‘কাভি কাভি মেরে দিল মে খ্যায়াল আতা হ্যায়’, ‘মেরা জুতা হ্যায় জাপানি’সহ অনেক জনপ্রিয় গানের গায়ক তিনি
‘কাভি কাভি মেরে দিল মে খ্যায়াল আতা হ্যায়’,  ‘মেরা জুতা হ্যায় জাপানি’সহ অনেক জনপ্রিয় গানের গায়ক তিনি

রাফি, কিশোরদের যুগে স্বতন্ত্র একজন

পুরো নাম মুকেশ চন্দ মাথুর। তিনি এমন সময়ে গাইতেন, যাকে বলা চলে বলিউডের গানের স্বর্ণযুগ। তাঁর সময়েই চলছিল মুহম্মদ রাফি, কিশোর কুমার আর মান্না দের শাসন। তাঁদের সঙ্গেই টিকে ছিলেন মুকেশ। শুধু টিকে ছিলেন তা–ই নয়, জনপ্রিয় শিল্পীদের ভিড়ে স্বতন্ত্র এক গায়কি তৈরি করেছিলেন এ শিল্পী। আজ তাঁর জন্মদিন।

‘কাভি কাভি মেরে দিল মে খ্যায়াল আতা হ্যায়’ গানটি অনেকে শুনেছেন। হয়তো গুনগুন করে গেয়েছেনও। গুগল বা ইউটিউবের আশ্রয় না নিয়ে চট করে বলুন তো গানটি কে গেয়েছেন? গেল বছর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ গানের গায়কের গাওয়া একটি গান নতুন করে ভাইরাল হয়। ‘এক প্যায়ার কা নাগমা হ্যায়...’।
চলুন, এ শিল্পীর আরও কিছু গান শোনা যাক। ‘মেরা জুতা হ্যায় জাপানি’, ‘কাহি দূর যাব দিন ঢাল যায়ে’, ‘ক্যায়া খুব লাগতি হো’, ‘বারি সুন্দর লাগতি হো’, ‘আওয়ারা হু’, ‘ম্যায় পাল দো পালকা শায়ের হু’, ‘ডাম ডাম ডিগা ডিগা’ কিংবা বাংলা ‘ঝুন ঝুন ময়না নাচো না, তাথৈ তাথৈ নাচো না’, ‘মন্দ বলে লোকে বলুক না’। দ্বিতীয় গানটার সুর নিয়েই তৈরি হয়েছে বাংলা ‘আমায় প্রশ্ন করে ওই ধ্রুবতারা’। আর তৃতীয় গানটির অনুকরণেও খুব জনপ্রিয় একটা বাংলা গান আছে, ‘যদি বউ সাজো গো’। হিন্দি গানগুলো হয়তো শুনেছেন। তারপরও অনেকেরই চট করে শিল্পীর নামটা মনে আসবে না।

পুরো নাম মুকেশ চন্দ মাথুর

তিনি মুকেশ। পুরো নাম মুকেশ চন্দ মাথুর। তিনি এমন সময়ে গাইতেন, যাকে বলা চলে বলিউডের গানের স্বর্ণযুগ। তাঁর সময়েই চলছিল মুহম্মদ রাফি, কিশোর কুমার আর মান্না দের শাসন। তাঁদের সঙ্গেই টিকে ছিলেন মুকেশ। শুধু টিকে ছিলেন তা–ই নয়, জনপ্রিয় শিল্পীদের ভিড়ে স্বতন্ত্র এক গায়কি তৈরি করেছিলেন এ শিল্পী।

আজ এ বরেণ্য সংগীতশিল্পীর জন্মদিন, ১৯২৩ সালের ২২ জুলাই ভারতের লুধিয়ানায় মুকেশের জন্ম। ২৭ আগস্ট, ১৯৭৬ সালের এ দিনে শেষ হয় তাঁর জাগতিক ভ্রমণ। বেঁচে থাকলে আজ শত বছর ছুঁতেন এ গায়ক। এ শিল্পীর জন্মদিনটা নীরবে চলে যায় প্রতিবছর। তারকা মুখ নিয়ে ব্যস্ত বিনোদন দুনিয়া তাঁকে যেন ভুলতে বসেছে।

