চলচ্চিত্রে খুব একটা মনছোঁয়া গান তৈরি হচ্ছে না, এমন অভিযোগ সংগীতাঙ্গনে। অস্থিরতা, মিডিয়ার পরিবর্তন, ইন্ডাস্ট্রিতে মনন ও সৃজনশীলতার অভাবকে দায়ী করছেন প্লেব্যাক সংগীতের গুণী শিল্পীরা। তবে পরিবর্তনশীল এই সময়ে চলচ্চিত্রের সংগীত নিয়ে আশাবাদী এই সময়ের তরুণ সংগীতশিল্পীরা।
বাংলা প্লেব্যাকে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের অবদান অনেক। একাধারে চলচ্চিত্র পরিচালক, সংগীত পরিচালক, গীতিকার ও সুরকার তিনি। তিনি বলেন, ‘একটা কথা আছে, পুরোনো জিনিসের পরিবর্তন হবে। নতুন জিনিস আসবে। কিন্তু সে পরিবর্তনটা কতটা গ্রহণযোগ্য, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের বর্তমান চলচ্চিত্রের গানগুলো কি আগের মতো মন ছুঁয়ে যাচ্ছে? গানের ক্ষেত্রে সেই পরিবেশটা সম্পূর্ণভাবে নেই। এখনকার শিল্পীরা খারাপ গাইছেন, খারাপ সুর করছেন, এখানে গান গাওয়ার পরিবেশ নেই—এ কথাগুলো নিজেদের রক্ষা করার জন্য বলি। আসলে নিজেদের চিন্তা–চেতনার অযোগ্যতাকে আমরা মানতে প্রস্তুত নই। গান এমন একটা জিনিস, এটা পড়লেও যেন কবিতা মনে হয়, গাইলেও যেন মনে হয় ছন্দময়। এবং তার আবেগটা দীর্ঘস্থায়ী হতে হয়।’
গান মন ছুঁয়ে না যাওয়ার কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের ধৈর্যশক্তি কমে গেছে। দ্বিতীয়ত, দূরের বাদ্য শুনতে বেশি ভালোবাসি। যা আমার না, আমার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে মেলে না, তেমনি সুর কথা গানে ঢুকে পড়ছে। কিছুক্ষণ শুনলাম, তারপর আর মনে থাকল না। গান হারিয়ে যাওয়ার পেছনে কারণ হলো, গান এখন আর বাড়িতে আসছে না। আগে গানের রেকর্ড বিক্রি করত। বাড়িতে একটা গ্রামোফোন রেকর্ড আসা সাংঘাতিক ব্যাপার ছিল। সেই আনন্দটাকে তিনি আশপাশের সব লোকের সঙ্গে ভাগাভাগি করতেন। গান জীবনযাপনের অংশ হয়ে গিয়েছিল। এখন সেই গান নিয়ে মায়ের কাছে, বোনের কাছে গাওয়া যায় না। মেয়েকে শোনানো যায় না। বাজে কথার সংমিশ্রণ এসে গেছে সেখানে। সুরের আমেজ হারিয়ে যা খুশি তা–ই করা হচ্ছে।’
প্লেব্যাকে ৫০ বছর পার করেছেন বর্ষীয়ান সংগীতশিল্পী খুরশীদ আলম। তিনি বলেন, ‘এখন যারা আসছে, তাদের মধ্যে অনেকেই মেধাবী। অসুবিধা হলো, এখন সব জায়গাতেই অস্থিরতা বেড়ে গেছে। তা ঢুকে গেছে গানের মধ্যেও। এখন ইচ্ছা থাকলেও বাসায় বসে চার–পাঁচ ঘণ্টা ব্যয় করে গান লেখা যাচ্ছে না। এ ছাড়া দক্ষ যন্ত্রশিল্পীর অভাব আছে। প্লেব্যাক সংগীতে কোনো গার্ডিয়ানও নেই। একজনই গাইছেন, সুর করছেন, লিখছেন, সব করছেন। এক মাস আগে একজন আমাকে বললেন যে আপনার ভাইবার অ্যাকাউন্ট দেন। আমি বললাম, আমার তো নেই, কেন? তিনি বললেন, আপনাকে দিয়ে একটা গান করাব। লিরিক্স পাঠিয়ে দিতাম, সুরটাও পাঠিয়ে দিতাম। এভাবে কি আন্তরিক কাজ হয়?’
সংগীত পরিচালক ও শিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ বলেন, ‘আগে সংগীত পরিচালক কারা কারা ছিলেন, তাঁদের আমরা চিনতাম। একটা স্টুডিওতে রেকর্ডিং হতো। এখন ঘরে ঘরে স্টুডিও। কে কোন দিক দিয়ে রেকর্ডিং করছে, কিছুই জানি না। যে করছে, সে আবার গায়ক, সুরকার, কম্পোজার সবকিছু। তার ছবির পার্টির সঙ্গে সম্পর্কও ভালো। একটা গোষ্ঠীভিত্তিক কাজ হচ্ছে। কিছু প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পরিচিত কিছু লোক আছে। তাদের সঙ্গে কিছু শিল্পীর সখ্য আছে। এভাবে গান হচ্ছে। ছবিতে ঢোকানো এক জিনিস আর ছবির জন্য গান বানানো—দুটো এক ব্যাপার নয়। সবাই বসে পরিকল্পনা করা হয় না। ব্যাপারটা এ রকম—ফোন করে একজন বললেন, দাদা, একটা সিনেমার জন্য গান গাইতে হবে, চইলা আসেন। বললাম, আর কে গাইবে? বলল, মেয়ের পার্টটা নিয়ে নিছি। আপনারটা বাকি আছে। এই হলো অবস্থা।’
তবে ভিন্নমত এই সময়ের তরুণ প্লেব্যাক সংগীতশিল্পীদের। তাঁরা পরিবর্তনে বিশ্বাসী। এখনকার সিনেমার গান নিয়েও বেশ আশাবাদী। সংগীতশিল্পী দিলশাদ নাহার কনা বলেন, ‘এখনকার গান এখনকার মতোই হচ্ছে। সব গান কোনো সময়েই হিট হয় না। সবাই সবার জায়গা থেকে চেষ্টা করছে। এখন গান রেকর্ডিং, গাওয়ার ধরন সবকিছুতেই পরিবর্তন হয়েছে। পুরো পৃথিবীটাই বদলে গেছে। পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতে হবে।’
ইমরান মাহমুদুল বললেন, ‘আমি সব সময় যা হয়, তা ভালো বলেই গ্রহণ করি। ভালো ভালো গান হচ্ছে। আমাদের দেশে ভালো ভালো সংগীতশিল্পী আছে। তারা দেশের বাইরেও গান গাইছে। আর ছবিতে দেশীয় শিল্পীদের যদি বেশি হাইলাইট করা যায়, তাহলে আমাদের লাভ। বাইরে ভিনদেশের শিল্পীদের নিয়ে কাজ হচ্ছে। আমাদের দেশেও হচ্ছে। এতে পরস্পর সম্পর্কও তৈরি হয়। গানের মেলবন্ধন তৈরি হয়। গ্লোবাল একটা প্রভাব পড়ে। তবে তার একটা সমতা থাকা প্রয়োজন।’