গিটারের জাদুকর আইয়ুব বাচ্চুর রুপালি গিটার বসেছে জন্মভূমি চট্টগ্রামের প্রবর্তক মোড়ে। মোড়ের প্রতীকী এই গিটারের ঝংকার ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। বিশ্বের যে যেখানে বাংলা গানপ্রেমী আছেন, তাঁদেরও হৃদয় স্পর্শ করেছে এই স্থাপনা। সংগীতাঙ্গনের সবাই যেন নতুন স্বপ্ন আর আশায় বুক বাঁধছেন। সুরকার ও সংগীত পরিচালক ইমন সাহা যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা থেকে বলেছেন, ‘এটা যে কত বড় অর্জন, তা এ জাতির উপলব্ধি করতে ৫০ বছর লাগবে। এ আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করার মতো না।’
আইয়ুব বাচ্চুকে নিয়ে একসঙ্গে গান করা থেকে শুরু করে অনেক স্মৃতি চট্টগ্রামেরই আরেক সন্তান গায়ক ও সংগীত পরিচালক কুমার বিশ্বজিতের। জানালেন, গান করতে গিয়েই এই চট্টগ্রামে কত ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে আইয়ুব বাচ্চুকে। এমনকি গানবাজনার জন্য আত্মীয়–পরিজন ও পরিচিতজনেরা বলতেন, ছেলেটা বুঝি বিপথে চলে গেল। নষ্ট হয়ে গেল। আজ সেই চট্টগ্রামের গানের জন্য বিজয়ীর বেশে আইয়ুব বাচ্চু! এ এক অনন্য অনুভূতি। যাঁরা প্রবর্তক মোড়ে আইয়ুব বাচ্চুর রুপালি গিটার স্থায়ীভাবে স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছেন, তাঁদের সবাইকে সমগ্র শিল্পীসমাজের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা জানালেও কম হবে বলে মনে করেন কুমার বিশ্বজিৎ। তিনি বলেন, ‘এটা এক অন্য রকমের অনুভূতি। চট্টগ্রাম থেকে আমরা বের হয়েছিলাম, চট্টগ্রামের মুখ উজ্জ্বল করব এই স্বপ্ন নিয়ে। এরপর ভাবনায় এল, চট্টগ্রাম নয়, দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে হবে। কতটুকু পূর্ণ করতে পেরেছি জানি না, তবে এটাই এক বড় প্রাপ্তি! চট্টগ্রামের সেই ছেলেকে চট্টলাবাসী সম্মান দিল। চট্টগ্রামে গানবাজনা করাতে সামাজিকভাবে খুব অবহেলার চোখে দেখা হতো। অভিভাবকেরা ভাবতেন, গান করে তাঁদের ছেলেমেয়েরা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দিন শেষে প্রমাণিত হলো, শুধু গানের প্রতি ভালোবাসাই আইয়ুব বাচ্চুকে দেশ–বিদেশের মানুষের ভালোবাসা এনে দিয়েছে। নিজের জন্মভিটায় স্থায়ী গিটারের ভাস্কর্য বসেছে, এ দিয়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম জানতে পারবে, কী ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু।’
আইয়ুব বাচ্চুর এলআরবি আর মাইলস সমসাময়িক গানের দুটি দল। কানাডার এডমন্টনে নিজেদের ব্যান্ডের ৪০ বছর পূর্তির অনুষ্ঠানের ফাঁকে মাইলস ব্যান্ডের অন্যতম সদস্য শাফিন আহমেদ বললেন, ‘সম্মানের দিক দিয়ে এটা অসাধারণ প্রাপ্তি। নিজের শহরে স্থায়ীভাবে সম্মান দিয়ে রাখা, আগামী প্রজন্মের জন্য ধরে রাখা হলো—এটা সত্যি গর্বের বিষয়। আমাদের ব্যান্ডজগতে একসঙ্গে বহু বছরের পথচলা, এভাবে সম্মান জানানোটা নতুন প্রজন্মকেও অনুপ্রাণিত করবে। বিশেষ করে চট্টগ্রামের তরুণেরা সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত হবে।’
যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসে গানের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে সেখানে আছেন সামিনা চৌধুরী। প্রসঙ্গটি তুলতেই ভীষণ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন তিনি। বললেন, ‘ভালো শিল্পীর জন্য ভালো একটি সম্মান। আমাদের আরও অনেক গুণী শিল্পী পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেছেন, তাঁদের মনে রাখার মতো উল্লেখযোগ্য সে রকম কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আইয়ুব বাচ্চুর ক্ষেত্রে নেওয়া হয়েছে এবং দ্রুত বাস্তবায়ন করে দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে, এটা একরকম আশার আলো। ক্ষণজন্মা মেধাবীদের জাতির সামনে তুলে ধরার জন্য এ এক অনন্য উদ্যোগ। আমাদের দেশে তো মৃত্যুর পর সবাই সবকিছু ভুলে যায়, কিন্তু চট্টগ্রামবাসী তাদের সন্তানকে ভুলে যায়নি, স্থায়ীভাবে মনে রাখার বন্দোবস্ত করেছে। শিল্পীদের সম্মান দেখানোর নতুন পথ দেখাল চট্টগ্রাম।’
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত সংগীত পরিচালক ইমন সাহা বলেন, ‘বাচ্চু ভাইয়ের প্রতি এমন সম্মান দেখানো নিঃসন্দেহে একটা বৈপ্লবিক উদ্যোগ। এ এক অনন্য উদাহরণ হয়ে থাকল। যাঁরা এই আয়োজনের পেছনে ছিলেন, তাঁদের স্যালুট।’