গতকাল ছিল কিংবদন্তিতুল্য শিল্পী সাবিনা ইয়াসমীনের ৬৬তম জন্মবার্ষিকী। বাড়িতেই তিনি ছিলেন। কীভাবে বিশেষ দিনটি কাটল, আর সংগীতের দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার অভিজ্ঞতার কথা তাঁর কাছ থেকে জেনেছেন।
প্রতিবছর যেভাবে জন্মদিন উদ্যাপিত হতো, এই বৈশ্বিক বিপর্যয়ে নিশ্চয়ই সেভাবে হয়নি। তারপরও যদি বলতেন, রাত ১২টা থেকে আজ (শুক্রবার) সারা দিন কীভাবে কাটল আপনার?
এ পর্যন্ত কখনোই আমি ঘটা করে জন্মদিন উদ্যাপন করিনি। সব সময় ঘরোয়া পরিবেশে করে এসেছি। বাড়িতে আমার আত্মীয়স্বজন, আমার মেয়ে, দুই–চারজন বন্ধুবান্ধব আসে, তাদের নিয়েই উদ্যাপন করেছি। এবার সেটাও হয়নি। কেউ আসতে পারেনি। তবে প্রথম ফোন করে উইশ করে আমার মেয়ে (বাঁধন)। এরপর রাত ১২টা থেকে মুঠোফোন, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবারে এক হাজারের ওপর শুভেচ্ছা পেয়েছি। কোনটা যে দেখব, কাকে যে উত্তর দেব, বুঝতে পারছিলাম না। তবে আজ (শুক্রবার) ফেসবুকে একসঙ্গে সবার উদ্দেশে ধন্যবাদ জানিয়ে দিয়েছি।
বিশেষ কোনো সারপ্রাইজ ছিল কি?
না, সারপ্রাইজ তেমন কিছু না। তবে সাগর ভাই (ফরিদুর রেজা সাগর) বিশাল বড় একটা বাক্স পাঠিয়েছেন। অবশ্য প্রতিবছরই তিনি এ রকম পাঠান। এই বছরেও যে তিনি মনে করে পাঠাবেন, সেটা আমি ভাবিনি।
কাউকে মিস করেছেন আজ?
ছেলেকে মিস করছিলাম। সে–ও ফোন করে উইশ করেছে। সত্যি বলতে কি, যাঁরা জন্ম দিয়েছেন, জন্মদিনে প্রথমে মিস করি মা–বাবাকেই। আর তেমনভাবে কাউকে মিস করছি না।
একটু অন্য প্রসঙ্গে যাই, যাঁদের সঙ্গে নিয়মিত কাজ করতেন, তাঁদের অনেকেই আজ নেই। সম্প্রতি চলে গেছেন আজাদ রহমান, আলাউদ্দীন আলী, এন্ড্রু কিশোর। কিংবা তার আগে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, এঁদের সবাইকে মিস করেন নিশ্চয়ই। তাঁদের সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন।
এঁদের সবাইকেই প্রতিনিয়ত মিস করি। গুণী সুরকার আজাদ রহমান ভাই, তাঁর সুরে অনেক গান করেছি। আলাউদ্দীন আলী সম্পর্কে আমি বলি, পাক–ভারত উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুরকার। তিনি যেখানেই হাত দিয়েছেন, সেটাই সোনা হয়ে গেছে। তাঁর গানগুলো এমনই ছিল। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের তো তুলনাই নেই। বিশেষ করে দেশের গান বললেই আমার কাছে বুলবুল প্রথম। তাঁর করা প্রতিটি দেশের গানই অনন্য। পাশাপাশি চলচ্চিত্রের গান তো আছেই। এন্ড্রু কিশোরের কথা তো বলে শেষ করতে পারব না। শেষ নয়টা মাস তাঁর কাছাকাছিই ছিলাম। প্রতিদিনই ফোনে কথা হতো। সিঙ্গাপুরের হাসপাতাল, ডাক্তার ঠিক করে দেওয়া থেকে তাঁকে সেখানে পাঠানো, সব বিষয়ে সহযোগিতা করেছি। সৈয়দ আব্দুল হাদী ভাই, মিতালি সিং ও আমি সিঙ্গাপুরে গিয়ে কিশোরের জন্য অনুষ্ঠান করেছি। ভেবেছিলাম, কিশোর ফিরে আসবে, কিন্তু এল না। হোয়াটসঅ্যাপে কিশোরের হাজার হাজার খুদে বার্তা। না পারছি পড়তে, না পারছি মুছতে। মনে করলেই খুব মন খারাপ হয়।
আপনি পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে কাজ করছেন। ১৯৬২ সালে এহতেশামের ‘নতুন সুর’ চলচ্চিত্রে শিশুশিল্পী হিসেবে প্রথম গান করলেও ১৯৬৭ সালে আমজাদ হোসেন ও নূরুল হক বাচ্চু পরিচালিত ‘আগুন নিয়ে খেলা’ ছবিতে প্রথম প্লেব্যাক করেন। সেই সময়ের কথা কি মনে আছে?
