‘কফি হাউস আমার বাড়ির খুব কাছেই ছিল। কিন্তু যে কেউ জানলে অবাক হবে, আমি আজ পর্যন্ত কোনো দিন কফি হাউসে যাইনি। তবে কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে কফি হাউসের যে ছবি গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার গানের কথায় তুলে ধরেছেন, সেটা এককথায় অসাধারণ। আর তার ওপর নচিকেতার ছেলে খোকা (সুপর্ণকান্ত ঘোষ) সুন্দর সুর করেছেন। আমি তো কেবল তাঁদের বানানো জিনিসটাই শ্রোতার কাছে তুলে ধরেছি,’ কথাগুলো ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’খ্যাত গায়ক মান্না দের। প্রথম জীবনে গান নিয়ে তাঁর তেমন একটা আগ্রহই ছিল না। কিন্তু কাকার ইচ্ছায় ও নিজের সাধনায় সফল এক শিল্পী হয়ে ওঠেন তিনি। আজ তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী।
সাধারণ এক পরিবারের সন্তান ছিলেন মান্না দে। অন্য দশজনের মতো নিজেও চাইতেন পড়াশোনা করে চাকরি করবেন। সেভাবেই জীবনকে দেখতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু ছোট মান্না দে সুযোগ পেলেই গান গাইতেন। সেসব গান শুনেই তাঁর কাকা বিখ্যাত গায়ক কৃষ্ণচন্দ্র দে বুঝতে পেরেছিলেন, গানে ভালো করবেন তাঁর ভাতিজা। মান্না দেকে নিয়মিত গান করতে ও শিখতে উৎসাহিত করেন। এই চর্চার ফল হিসেবে ত্রিশের দশকে ছাত্রজীবনে আন্তকলেজ সংগীত প্রতিযোগিতায় পরপর তিন বছর তিনটি পৃথক বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন করেন।
কিন্তু মান্না দে গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পরও জীবনের লক্ষ্য ঠিক করেননি। পরে আইনজীবী হওয়ার ইচ্ছা জাগলেও কাকার উৎসাহে গানেই থিতু হন। আত্মজীবনী ‘জীবনের জলসাঘরে’তে মান্না দে লিখেছেন, ‘আমার মধ্যে গানের প্রতিভা ছিল, এটা কাকা হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন। তিনিই আমাকে টেনে এনে একদিন বলেছিলেন, “গান শেখো। তোমাকে দিয়ে গান হবে।” গানের জগতে এগিয়ে যাওয়ার জন্য তিনিই আমাকে প্রথম থেকে সব রাস্তা দেখিয়েছিলেন। তিনিই ছিলেন আমার প্রেরণার উৎস।’ মারা যাওয়ার আগপর্যন্ত তিনি কাকার অবদান ভোলেননি।
শৈশব থেকেই বেশির ভাগ সময়ই তিনি কাকার সঙ্গে থাকতেন। অনেক সময় কাকা তাঁকে থাকতে বাধ্য করতেন। কণ্ঠ কীভাবে ভালো রাখতে হয়, কীভাবে গান করতে হয়, কীভাবে সুর তৈরি করতে হয়, সেসব খুঁটিনাটি কাকার কাছ থেকেই শিখেছেন। এই সময় কাকাই তাঁকে শিখিয়েছেন, সব সময় কান খোলা রাখতে। ভালো–মন্দ দুই ধরনের গান শুনতে। কেন সব গান শ্রোতা পছন্দ করছেন না, কেন অল্পসংখ্যক গান তাঁরা পছন্দ করছেন, ভালো-মন্দ গানের পার্থক্য খুঁজে বের করতে বলতেন। আরও বলতেন, নিজে সন্তুষ্ট থেকে গান করতে। অন্যদের পছন্দে গান করা থেকে বিরত থাকতে বললেন। ইচ্ছার বাইরে অন্যের চাপিয়ে দেওয়া গান গাইতে নিষেধ করতেন।
