সুর-বাদ্য ছিল না গানটায়। শুধু গরুর গাড়ির চাকার আওয়াজ, গরুর গলার ঘণ্টিধ্বনি আর ঝিঁঝি পোকার ডাক। ‘দেবদাস’ ছবিতে দেবদাসের শেষযাত্রায় গাড়োয়ান গাইছিল, ‘মনরে ওরে মন, সুখ পাখি তোর হইল না আপন’। কণ্ঠটি সুবীর নন্দীর। গত বছর তাঁর প্রয়াণের এই দিনটাও ছিল গানটির মতো, দুঃখভারাক্রান্ত।
শিল্পী সুবীর নন্দী চলে যাওয়ার বছরপূর্তি আজ। করোনা মহামারিতে পৃথিবী আজ ওলট-পালট। মেয়ে ফাল্গুনী নন্দী ঢাকায়, স্ত্রী পূরবী নন্দী যুক্তরাষ্ট্রে। পরিবারের তিন সদস্য করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। তাঁদের একজন জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ছিলেন, একজন মারাও গেছেন। এ রকম অনিশ্চয়তায় বড় পরিসরে বাংলার এই প্রিয় শিল্পীকে স্মরণের কোনো আয়োজন নেই।
সুবীর নন্দীর শেষযাত্রায় তাঁর মরদেহবাহী অ্যাম্বুলেন্সের পেছন-পেছন যাচ্ছিলেন এক বোরকাপরা নারী ও এক রিকশাচালক। অনেকের মতো ভীষণ কান্নাকাটি করছিলেন তাঁরাও। প্রয়াত শিল্পীর জন্য দোয়া করছিলেন, চুমু খাচ্ছিলেন অ্যাম্বুলেন্সে। বাবার প্রয়াণের দিনটা স্মরণ করলে এ রকম খণ্ড খণ্ড ছবি ভেসে ওঠে ফাল্গুনীর চোখে। সব কটিই সুবীর নন্দীর প্রতি মানুষের ভালোবাসার ছবি। এত ভালো একজন শিল্পীকে মানুষ বাসতে পারে, এ অবিশ্বাস্য!
সুবীর নন্দীরা যখন গান শুরু করেছিলেন, তখনকার গানের ভুবন ছিল অন্য রকম। গীতিকবি, সুরস্রষ্টারা মিলে পরামর্শ করে শিল্পীর জন্য গান বাঁধতেন। সুবীর নন্দীর ক্ষেত্রেও তেমনটিই হয়েছিল। গান ও সুরের কবিদের প্রতি শিল্পীদের ভক্তি-শ্রদ্ধা ছিল অন্য রকম। তরুণ সুবীরের জন্য তিনটি গান করা হয়েছিল। পরিকল্পনা ছিল, অন্তত একটি গান তো জনপ্রিয় হবেই। সুবীরের ছিল সোনার কণ্ঠ, সোনার ললাট। ‘বন্ধু হতে চেয়ে তোমার, শত্রু বলে গণ্য হলাম’, ‘পাহাড়ের কান্না দেখে’, ‘বধুয়ার মান ভাঙাতে জীবন গেল’—তিনটি গানের তিনটিই মানুষের প্রিয় হয়ে গেল। তার পর থেকে সিনেমা বা অ্যালবাম, একক বা দ্বৈত—সুবীর নন্দীর কণ্ঠে গান মানেই প্রিয় একটি গান।
গীতিকবি মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান মনে করেন, কণ্ঠ নয়, সুবীর গান করতেন হৃদয় দিয়ে। বিনয়ী সুবীর তাঁর গান গেয়ে একরকম ধন্যই করেছেন তাঁকে। ‘দেবদাস’, ‘শুভদা’, ‘চন্দ্রনাথ’, ‘বিরাজ বৌ’ ছবিগুলোতে তাঁর গাওয়া গানগুলোর ভীষণ প্রশংসা করেছেন তিনি। বলেছেন, সুবীর ছাড়া কারও পক্ষে ওভাবে গাওয়া সম্ভব ছিল না।
সুবীর নন্দী গেয়েছেন আড়াই হাজারের বেশি গান। এর মধ্যে প্রায় দেড় শ গানের গীতিকবি ছিলেন মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান। সুবীর নন্দীকে তিনি পেয়েছিলেন তাঁর তরুণ বয়সে। অসুস্থ হওয়ার ১০-১২ দিন আগে গীতিকবি মোহাম্মদ রফিকুজ্জামানকে সুবীর নন্দী বলেছিলেন, ‘আমার খুব ইচ্ছে, আপনার সঙ্গে বসে আবারও ভালো কিছু গান করি।’
গত মাসের শেষে দিকে পারিবারিকভাবে সুবীর নন্দীর শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠিত হয় সিলেটে। করোনার মধ্যে ঠিকভাবে তাঁকে স্মরণ করতেও পারবে না পরিবার। তবে মেয়ে ফাল্গুনীর ইচ্ছে, বাড়িতে আজ তাঁর বাবুর পছন্দের খাবারগুলো রাঁধবেন। শুঁটকির চাটনি, খাসির মাংস, ঘি দিয়ে ডিম ভাজা, ডালের বড়া, শর্ষে পাবদা, ডাঁটা ও আলু দিয়ে বড় মাছ, সরপুঁটি ও কই মাছ ভুনা ছিল সুবীর নন্দীর ভীষণ প্রিয়। এ ছাড়া চা, শিঙারা, চানাচুর ও পান খেতে পছন্দ করতেন তিনি।