হ্যাঁ। মনে আছে, ফেরদৌসী আপার পেছনে প্রথম গানটি ছিল কোরাস কণ্ঠে ‘সি মানে ক্যাট, ক্যাট মানে বিড়াল।’ এরপর প্রথম আমি বড়দের গান গাই আলতাফ মাহমুদ ভাইয়ের সুরে ‘নতুন সুর’ চলচ্চিত্রে। তিনিই প্রথম আমাকে চলচ্চিত্রে গান গাওয়ার সুযোগ দেন। মনে আছে, তিনি বলেছিলেন, গান যদি ভালো না গাইতে পারো, তাহলে কিন্তু বাদ দিয়ে দেব। এরপর ভয়ে ভয়ে গাইলাম ‘মধু জোছনার দীপালী’ গানটি। এরপর ওই ছবিতেই আরেকটি গান গাই মাহমুদুন নবী ভাইয়ের সঙ্গে ‘একটি পাখি দুপুর রোদে সঙ্গীহারা একা।’ সেই থেকে তিনি যত দিন বেঁচে ছিলেন, যত ছবির সংগীত পরিচালনা করেছেন, সব কটিতেই আমাকে দিয়ে গাইয়েছেন।
মরমি শিল্পী আব্দুল আলিম থেকে শুরু করে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, কিশোর কুমার, মান্না দের সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে গেয়েছেন। আর ডি বর্মণ, বাপ্পী লাহিড়ি, ভুপেন হাজারিকা থেকে এ দেশের খান আতাউর রহমান, সত্য সাহা, সুবল দাস, আলম খান, শেখ সাদী খান—সবার সুরেই গান করেছেন। সংগীতে এই দীর্ঘ পথপরিক্রমায় আপনার কিছু অভিজ্ঞতা যদি ভাগাভাগি করতেন।
আমি বলব, আমি আজ পর্যন্ত যে কজন সুরকারের সঙ্গে কাজ করেছি, প্রত্যেকের কাছ থেকেই কিছু না কিছু শিখেছি, জেনেছি। বিশেষ করে গান গাইতে গিয়ে উচ্চারণ, কিংবা এক্সপ্রেশন—এ দুটো বিষয় আতা ভাইয়ের কাছ থেকে শেখা। আরেকটা বিষয়ে বলি, আর ডি বর্মণের সুরে দুটো ছবিতে আমি গান করি, ‘আরপার’ ও ‘শত্রু’। মনে আছে ‘শত্রু’ ছবিতে গান করতে গেলাম বোম্বে। আর ডি বর্মণ তখন ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। তিনি এই ছবির জন্য সেখান থেকে চলে এলেন। তিনি তখনো জানতেন না, কে গাইবে। স্টুডিওতে এসে দেখলেন আমি। তিনি তখন বললেন, ‘আরে তুমি গাইবে। আমি আগে জানলে তো মিউজিক ট্র্যাক পাঠিয়ে দিতাম। তুমি তো এমনিতেই গেয়ে দিতে পারতে। কষ্ট করে আমার আসার দরকার পড়ত না।’ এটা যে আমার জন্য কত বড় প্রাপ্তি। আর বাপ্পী লাহিড়ির বাবা অপরেশ লাহিড়ি তো আমাকে কতবার বলেছেন বোম্বেতে থেকে যেতে।
আপনি ১৯৮৪ সালে একুশে পদক ও ১৯৯৬ সালে স্বাধীনতা পদক অর্জন করেছেন। সর্বোচ্চ ১৪ বার আপনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। সংগীতের জন্য ডক্টরেট ডিগ্রিও লাভ করেছেন ১৯৮৪ সালে। প্রাপ্তির ঝুলি পরিপূর্ণ। তবু কোনো অপূর্ণতা বোধ করেন?
