গান নিয়ে লাকী আখান্দ্

লাকী আখান্দ্। ছবি : সংগৃহীত
লাকী আখান্দ্। ছবি : সংগৃহীত

সাক্ষাৎকারের মাঝামাঝি সময়ে লাকী আখান্দ্ হঠাৎ বললেন, ‘তোমাকে আবার কবে দেখবো?’

বললাম, 'নিশ্চয়ই এরমধ্যে আবার দেখা হবে।'
তিনি বললেন, ‘তোমাকে একটা ভিডিও ইন্টারভিউ দেবো। এই কথাগুলো মানুষের জানা দরকার।’
বললাম, ‘নিশ্চয়ই লাকী ভাই!’

কিন্তু এরপর তিনি আর সেভাবে সুস্থ হয়ে ওঠেননি। ‌ ভিডিও ইন্টারভিউ নিতে পারিনি, তাই সেটাই অডিও ভার্সন হয়ে রয়ে গেছে আমার কাছে। আমি সেই মুহূর্তগুলো চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। আমার কাছে এটা তার ভিডিও ইন্টারভিউ।
আজ এই অসাধারণ সুরকার, গায়ক তথা সংগীতজ্ঞের মৃত্যুবার্ষিকী। তার কথা মনে হলে এখনো আমার চোখের সামনে তাঁকে দেখতে পাই। মনে হয় স্নেহভরে ডাক দিয়ে বলছেন, ‘আরো অনেক কিছু করার বাকি আছে। সময় পাবো তো?’

লাকী আখান্দ্। ছবি : সংগৃহীত

২০১৭ সালের শুরুর দিকে যখন সাক্ষাৎকারটি নিই, তখন পত্রিকায় তার একটা ছোট অংশ ছাপা হয়। যে মুহূর্তে যেটুকু দরকার, সেটুকু নিয়েই পত্রিকার কারবার। ‌ কিন্তু সাক্ষাৎকার নিতে গেলে কত ধরনের কত কথাই তো হয়। আজ যখন তিন অংশে বিভক্ত লাকি ভাইয়ের সাক্ষাৎকারটি শোনার চেষ্টা করছি, তখন দেখছি এমন কিছু কথা তিনি শুরুতেই বলেছিলেন, যা প্রতিটা সংগীত প্রেমিকের জানা থাকলে ভালো হয়। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের সংগীতের অনেক শাখা। মাটির গান সেগুলো। লালন, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, কীর্তন খুব সুন্দর। আধুনিক গানও খুব গুরুত্বপূর্ণ। গান করার সময় অস্থির হলে চলবে না। মনোযোগ দিতে হবে। কোন গানের সঙ্গে কোন যন্ত্রানুষঙ্গ ভালো লাগবে কোনটা থাকলে গানটা নষ্ট হয়ে যাবে, সে বিষয়গুলো একজন সংগীতের লোকের জানা থাকা প্রয়োজন। কোন একটা রিদমিক গানে সাতটি যন্ত্র হয়তোবা ব্যবহৃত হলো, আরেকটা বাণী প্রধান, স্যাড গানে ততগুলো যন্ত্র তো লাগবে না। যেমন ধরো, ভাওয়াইয়া। ‘ওকি ও বন্ধু কাজল ভোমরা'। ছোটবেলা থেকেই ভাবতাম, কিভাবে গানটা করব। তিনটা বা চারটা যন্ত্র দিয়েই এই গান করতে হয়। কিবোর্ড-এর কড, বেজের একটা স্ট্রোক রাখা যায়, তালের জন্য মন্দিরা, আর খুব দরকার হলে বাঁশি। এদিয়েই গানটি করা যায়।’ এটুকু বলে তিনি গানের দুটি পংক্তি মুখে বললেন, তারপর সুরে সুরে গাইলেন।
‘বুঝতে পারছ তো গানটি খুব দুঃখের, কিরকম একটা হাহাকার রয়েছে দেখো!’
কথাটা বোঝানোর জন্য ব্যাখ্যা করলেন এভাবে, ‘মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্ট একটা খুব বড় ব্যাপার। ইউরোপে এটা খুব সাবধানতার সঙ্গে করে। গানের মধ্যে শুধু শুধু কোন কারন ছাড়াই একটা কিবোর্ড বাজাবে, কখনোই না! কোন সালাদে ধনিয়াপাতা দিতে হবে সেটা ওরা খুব ভালোভাবে বোঝে।’

