নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ঢোকার আগে বাম পাশে ছোট্ট একটি কক্ষ। একসঙ্গে তিন-চারজন বসার ব্যবস্থা আছে সেই ঘরে। লিফটের তিনে উঠে আইসিইউর বাইরে অপেক্ষা করছি। কাঠের দরজা ভেদ করে ভেতর থেকে কান্নার শব্দ পাচ্ছি। হাসপাতালের একজন নার্সকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হয়েছে?’ বললেন, ‘আলাউদ্দীন আলী সাহেবের স্ত্রী কাঁদছেন।’ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে ঢুকলাম। মুখোমুখি দু্টি চেয়ার বসা আলাউদ্দীন আলীর স্ত্রী ফারজানা মিমি ও তাঁর মা। মেয়ে ফারজানা মিমির কান্না থামানোর বৃথা চেষ্টা করে সান্ত্বনা দিয়েই চলছেন মা। কোনোভাবেই থামছে না কান্না। মিমির একটাই কথা, ‘আমার মেয়েটার কী হবে? আমার মেয়েটা কি বাবাহারা হয়ে যাবে? ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে আমি থাকব কী করে? আমার মেয়ে তো বাবাকে ছাড়া থাকতে পারবে না। আমার এই ছোট্ট মেয়ে রাজকন্যার মুখের দিকে তাকিয়ে ওর বাবাকে ফিরিয়ে দাও আল্লাহ।’
আদ্রিতা আলাউদ্দীন রাজকন্যা বরেণ্য গীতিকার, সুরকার, সংগীত পরিচালক ও বাদ্যযন্ত্রশিল্পী আলাউদ্দীন আলীর বর্তমান স্ত্রীর একমাত্র মেয়ে। তাঁর আগের সংসারে রয়েছে আরও চার সন্তান। তাঁরা হলেন আজমেরী আলী, শওকত আলী রানা, আফরীন আলী এবং আলিফ আলাউদ্দীন। তাঁরা প্রত্যেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বর্তমান সংসারের মেয়ে রাজকন্যার বয়স আট বছর, এখনো স্কুলপড়ুয়া। আট বছর বয়সী এই মেয়েকে নিয়ে তাঁর অনেক স্বপ্ন, মেয়েটাকে ভালো মানুষ হিসেবে তৈরির একটা চিন্তাও ছিল। স্কুলের শিক্ষার্থী ছোট্ট এই মেয়েটি গান বাজনায়ও বেশ পটু। যে বাবা তাঁর অসাধারণ সব সৃষ্টি দিয়ে বাংলাদেশের সংগীতকে সমৃদ্ধ করেছেন, তাঁর কন্যা গানে পটু হবে, এটাই স্বাভাবিক। কয়েক বছর ধরে অসুস্থতায় ভোগা সুরসম্রাট আলাউদ্দীন আলী নাকি ইদানীং তাঁর ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে বেশি চিন্তায় থাকতেন। বড় সন্তানদের সবাই যাঁর যাঁর অবস্থানে ভালো আছেন, কিন্তু ছোট্ট রাজকন্যা তো এখনো স্কুলের গণ্ডিই পার করতে পারেনি।
রাজধানী ঢাকার ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে ৩৬ ঘণ্টার বেশি সময় এরই মধ্যে কেটেছে আলাউদ্দীন আলীর। লাইফসাপোর্ট নেওয়ার আগে চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন, ২৪ ঘণ্টা পার না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা কিছুই বলতে পারবেন না। কিন্তু নির্ধারিত সময় পার হয়ে গেলেও আলাউদ্দীন আলীর শারীরিক অবস্থা উন্নতির লক্ষণ সেভাবে দেখেননি চিকিৎসকেরা। বরং হঠাৎ হঠাৎ অবস্থার অবনতি ঘটেছে। এখন তাঁর অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের চিকিৎসকেরা।
ফারজানা মিমি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলতে থাকলেন, ‘হে আল্লাহ, তুমি আমাকে একটিবারের জন্য সুযোগ দাও। আমার মেয়েটার কথা ভেবে তুমি তাঁকে ফিরিয়ে দাও। সুস্থ করে দাও। মেয়েটা এত অল্প বয়সে বাবাহারা হয়ে যাবে। দুই দিন ধরে সে বাবার বুকে ঘুমাতে পারছে না। এই নিয়ে অনেক কান্নাকাটি। বাবার কাছে যাবে, বাবার সঙ্গে ঘুমাবে। আমি এই মেয়েকে কীভাবে সান্ত্বনা দেব।’
আলাউদ্দীন আলী হাসপাতালে থাকতে সব সময় খুব ভয় পেতেন। লাইফসাপোর্ট দেওয়ার আগেও স্ত্রী ফারজানা মিমি সঙ্গে গোঁ ধরেছিলেন, বাসায় ফিরে যাওয়ার। মিমি বলেন, ‘রাজকন্যার বাবা বাসায় ফেরার জন্য খুব জেদ করেছিল। শরীরে এতসব যন্ত্রপাতি লাগানো দেখে ঘাবড়ে যান তিনি। হাসপাতালে থাকবেনই না, কোনোভাবেই মানানো যাচ্ছিল না তাঁকে।’
