূষণ লাভ করেন এরপর।
১৩ বছর বয়সে বিক্কু বিনায়করাম শুরু করেন শিল্পী হিসেবে তাঁর পথচলা। কর্ণাটকের বেশ কয়েকজন সেরা কণ্ঠশিল্পীর সঙ্গে তিনি ঘটম বাজিয়েছেন। ১৯৭০ সালে তিনি আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিতি পান, যখন জন ম্যাকলাফলিন ও জাকির হোসেনের ‘শক্তি’র সঙ্গে যুক্ত হন। উৎসবের তৃতীয় দিনে শোনা যাবে তাঁর ঘটমের ঘনঘটা। সঙ্গে থাকবেন ছেলে সালভাগণেশ।
কলা রামনাথের হাতে ভালো খোলে ভারতের উচ্চাঙ্গসংগীতের বেহালাবাদন। মেওয়াতি ঘরানার শিল্পী তিনি। তিনি রাষ্ট্রীয় কুমার গৌরব সম্মান ও পণ্ডিত যশরাজ গৌরব পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁর বাবা টি এন মণি ভারতীয় চলচ্চিত্রজগতের পরিচিত সংগীতকার।
মাত্র আড়াই বছর বয়সে দাদা বিদ্বান নারায়ণ লায়ারের কাছে তাঁর বেহালা ও কণ্ঠসংগীতে হাতেখড়ি হয়। বেহালাবাদক হিসেবে তিনি পরিবারে সপ্তম প্রজন্ম। ওস্তাদ জাকির হোসেন তাঁর বেহালাকে ফুফু (পিসি) ড. এন রাজমের বেহালার সঙ্গে তুলনা করেন। জাকির হোসেন বলেছিলেন, অন্যরা কেন একটি অনুলিপিকে শুনবে, যখন আসলটিই সামনে আছে। এ জন্য কলা রামনাথ পরে পণ্ডিত যশরাজের কাছে দীক্ষা নেন। বলা হয়ে থাকে, কলা রামনাথের বেহালার সুর কণ্ঠনিঃসৃত গানের মাদকতা ছড়ায়। তিনি বাজাবেন উৎসবের তৃতীয় দিন।
মোহনবীণা শোনা যাবে পণ্ডিত বিশ্বমোহন ভাটের কাছে। মোহনবীণার দুটি ধরন, তার একটির উদ্ভাবক বিশ্বমোহন। হাওয়াইন গিটারের আধুনিক রূপ তাঁর মোহনবীণা। আরেক ধরনের মোহনবীণা তৈরি করেছিলেন পণ্ডিত রাধিকা মোহন মিত্র, যা সরোদ থেকে অনুপ্রাণিত।
কিংবদন্তি বিশ্বমোহন গ্র্যামি জয় করেছেন। নানা ধরনের ফিউশন করে নাম কুড়িয়েছেন তিনি। আন্তসাংস্কৃতিক যোগসূত্র গড়েছেন পশ্চিমা সংগীতের সঙ্গে। তিনি যুগ্মভাবে কাজ করেছেন বেলা ফ্লেক, জেরি ডগলাস প্রমুখের সঙ্গে। এরিক ক্ল্যাপটনের প্রণোদনায় গিটার উৎসবে বাজিয়ে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। উৎসবের শেষ দিন তিনি মঞ্চে উঠবেন।
এ ছাড়া এই উৎসবে থাকবে ওস্তাদ রশিদ খান, পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী, উলহাস কাশালকার, কৈবল্যকুমার গুরভ ও বিদুষী পদ্মা তালওয়ালকারের খেয়াল পরিবেশনা। সন্তুর বাজাবেন পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা। সেতার বাজাবেন পণ্ডিত বুধাদিত্য মুখোপাধ্যায়, কুশল দাস ও ওস্তাদ শহিদ পারভেজ খান। পণ্ডিত তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার বাজাবেন সরোদ। থাকবে সুজাতা মহাপাত্রের ওডিশি নাচ। উৎসব শেষ হবে পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার বাঁশি দিয়ে।