বব ডিলান, জন লেনন, পল ম্যাককার্টনি, এরিক ক্ল্যাপটন। ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’–এ পশ্চিমা সংগীতের এই চার দিকপালকেই হাজির করতে চেয়েছিলেন জর্জ হ্যারিসন। দুজনকে রাজি করাতে পেরেছিলেন, আর দুজনকে পারেননি। কেন?
বব ডিলান
বব ডিলান তখন নিভৃত জীবন পার করছেন। দুই বছরের বেশি হয় দর্শকের সামনে কোনো লাইভ পারফর্ম করেন না। ১৯৬৯ সালের আইল অব ওয়াইট শো তাঁর শেষ লাইভ শো। সত্যি বলতে কি, ১৯৬৬ সালে রহস্যময় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার পর কদাচিৎ জনসমক্ষে আসতেন বব ডিলান। এই অবস্থায় অন্তরাল ভেঙে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় মঞ্চে তিনি আসবেন কি না, এই নিয়ে সংশয় ছিল। অথচ কী আশ্চর্য, জর্জ হ্যারিসনকে অবাক করে দিয়ে ‘হ্যাঁ’ বলে দিলেন ডিলান।
কিন্তু সম্মতি দিয়েই খালাস, একটা রিহার্সালেও এলেন না বব ডিলান। কনসার্টের আগের দিন রাতে ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে এসে হ্যারিসনকে বললেন, ‘হেই ম্যান, মনে হয় না আমি পারব।’
ডিলানকে লম্বা একটা বক্তৃতা দিয়ে তখনকার মতো রাজি করালেন হ্যারিসন। তারপরও তিনি নিশ্চিত না, পরদিন ববকে পাওয়া যাবে কি না। এমনকি কনসার্টে নিজের পরিবেশনা শেষ করে যখন মঞ্চে ডিলানকে আহ্বান করেন, তখনো তাঁর শঙ্কা, পশ্চাৎ–মঞ্চে বব আছেন তো! কিন্তু ঠিকই মঞ্চে এসে হাজির হলেন ডিলান।
উদ্দাম হয়ে উঠলেন দর্শক, তাঁরা ধারণাও করেননি অন্তরাল ছেড়ে বেরিয়ে আসবেন ডিলান। উপস্থিত শ্রোতা–দর্শককে হতাশ করেননি ডিলান। গাইলেন তাঁর সেসব গান: ‘ব্লোইন ইন দ্য উইন্ড’, ‘মি. টাম্বুরিন ম্যান’, ‘জাস্ট লাইক আ উইম্যান’। তাঁর পরিবেশনার সঙ্গে বাজালেন হ্যারিসন আর তাঁর তারকা দল। পরে অ্যালবামে ডিলানের গানগুলো অন্তর্ভুক্ত করার জন্য তাঁর কোম্পানি কলম্বিয়া রেকর্ডসের সঙ্গে বিশেষ চুক্তি করতে হয়েছিল ইএমআইকে।
এরিক ক্ল্যাপটন
জর্জ হ্যারিসন যখন এরিক ক্ল্যাপটনকে ফোন করেন, তখন তাঁর অবস্থা খুবই নাজুক। এক বছরের বেশি সময় ধরে আত্মনির্বাসনে আছেন। হ্যারিসনের তৎকালীন স্ত্রী প্যাটির প্রতি মোহজনিত কারণে বিষণ্নতায় ভুগছিলেন ক্ল্যাপটন, আর এটা থেকে বেরিয়ে আসতে নিয়মিত মাদক নিতেন। তাই হ্যারিসনের প্রস্তাব পেয়ে সোজা না করে দিলেন। কিন্তু হ্যারিসন নাছোড়। তাঁর মনে হয়েছিল, ক্ল্যাপটনকে এই অবস্থা থেকে উদ্ধারের এটাই রাস্তা। তাঁকে মাদক সরবরাহ করা হবে, এই শর্তে শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন ক্ল্যাপটন।
কনসার্টের আগের সপ্তাহে লন্ডন থেকে নিউইয়র্কের প্রতিটি বিমানে তাঁর জন্য টিকিট বুক করা ছিল, অথচ ক্ল্যাপটন এলেন ঠিক আগের দিন। তাঁকে দেখে মনে হলো একটা মড়া। স্বাভাবিকভাবেই কোনো রিহার্সালই করতে পারলেন না। ক্ল্যাপটন আদৌ গাইতে পারবেন কি না, এই নিয়েই সংশয় ছিল। এ জন্য আয়োজকেরা জেসি এড ডেভিসকে বিকল্প হিসেবে প্রস্তুত রেখেছিলেন। পরে অবশ্য দুজনই পারফর্ম করেন। ন্যাশভিল গিটারিস্ট হাঙ্ক গারল্যান্ড আর বিলি বায়ার্ডের ডিজাইন করা গিবসন বায়ার্ডল্যান্ড গিটার বাজিয়েছিলেন ক্ল্যাপটন। দুই বছরের মধ্যে এটাই ছিল তাঁর শেষ পারফরম্যান্স। তারপর আসক্তি কাটানোর লড়াইয়ে নামেন তিনি।
পল ম্যাককার্টনি
কনসার্টে গাইতে অস্বীকৃতি জানান পল ম্যাককার্টনি। তাঁর মনে হয়েছিল, বিটলস পুনর্মিলনীর জন্য সময়টা যথেষ্ট উপযুক্ত নয়। বিটলস ভেঙে যাওয়ার পর আইনি জটিলতার কারণে তাঁর মনে তিক্ততার জন্ম হয়েছিল।
অনেক বছর পর রোলিং স্টোনকে এক সাক্ষাৎকারে ম্যাককার্টনি বলেছিলেন, ‘জর্জ এসে আমাকে বলল (কনসার্ট ফর) বাংলাদেশে বাজাতে চাই কি না। আমার মনে হলো, কী লাভ? মাত্রই আমরা বিভক্ত হয়েছি, আবারও এক হতে যাচ্ছি? মনে হচ্ছিল, এটা কেমন যেন পাগলামি।’ ফলে পল ম্যাককার্টনিকে দিয়ে গাওয়ানো গেল না।
জন লেনন
কনসার্টে অংশ নিতে প্রথমে রাজিই ছিলেন জন লেনন। তবে হ্যারিসন শর্ত দিয়েছিলেন, কনসার্টে লেননের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী ইয়োকো ওনো গাইতে পারবেন না। শোনা যায়, এই শর্তেও রাজি হয়েছিলেন লেনন। কিন্তু এ নিয়ে ওনোর সঙ্গে তাঁর তীব্র ঝগড়া হয়। পরিণতিতে কনসার্টের দুই দিন আগেই নিউইয়র্ক ছেড়ে চলে যান লেনন। ফলে বিটলসের বাকি তিন সদস্যের মধ্যে শুধু রিঙ্গোস্টারকে নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল।