ক্যালেন্ডারের হিসাবে আজ ঠিক ১১ বছর পার হতে চলল। আজকের দিনেই পৃথিবীর ভ্রমণ শেষ হয়েছিল ঢাকার কমলাপুরে জন্ম নেওয়া মুক্তিযোদ্ধা ও বাংলা রক গানের অন্যতম সংগীতশিল্পী আজম খানের। ২০১১ সালের এই দিনে সকাল ১০টা ২০ মিনিটে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে শেষবারের মতো শ্বাস নিয়েছিলেন তিনি। ৬১ বছর বয়সে পৃথিবীর ভ্রমণ শেষ করা এই শিল্পী ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করছিলেন।
এক বছরের বেশি সময় ক্যানসারের সঙ্গে লড়ে জীবনযুদ্ধে পরাজয় মেনে নেওয়া আজম খান রেখে যান স্বাধীন দেশ ও মানচিত্র আর বাংলা রক গান। মারা যাওয়ার দিন তাঁকে শেষবারের মতো দেখতে অনেকে ভিড় করেছিলেন হাসপাতালের সামনে ও শেষ যাত্রায়। এত বছর পর আজ রোববার দুপুরে যখন আজম খানের বড় মেয়ে ইমা খানের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তিনি জানালেন, ‘এখন আর কেউ খবর নেয় না। জানতেও চায় না, কেমন আছি, কীভাবে আছি। কীভাবে কাটছে আমাদের দিনকাল। হয়তো এটাই বাস্তবতা। আমরাও স্বাভাবিকভাবে এটা মেনে নিয়েছি।’
বছরখানেক আগে করোনায় ইমা খান তাঁর স্বামীকে হারিয়েছেন। তিনিও তখন করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। এখন ভাইয়ের সঙ্গে ইমা থাকেন ঢাকার বনশ্রীতে। বললেন, ইচ্ছা ছিল আজ বাবার কবরস্থানে যাওয়ার, জিয়ারত করার। কিন্তু টিকার বুস্টার ডোজ দেওয়ার পর বিছানা থেকে উঠতেও কষ্ট হচ্ছে। তবে মিলাদ পড়ানো হয়েছে। কবর জিয়ারতও করানো হয়েছে। কেটে যাচ্ছে সময়।
আজম খান কেবল একটি নাম বা একজন শিল্পী বা পপসম্রাট নন; বাংলা গানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এ প্রসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা ও বাংলা রক গানের শিল্পী সম্পর্কে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের একটি কথা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেছিলেন, ‘বিশ শতকের বাংলা গানের ইতিহাস যাঁরা লিখবেন, ৭৩-৭৪ সালের একটা ঘটনার কথা তাঁরা কিছুতেই এড়িয়ে যেতে পারবেন না, বিশেষ করে একজন গায়কের কথা। তাঁর নাম আজম খান। কোনো অসাধারণ গায়ক নন আজম খান। কিন্তু এমন একধরনের গান তিনি সেকালে আমাদের শুনিয়েছিলেন, যে গান এ দেশে এর আগে কেউ শোনেনি। গানগুলোর কথা, সুর, সঙ্গে ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র, পরিবেশনের রীতি—সবই ছিল আলাদা। আমি সেই আলাদা, ব্যতিক্রম, ভিন্নধর্মী আজম খানের কথা স্মরণ করতে চাই। সেদিনের সেই তারুণ্য আজও প্রজন্মের কাছে ইতিহাস হয়ে আছে। বাংলা গান বা সপ্তবর্ণা অনুষ্ঠানের সঙ্গে যখন আমি, ফেরদৌস ওয়াহিদ, ফিরোজ সাঁই, পিলু মমতাজসহ অনেকে যুক্ত হলাম, তখন বাংলা গানের দৃশ্যপট পাল্টে গেল। দেশের তরুণসমাজকে এই গান মাতিয়ে তুলল। গান তাঁর কাছে কেবল আনন্দ-বিনোদন নয়, বরং গান ছিল তাঁর কাছে একজন যুদ্ধফেরত মুক্তিযোদ্ধার কাব্যগাথা। সময়ের সাহসী সৈনিক আজম খান সেদিন যুদ্ধের হাতিয়ার স্টেনগান রেখে কণ্ঠে ধারণ করেছিলেন সমাজ সচেতনতার গান। সব প্রতিকূলতা হটিয়ে তারুণ্যদীপ্ত সুরে তিনি শুরু করলেন গানের নতুন ধারা।’
আজম খানের জন্ম ১৯৫০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আজিমপুরে। জন্ম আজিমপুরে হলেও বেড়ে ওঠেন কমলাপুরে। স্কুলে পড়ার সময় পিটিতে সবার সঙ্গে গান গাইতেন। এসব গান মনেও রাখতে পারতেন তিনি। পরে হুবহু গাওয়ার চেষ্টা করতেন। এক সাক্ষাৎকারে আজম খান বলেছিলেন, ‘আমি গান শুনে হুবহু গাইতে পারতাম। অনেকের কাছে এটা বিস্ময়কর ছিল। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান, আবদুল আলিম, শ্যামলের গান তাঁদের মতো করেই গাইতাম। পরে মহল্লার বন্ধু-সমবয়সীদের সঙ্গে আড্ডায় বানিয়ে গান গাইতাম। এভাবেই একদিন গানের দিকে ঝুঁকে পড়ি। গানের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আমার ছিল না।’