প্রথম আলোর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে কাকার প্রসঙ্গে মান্না দে বলেছিলেন, ‘কাকা বিয়েটিয়ে করেননি, আমাদের নিজের ছেলের মতো মানুষ করেছিলেন। কাকার দৌলতে ভারতবর্ষের সেরা সেরা গাইয়ে-বাজিয়ে আমাদের বাড়িতে আসতেন, পারফর্ম করতেন। বাড়িতে বসেই আমরা তাই ভারতের বিখ্যাত সব শিল্পীর গান শোনার সুযোগ পেয়েছিলাম। সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি-সা আমি শুনতে শুনতে নিজেই শিখেছিলাম। পড়াশোনা শেষ করার পর কাকা আমাকে শেখাতে শুরু করলেন। শিক্ষক হিসেবে কাকা ছিলেন খুব কড়া। কাকা কখনো দুটো মেডেল আর একটা কাপ পাওয়ার জন্য গান শেখাতেন না, কাকার তত্ত্বাবধানে শুরু করার পর আমি কাকার ওস্তাদ দবীর খাঁ সাহেবের কাছে গান শিখলাম। এরপর কাকার হাত ধরে বোম্বেতে যাওয়ার পর ওখানে কাকা আমাকে বড় বড় ওস্তাদের কাছে দিয়ে দিলেন।’
বোম্বে এসে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হন মান্না দে। এই প্রসঙ্গে আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘বোম্বে ছিল এমন এক জায়গা, যেখানকার মূলমন্ত্রই হলো, সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট। নিজেই নিজেকে প্রমাণ করতে হবে। আমি চ্যালেঞ্জটা নিয়েছিলাম।’ ‘তামান্না’ (১৯৪৩) ছবিতে সুরাইয়ার সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে ‘জাগো এয় উষা’ প্লেব্যাকে তাঁর প্রথম গান। অভিষেকের পর সাত বছর তেমন একটা পরিচিতি পাননি। কিন্তু থেমে থাকেননি। হিন্দি সিনেমায় তাঁর প্রথম একক হিট গান ১৯৫০ সালে মুক্তি পাওয়া ‘মশাল’ ছবির ‘উপর গগন বিশাল’। আর পেছনে তাকাতে হয়নি। ১৯৫৩ সালে ‘কত দূরে আর নিয়ে যাবে বলো’ তাঁর রেকর্ড করা প্রথম বাংলা গান। দীর্ঘ সংগীতজীবনে নিজে গেয়েছেন, সুর করেছেন, হিন্দি চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা করেছেন। সংগীতের প্রায় সব ক্ষেত্রেই অসামান্য প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি।
কাকাই তাঁর মাথায় ঢুকিয়েছিলেন শুধু বাংলা গান নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে না। তখন থেকেই মান্না দের ভেতর থেকে তাড়না ছিল, সর্বভারতীয় গাইয়ে হতে হবে। ভারতবর্ষে যত রকম গানবাজনা আছে, সব জায়গায় তিনি হাঁটতে চেয়েছেন। হিন্দি, গুজরাটি, মারাঠি, ভোজপুরি, পাঞ্জাবি, কোঙ্কনি, অসমিয়া ও বাংলা ভাষার গানের পাশাপাশি রবীন্দ্র ও নজরুলসংগীতেও তিনি তাঁর অনন্য সংগীতপ্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। ভারতের বিভিন্ন ভাষায় চার হাজারের মতো গান গেয়েছেন তিনি।
সংগীতে অবদান রাখার স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৭১ সালে ভারত সরকারের পদ্মশ্রী, ২০০৫ সালে পদ্মভূষণ, ২০০৭ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার পান। এ ছাড়া ভারতে চারটি জাতীয় পুরস্কার, রবীন্দ্রভারতী ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানজনক ডি-লিট, আলাউদ্দিন খাঁ পুরস্কারসহ বিভিন্ন পুরস্কার পেয়েছেন। ২০১৩ সালের ২৪ অক্টোবর পৃথিবী থেকে বিদায় নেন মান্না দে।