এক জীবনে আলাউদ্দীন আলী অসংখ্য গান সৃষ্টি করেছেন। তাঁর সুর ও সংগীতে গান গেয়ে অনেকে পেয়েছেন আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা, মালিক হয়েছেন বিত্ত-বৈভবের। দেড় বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে ঢাকার মতিঝিলের এজিবি কলোনিতে চলে আসেন আলাউদ্দীন আলী। তিন ভাই, দুই বোনের সঙ্গে সেই কলোনিতেই বড় হতে থাকেন এই গুণী শিল্পী। সংগীতে প্রথম হাতেখড়ি ছোট চাচা সাদেক আলীর কাছে। পরে ১৯৬৮ সালে যন্ত্রশিল্পী হিসেবে চলচ্চিত্রজগতে পা রাখেন। শুরুটা শহীদ আলতাফ মাহমুদের সহযোগী হিসেবে, পরে প্রখ্যাত সুরকার আনোয়ার পারভেজের সঙ্গেই কাজ করেন দীর্ঘদিন। লোকজ ও ধ্রুপদি গানের সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা আলাউদ্দীন আলীর সুরের নিজস্ব ধরন বাংলা সংগীতে এক আলাদা ঢং হয়ে উঠেছে প্রায় পাঁচ দশক ধরেই। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের বহু স্বনামধন্য শিল্পী তাঁর সুরে গান করে নিজেদের করেছেন সমৃদ্ধ। ৪০ বছরেরও বেশি সময় গানের জগতে দাপিয়ে বেড়ানো এই মানুষটি সঞ্চয় করতে পারেননি কিছু। রাজধানী ঢাকায় তাঁর সুর ও সংগীতে গান গেয়ে অনেকে বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাটের মালিক বনে গেলেও, বনশ্রীতে এখনো ভাড়া বাসায় থাকেন আলাউদ্দীন আলী। কথায় কথায় স্ত্রীর ফারজানা মিমির সঙ্গে এই আক্ষেপের কথাও নাকি জানিয়েছেন কিছুদিন আগে। ফারজানা মিমি বলেন, ‘রাজকন্যার বাবা মেয়েটার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন। কিছুই তো রেখে যেতে পারছে না। কিছুদিন ধরে নতুন গান তৈরির ব্যাপারে বেশ আগ্রহী হয়ে উঠছিলেন। কিছু প্রকল্প হাতেও নিয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ অসুস্থতায় সবকিছুই যেন এলোমেলো হয়ে গেল।’
ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন আলাউদ্দীন আলী। গতকাল শুক্রবার সকাল সাড়ে আটটায় তাঁকে লাইফসাপোর্ট দেওয়া হয়। আজ দুপুরে সাতজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সমন্বয়ে একটি মেডিকেল বোর্ড আলাউদ্দীন আলীর চিকিৎসা পর্যালোচনা করেছে। এর আগে হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. আশীষ কুমার চক্রবর্তী জানান, লাইফসাপোর্ট দেওয়ার পর ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় পার হলেও আলাউদ্দীন আলীর শারীরিক অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। তাঁর জ্বরের মাত্রা বেড়েছে। রক্তে শ্বেতকণিকার মাত্রা অনেক বেড়ে গেছে।
এদিকে শনিবার সকাল সাতটার পর থেকে আলাউদ্দীন আলীর রক্তে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বাড়তে থাকে। পাশাপাশি রক্তচাপ ও জ্ঞানের মাত্রা একেবারেই কমে যায়। একই সময়ে হঠাৎ তাঁর হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে যায়। এই অবস্থাকে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট বলা হয়। দ্রুত প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়ার ১৫ মিনিট পর তাঁর হৃৎস্পন্দন ফিরে আসে।
অসংখ্য গানের মধ্য থেকে আলাউদ্দীন আলীর উল্লেখযোগ্য কিছু সৃষ্টি হচ্ছে: ‘সুখে থাকো, ও আমার নন্দিনী হয়ে কারও ঘরনি’, ‘সূর্যোদয়ে তুমি, সূর্যাস্তেও তুমি ও আমার বাংলাদেশ’, ‘বন্ধু তিন দিন তোর বাড়িত গেলাম দেখা পাইলাম না’, ‘যেটুকু সময় তুমি থাকো কাছে, মনে হয় এ দেহে প্রাণ আছে’, ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ’, ‘এমনও তো প্রেম হয়, চোখের জলে কথা কয়’, ‘সবাই বলে বয়স বাড়ে, আমি বলি কমে রে’, ‘আমায় গেঁথে দাওনা মাগো, একটা পলাশ ফুলের মালা’, ‘আছেন আমার মোক্তার, আছেন আমার ব্যারিস্টার’, ‘শত জনমের স্বপ্ন তুমি আমার জীবনে এলে’, ‘কেউ কোনো দিন আমারে তো কথা দিল না’, ‘পারি না ভুলে যেতে, স্মৃতিরা মালা গেঁথে’, ‘জন্ম থেকে জ্বলছি মাগো’, ‘আমার মনের ভেতর অনেক জ্বালা আগুন হইয়া জ্বলে’, ‘যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়’ ও ‘ভালোবাসা যত বড় জীবন তত বড় নয়’ প্রভৃতি।
আলাউদ্দীন আলী বাংলা গান, বিশেষ করে বাংলা চলচ্চিত্রে শ্রোতাপ্রিয় অসংখ্য গান তৈরি করেছেন। তিনি একই সঙ্গে সুরকার, সংগীত পরিচালক, বেহালাবাদক ও গীতিকার। গান লিখে তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পেয়েছেন। গুণী এই মানুষটির জন্ম ১৯৫২ সালের ২৪ ডিসেম্বর মুন্সিগঞ্জের বিক্রমপুরের টঙ্গিবাড়ী থানার বাঁশবাড়ী গ্রামে। তাঁর বাবা ওস্তাদ জাদব আলী। মায়ের নাম জোহরা খাতুন।