গানি অস্থিরতা বিষয়টা কোনভাবেই আমার মাথা থেকে যাচ্ছিল না। তাই তখনই প্রশ্নটা করে ফেলি। অস্থিরতা বলতে তিনি ঠিক কি বোঝাচ্ছেন?
‘গান একটা সাধনা। এই সাধনা না থাকলে হবে না। সাধনার প্রতি মনোযোগ না থাকলে অস্থির হয় মানুষ। তার মাথা অস্থির হয়ে যায়। সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য এটা হতে পারে। সংস্কৃতি না বোঝার জন্য হতে পারে। আমাদের এখানে ভাওয়াইয়া, কীর্তন, আধুনিক, রক কোনটাই ঠিকমতো হয় না। কলকাতায় এইচএমভি থেকে যে গানগুলো হতো, গানের সঙ্গে থাকতে হলে সেগুলোর দিকে নজর দেওয়া যেতে পারে। সেই ছোটবেলায় আকাশবাণীর অনুরোধের আসরের জন্য আমরা সবাই রবিবার তিনটা থেকে চারটা পর্যন্ত রেডিও টিউন করে রাখতাম। ‌ কেন? কোয়ালিটি গান শোনার জন্য। সেখানে কোয়ালিটি গান বাজতো। এই কোয়ালিটি গান এলো কোত্থেকে? একটা সিস্টেম হয়ে এল। কে আনলো? ব্রিটিশ এইচএমভি। গান কিভাবে তৈরি করতে হয় সেটা ওরা শিখিয়ে দিলো।’
সেটা কিরকম?
‘নিয়মটা ছিল এরকম। হেমন্ত মুখার্জী দুটো গান করবেন তরুন বন্দোপাধ্যায় দুটো গান করবেন। সলিল চৌধুরী দুটো গানে সুর করবেন। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার দুটো গান লিখবেন। কে কার গান গাইবেন, কার সুরে গাইবেন, সেটা তৈরি হতো পুরো একটি বছর ধরে। একজন দুটো, বড়জোর চারটা গান করতেন।

সুর অনুযায়ী গানটা অ্যারনজাররা শুনতেন। প্রত্যেকটি গানের জন্য অ্যারেণ্জাররা থাকতেন। কোথায় বেহালা থাকবে, কোথায় বাশি থাকবে, কোথায় রিদম থাকবে ইত্যাদি তারা ঠিক করে নিতেন। তারপর তারা শুনে দেখতেন। কোন যন্ত্র বাদ হবে কিনা কিংবা কোনটা যুক্ত হবে কিনা, সেটাও তারা তখন ঠিক করতেন। এরপর মহড়া হতো। রেকর্ডিস্ট পুরোটা শুনতেন। শোনার পর সবাই চলে যেতেন দমদম স্টুডিওতে। সেখানে রেকর্ডিং হতো। আলাদা মুড আসতো তাতে। সবার জানা আছে গানগুলো। তাই আরামে বাজাতো সবাই। আরামে গাইত। এরপর চা-কফি লুচি খেয়ে ব্রেকের পর সবাই বসতো, সুন্দর একটা আনন্দের মধ্য দিয়ে রেকর্ডিং হতো! রেকর্ডিং হওয়ার পর পুজোয় গানগুলো ছাড়া হতো।’

ছোট ভাই হ্যাপি এবং অন্যদের সঙ্গে লাকী আখান্দ্। ছবি : সংগৃহীত

কিন্তু সব গানই ভালো হতো কি করে?

‘প্রত্যেকের ভেতরে তাড়ণা ছিল, আমি হেমন্তের চেয়ে ভালো গান করব। হেমন্ত মান্না দেখে অবাক করে দেব গান গেয়ে। গৌরীপ্রসন্ন কে অবাক করে দেব লিখে। এরকম সুস্থ একটা প্রতিযোগিতা ছিল। প্রত্যেকের মধ্যে ধারণা ছিল কি করে ভালো গান তৈরি করতে হবে। এইচএমডি আমাদের সঙ্গীত জগতের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্তগুলো গড়ে দিয়েছিল। আমি মনে করি, যদি আমাদের দেশে কেউ মিউজিকে ভালো করতে চায়, অনেক বছর নষ্ট না করে মানুষকে শান্তি দিতে চায়, তাহলে তাকে কলকাতার ওই গানগুলো অনুসরণ করে চললেই চলবে। তাতে পরিশ্রান্ত হতে হবে না। ভালো রাস্তা ধরেই সুন্দর সাফল্য চলে আসবে!’

এরপর তিনি বলেছিলেন স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কিভাবে এইচএমভির সঙ্গে তিনি যুক্ত হলেন। কিভাবে চারটি গান সুর করার সুযোগ সৃষ্টি হলো, শিল্পী হিসেবে পেলেন বনশ্রী সেনগুপ্ত আর গোরাচাঁদ মুখার্জিকে, সেটা অন্য এক গল্প। অন্য এক সময় করা যাবে।