দেশে তখন আইয়ুব খানবিরোধী উত্তাল আন্দোলন। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছিলেন আজম খান। আন্দোলনকে বেগবান করতে ‘ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠী’র সদস্য তরুণ আজম খান গণসংগীত গেয়ে পথে নামেন। তারপর শুরু হয় বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম। তাতে অংশ নেন তিনি। একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়া মাত্র চলে যান আগরতলায়। একদিকে নিয়েছেন যুদ্ধের প্রশিক্ষণ, অন্যদিকে প্রশিক্ষণ শিবিরে গান গেয়ে অনুপ্রাণিত করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের। প্রশিক্ষণ শেষে অস্ত্র হাতে অংশ নেন সম্মুখসমরে। বীরের বেশে ফিরেছেন প্রিয় ঢাকায়। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ায় সেই যে ছেদ পড়েছিল, তা আর এগোয়নি। সংগীতে যে অনন্য প্রতিভা ছিল তাঁর, সেটিকেই সাধনার পথ ও জীবিকার উপায় হিসেবে আঁকড়ে ছিলেন আমৃত্যু। পশ্চিমা ধাঁচের পপ গানে দেশজ বিষয়ের সংযোজন ও পরিবেশনার স্বতন্ত্র রীতিতে বাংলা গানে নতুন মাত্র এনেছিলেন তিনি। এই নতুন ধারার গানের পথিকৃৎ হিসেবে তিনি শ্রোতাদের কাছে ‘পপসম্রাট’ বা ‘পপগুরু’ হিসেবে সম্মানিত হন। আজম খানের কণ্ঠে ‘রেললাইনের ওই বস্তিতে’, ‘হাইকোর্টের মাজারে’, ‘এত সুন্দর দুনিয়ায়’, ‘অভিমানী’, ‘অনামিকা’, ‘পাপড়ি’, ‘আলাল ও দুলাল’, ‘আসি আসি বলে তুমি আর এলে না’, ‘আমি যারে চাইরে’, ‘জ্বালা জ্বালা’, ‘ও চাঁদ সুন্দর’, ‘ও রে সালেকা ও রে মালেকা’, ‘জীবনে কিছু পাব না রে’, ‘বাধা দিও না’সহ বহু গান আজম খানের কণ্ঠে শুনেছে মানুষ।
অসাধারণ মানুষ আজম খান খুব সাধারণ জীবন যাপন করতেন। রাজধানীর কমলাপুর এলাকায় কবি জসীমউদ্দীন রোডে, মতিঝিলের ব্যাংক কলোনি মাঠে কিংবা স্টেডিয়ামের সুইমিংপুলে যাঁরা আজম খানকে দেখেছেন, তাঁরা জানেন, বিপুল জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও ব্যক্তিজীবনে শিল্পী আজম খান কতটা সহজ-সরল ছিলেন। খোলা মনের মানুষ ছিলেন। সহশিল্পী বা সংগীতজগতের মানুষেরাও এর প্রমাণ পেয়েছেন বারবার। কবি জসীমউদ্দীন রোডে বাবার রেখে যাওয়া বাড়িতেই থাকতেন সন্তানদের নিয়ে। অনেকটা নিভৃতে, অনাড়ম্বর জীবন যাপন করতেন। গান করতেন, ক্রিকেট খেলতেন। সুইমিংপুলে গিয়ে সাঁতার শেখাতেন। মানুষকে আকর্ষণ করার প্রবল ক্ষমতা ছিল তাঁর মধ্যে।
মুক্তিযুদ্ধের পর আজম খান বন্ধুদের নিয়ে সংগীতের দল গড়লেন, নাম দিলেন ‘উচ্চারণ’। ১৯৭২ সালে ‘উচ্চারণ’ ব্যান্ডের যাত্রা শুরু হয়। সে বছরই বিটিভিতে প্রচারিত ‘এত সুন্দর দুনিয়ায় কিছুই রবে না রে’ আর ‘চার কলেমা সাক্ষী দেবে’ গান দুটি তাঁকে জনপ্রিয় করে তোলে। এরপর ‘ওরে সালেকা ওরে মালেকা’, ‘রেললাইনের ওই বস্তিতে’, ‘আসি আসি বলে তুমি আর এলে না’, ‘আলাল ও দুলাল’, ‘হারিয়ে গেছে খুঁজে পাব না’—এসব গানে তিনি শ্রোতাদের মাতিয়ে তোলেন। ‘এক যুগ’ নামে তাঁর প্রথম অডিও ক্যাসেট প্রকাশিত হয় ১৯৮২ সালে। সব মিলিয়ে তাঁর গানের অ্যালবাম ১৭টি। গানের ভুবনের বাইরে খেলাধুলার প্রতিও ছিল তাঁর দারুণ ভালোবাসা। ১৯৯১ থেকে ২০০০ সালে তিনি গোপীবাগ ফ্রেন্ডস ক্লাবের পক্ষ হয়ে প্রথম বিভাগ ক্রিকেট খেলতেন। অভিনয় করেছিলেন ২০০৩ সালে, ‘গডফাদার’ নামের একটি বাংলা চলচ্চিত্রেও। বিজ্ঞাপনচিত্রেও মডেল হয়েছেন। সাঁতারের প্রশিক্ষক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
আজম খানের বড় ভাই সাইদ খান (সরকারি চাকরিজীবী), মেজ ভাই আলম খান (সুরকার), ছোট ভাই লিয়াকত আলী খান (মুক্তিযোদ্ধা) এবং ছোট বোন শামীমা আক্তার খানম। ১৯৮১ সালে তিনি সাহেদা বেগমকে বিয়ে করেন। তাঁর দুই মেয়ে ইমা খান ও অরণি খান এবং ছেলে হৃদয় খান।