আমি সবই পেয়েছি। তবে অপূর্ণতা এই যে আমরা গান করছি, এই গানের পেছনে যাঁদের শ্রম, তাঁরা গানের রয়্যালটি পাচ্ছি না, এটা নিয়ে আমি কথা বলতে চাই। গানগুলো এখন বাণিজ্যিকভাবে বিভিন্ন মাধ্যমে যেমনতেমনভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, অথচ এই গানগুলোর গীতিকার, সুরকার, শিল্পী তাঁদের ন্যায্য রয়্যালটি পাচ্ছেন না। আমি মনে করি, রয়্যালটি আমাদের অধিকার। রয়্যালটি আমাদের দিতেই হবে।
কী করলে এ সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে করেন?
সরকারি উদ্যোগ বা পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এটা সম্ভব নয়। আইন করে দেওয়া দরকার। যে প্রক্রিয়ায় রয়্যালটি নিশ্চিত হবে, সেটি আইন করে পাস করিয়ে দিতে হবে। তাহলেই একটি গানের পেছনে যাঁদের শ্রম, সবাই সেই দামটা পাবেন।
দেশের গানের ভান্ডার আপনার গানে সমৃদ্ধ। এত বেশি দেশের গান আর কোনো শিল্পীর নেই। চলচ্চিত্রের গানসহ এ পর্যন্ত প্রায় ১৬ হাজার গান আপনি গেয়েছেন। নিজেকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন।
আমি খুবই ভাগ্যবান, এত গান গাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। যাঁরা আমাকে দিয়ে গাইয়েছেন, তাঁদের সবার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তবে একটি বিষয় বলতে চাই, এখন অনেক গান হচ্ছে, ভালো ভালো শিল্পীও আমরা পেয়েছি। তারা ভালো গাইছেও। গানগুলো একবার–দুবার শুনছিও। কিন্তু তারপর হারিয়ে যাচ্ছে। গানগুলো মানুষের মুখে মুখে থাকছে না। কেন, ঘাটতিটা কোথায়, ঠিক বুঝতে পারছি না। আমার আর রুনা লায়লার পর এত বড় একটা শূন্যতা তৈরি হবে, কখনো ভাবিনি। আমাদের দুজনের পর এত দিনে শূন্যস্থান পূরণ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু তা কেন হলো না, ঠিক জানি না। এটা দুর্ভাগ্যজনক। আমরা দুজন তো অনেক দিন থেকে খুব বেশি গান গাইছি, তা–ও না। কমই গাইছি।
শোনা যাচ্ছে, অনেক শিল্পীই ইদানীং বলছেন, তাঁদের গান নতুন প্রজন্মের শিল্পীরা গাইতে গেলে তাঁদের অনুমতি নিয়ে গাইতে হবে। আপনি কী মনে করেন?
অবশ্যই এটা ঠিক নয়। গানটি একা একজন শিল্পীর নয়। ওই গানের একজন গীতিকার, একজন সুরকার রয়েছেন—এ রকম কিছু হলে তাঁদেরও অনুমতি নিতে হবে। আমি তো মনে করি, আমাদের গান নতুন প্রজন্মই তো গাইবে। এই গানগুলো তারাই বাঁচিয়ে রাখবে। তবে এ বিষয়ে একটা কথা বলার আছে। যারা আমাদের গানগুলো গাইবে, তারা যেন সঠিকভাবে পরিবেশন করে। যে মাধ্যমে তারা গাইছে, সেই মাধ্যমের ভূমিকাটা বেশি জরুরি। নতুন শিল্পী আমাদের গান ঠিকমতো গাইতে পারছে কি না, সেটি যাচাই করে তাঁকে যেন উপস্থাপন করা হয়। তাহলে গানটি আর বিকৃত হবে না।