তিনি এমন সময়ে গাইতেন, যাকে বলা চলে বলিউডের গানের স্বর্ণযুগ

অবশ্য তাতে মুকেশের গানের কদর কমেনি। ইউটিউবের সারেগামা মিউজিক চ্যানেলে আজও শ্রোতার পছন্দের তালিকার শীর্ষে আছে মুকেশের গান। এমনকি তাঁর ১০০টি গান নিয়ে করা ইউটিউবের ভিডিও প্যাকেজটিও ৩ কোটির বেশি ভিউ; আজ ২২ জুলাই পর্যন্ত ৩ কোটি ১৩ লাখ ৬৩ হাজার বার দেখা হয়েছে।

লালা জরওয়ার চন্দ মাথুর ও চন্দ রানির ষষ্ঠ সন্তান মুকেশ। বড় বোনকে গান শেখাতে বাড়িতে ওস্তাদ যেতেন। একদিন কথায় কথায় ছোট্ট মুকেশের গান শুনতে চাইলেন ওস্তাদ। কোনোরকম জড়তা ছাড়া অবলীলায় শুনিয়ে দিলেন পুরো একটি গান। সেদিন তাঁর গান শুনে ওস্তাদ বাড়ির লোকদের ডেকে বললেন, মুকেশকে গান শেখানো হোক। গানে নাম করবে মুকেশ। সেই শুরু। বাড়িতেই গান শেখা চলতে থাকে। দিল্লির দরবারি ঘরানা থেকে শাস্ত্রীয়—সবকিছুই শিখলেন মুকেশ।

গানের ভেতর দুঃখ, বেদনা, না পাওয়া, পেয়ে হারানোর যন্ত্রণা ফুটিয়ে তুলতে মুকেশ ছিলেন অদ্বিতীয়

শিখতে শিখতে একদিন বড় পরিসরে গাওয়ার সুযোগ এল। তা-ও হঠাৎ। তাঁদের এক আত্মীয়ের বিয়ে, মা–বাবার সঙ্গে গেছেন। সেই আসরেই গান গেয়েছিলেন মুকেশ। আসরে ছিলেন হিন্দি ছবির সে সময়ের জনপ্রিয় অভিনেতা মোহিত লাল। অনুষ্ঠানে তিনি মুকেশের গান শুনে মুগ্ধ। অভিভাবকদের বলেকয়ে মুকেশকে তিনি মুম্বাই নিয়ে যান। পণ্ডিত জগন্নাথ প্রসাদের কাছে গান শেখার ব্যবস্থা করেন। সে সময়ে ‘নির্দোষ’ ছবিতে অভিনেতা ও গায়ক হিসেবে সুযোগ পান মুকেশ।

‘নির্দোষ’ ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৪১ সালে, শ্রোতারা প্রথমবার শোনেন মুকেশের কণ্ঠ ‘দিল হুয়া বুঝহা হুয়া’। এরপর ১৯৪৫ সালে ‘পেহলি নজর’ সিনেমা দিয়ে শুরু হয় পেশাদার গায়ক হিসেবে মুকেশের বলিউড–যাত্রা।

রাজ কাপুরের ‘কণ্ঠ’ হয়ে উঠেছিলেন তিনি

গানের ভেতর দুঃখ, বেদনা, না পাওয়া, পেয়ে হারানোর যন্ত্রণা ফুটিয়ে তুলতে মুকেশ ছিলেন অদ্বিতীয়। বিশেষ করে সে সময়ে রাজ কাপুরের ‘কণ্ঠ’ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। রাজ কাপুর তো এমনও বলেছিলেন, ‘আমি তো আমার কণ্ঠ হারিয়েছি, সবাই মনে করে আমার কণ্ঠ মুকেশের মতো!’ এভাবে রাজ কাপুর, দেব আনন্দ, অমিতাভের যুগে প্রায় ১ হাজার ২০০ গান গেয়েছেন মুকেশ। তারপরও সমসাময়িক অন্যদের তুলনায় সংখ্যাটা অনেক কম। এর কারণ, মানুষটা ছিলেন খামখেয়ালি। নিজের মনমর্জিতে চলতেন। তাল মিলিয়ে চলা ছিল তাঁর অপছন্দ। তবে সংখ্যায় কম হলে কী হবে, মানের দিকে থেকে সেগুলো ছিল অনেক ওপরে।

আগেই বলেছি, বেশ কিছু বাংলা গানও গেয়েছেন তিনি। গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন তাঁর ভালো বন্ধু। সলিল চৌধুরীর সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল। বাংলা উচ্চারণে দুর্বল অবাঙালি মুকেশের বাংলা গানে আগমনটাও নাটকীয়। হিন্দি ছবিতে তত দিনে বেশ নাম করেছেন। বন্ধু পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিজেই বাংলায় গান গাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন মুকেশ।

পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়

গ্রামোফোন কোম্পানির কাছে মুকেশকে দিয়ে বাংলা গান গাওয়ানোর প্রস্তাব দিলেন পুলক। কিন্তু শুরুতে রাজি হয়নি গ্রামোফোন কোম্পানি। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় বোঝালেন, মুকেশকে দিয়ে বাংলা গান গাওয়ালে সাড়া পড়বে। কিন্তু গ্রামোফোন কোম্পানির প্রধান নির্বাচক সরাসরি বলে দিলেন, ‘সরি।’

তারপরও পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় দমে যাননি। সে সময় দিলীপ বসুর একটি ছবির গান লিখছিলেন পুলক। সে ছবির জন্য ‘সরি’ শব্দটি দিয়েই একটা গান লিখলেন, ‘সরি ম্যাডাম, সরি’। গাওয়ালেন মুকেশকে দিয়েই। ব্যস, বাংলা চলচ্চিত্রে মুকেশের যাত্রা শুরু হলো।

পরে মুকেশকে দিয়ে দুটি বাংলা গান গাওয়ায় গ্রামোফোন কোম্পানি। শোনা যায়, মৌলিক ওই দুটি গান গাইতে বেশ ঝক্কি পোহাতে হয় মুকেশকে। কলকাতায় গানের জলসায় রেকর্ডিং সেন্টারে সারা দিন চেষ্টা করেও গান দুটি নির্ভুল উচ্চারণে গাইতে পারলেন না মুকেশ।

মুহম্মদ রাফি, কিশোর কুমারদের ভিড়ে স্বতন্ত্র এক গায়কি তৈরি করেছিলেন মুকেশ

পরে মুম্বাইয়ের (তৎকালীন বোম্বে) এক স্টুডিওতে আবার শিডিউল নেওয়া হলো। এবার মান্না দের দ্বারস্থ হলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। মান্না দে গান তুলে মুকেশকে শোনালেন। মুকেশ গাইলেন, ‘ওগো আবার নতুন করে ভুলে যাওয়া নাম ধরে ডেকো না’ এবং ‘দেহেরই পিঞ্জিরায় প্রাণ পাখি’। সে সময় আরও বাংলা গান গেয়েছিলেন। সলিল চৌধুরীর কথা ও সুরে মুকেশের গাওয়া ‘মন মাতাল সাঁঝ সকাল, কেন শুধুই ডাকে’ এবং ‘ঝুন ঝুন ময়না নাচো না, তাথৈ তাথৈ নাচো না’ এখনো শোনেন মানুষ। মুকেশের গাওয়া বাংলা গানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সাড়া ফেলেছিল ‘মন্দ বলে লোকে বলুক না’ এবং ‘ও ময়না রে’।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুর ও মুকুল দত্তের দুটি গান ‘আমার মনের কত সুখ নিয়ে সারা বেলা’ ও ‘মনকে কিছু বলো না’ জনপ্রিয় না হলেও প্রশংসিত গানের তালিকায় আছে।

গুগলের ডুডলে

মূলত হিন্দি গানের জন্যই নাম করেছিলেন তিনি। তাঁকে বলা হয় হিন্দি সিনেমার ‘দ্য ম্যান উইথ দ্য গোল্ডেন ভয়েস’। আর তিনি ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা গায়কের পুরস্কার পেয়েছিলেন একবার, ১৯৭৩ সালে ‘রজনীগন্ধা’ ছবির ‘কাই বার ইউ হি দেখা হে’ গানটির জন্য। চারবার জিতেছেন ফিল্মফেয়ার পুরস্কার।
সুরেলা কণ্ঠ আর গায়কির কারণে মুকেশ তাঁর সময়ে রাফি, কিশোরের ভিড়েও আলাদা জায়গা করে নিতে পেরেছিলেন। এমনকি ভাষার সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে বাংলা গানের শ্রোতাদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেছিলেন তিনি। ‘তারকা’চর্চিত বিনোদনজগতে তাঁর নামটি তুলনামূলক কম চর্চা হলেও মুকেশের গাওয়া গানগুলো রয়ে যাবে যুগ যুগ। আজও যশপ্রার্থী গায়কেরা তাঁর মতো গাওয়ার চেষ্টা করেন ‘কাভি কাভি মেরে দিলমে...’।

সূত্র: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, উইকিপিডিয়া, ডেইলি স্টার