স্তব্ধ হলো কণ্ঠ, থেমে গেল সুর। মুক্তিযুদ্ধের সেই দুঃসময়ে গান গেয়ে দেশের জন্য তহবিল সংগ্রহ করেছিলেন। কিন্তু হেরে গেলেন রোগ আর বার্ধক্যের কাছে। কণ্ঠস্বর চিরকালের জন্য স্তব্ধ হলো মোহাম্মদ আবদুল জব্বারের। কিন্তু নিশ্চিত করে বলা যায়, তিনি চলে গেলেও রয়ে যাবে তাঁর কালজয়ী গানগুলো। যে গান গেয়ে জয় করেছিলেন চার দশকের সংগীতপিপাসুদের হৃদয়। আজ তেমন তিনটি গানের গল্প শুনি।
ওরে নীল দরিয়া, আমায় দে রে দে ছাড়িয়া
কালজয়ী গান হিসেবে প্রথমেই বলা যায় আবদুল জব্বারের গাওয়া ‘ওরে নীল দরিয়া, আমায় দে রে দে ছাড়িয়া’ ‘সারেং বউ’ ছবির এই গানটির কথা। গানটির সুর করেছেন বরেণ্য সুরকার আলম খান। ২০১৫ সালের অক্টোবর মাসে প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আলম খান জানান, গানটির অস্থায়ী সুরটা ১৯৬৯ সালে করা। আলম খান বলেছিলেন, ১৯৬৯ সালে একটু অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলাম। একদিন বিকেলে একটু সুস্থ বোধ করছি, গুনগুন করে সুরটা মাথায় আসে। কিন্তু তখন সুরের ওপর কথা লেখা হয়নি। আমি মনের মতো কোনো দৃশ্য পাইনি বলে কোনো ছবিতে সুরটি ব্যবহার করতে পারিনি। তবে কোনো জায়গায় ব্যবহার করার সুযোগ পাইনি, ‘সারেং বৌ’তে পেলাম।
১৯৭৪-৭৫ সালের দিকে আবদুল্লাহ আল-মামুন (প্রয়াত) এলেন তাঁর ‘সারেং বউ’ ছবিটি নিয়ে। সারেং বাড়ি ফিরছে—এ রকম একটি সিকোয়েন্স তিনি আমাকে শোনান। ওখানে দেখা যাবে, সারেং গান গাইতে গাইতে বাড়ি ফিরছেন। আর তাঁর স্ত্রী সেটি স্বপ্নে দেখছে। তখন আমি গানটির জন্য দীর্ঘদিন ধরে রাখা ওই সুরটি গীতিকার মুকুল চৌধুরীকে (প্রয়াত) শোনাই। তিনি তখন সুরের ওপর ‘ওরে নীল দরিয়া’ পুরো মুখটি লিখে দেন। তিনি দুই দিন পর গল্প অনুযায়ী অন্তরাসহ লিখে নিয়ে এলেন। আমি তাঁর কথার ওপরই সুর করি।
আমি মামুন ভাইয়ের কাছে জানতে চাইলাম, সারেং কীভাবে বাড়ি ফিরছে। তখন তিনি বললেন, প্রথম অন্তরায় ট্রেনে, দ্বিতীয় অন্তরায় সাম্পানে, এরপর মেঠোপথ ধরে ফিরবে। দৃশ্য অনুযায়ী ট্রেনের ইফেক্ট, সাম্পান, বইঠা, পানির ছপ ছপ শব্দ এবং শেষে একতারার ইফেক্ট তৈরি করলাম। গানটি কাকে দিয়ে গাওয়ানো যায়, যখন ভাবছিলাম, তখন আবদুল্লাহ আল-মামুনই আবদুল জব্বারের কথা বলেন। গানটি কাকরাইলের ইপসা রেকর্ডিং স্টুডিওতে রেকর্ডিং হয়েছিল। এই গানে ১২ জন রিদম প্লেয়ারসহ ১০ জন বাদ্যযন্ত্রশিল্পী বাজিয়েছিলেন।
সালাম সালাম হাজার সালাম
আবদুল জব্বারের গাওয়া এ গানটির সুরকার তিনি নিজেই। লিখেছেন ফজল-এ-খোদা। একাধিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যমতে, এ গানের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে শিল্পী আবদুল জব্বার লিখেছেন, ১৯৬৯ সাল। গণ-অভ্যুত্থানের হাওয়ায় উত্তাল দেশ। এমনই প্রেক্ষাপটে কবিতা লেখার মানসে কবি ফজল-এ-খোদা হাতে কলম তুলে নিয়েছিলেন। একদিন তাঁর সঙ্গে দেখা। হাতে তুলে দিলেন অনবদ্য গীতি কথার টুকরো কাগজটি। টুকরো কাগজে লেখা কথাগুলো পড়েই শিহরিত হয়ে উঠলাম। মনে হলো, এটা তো আমারই কথা! মনের গহিনে সারাক্ষণ এ কথাগুলোই বেজে চলে! অথচ কখনো বলা হয়নি। এবার যখন বলার সুযোগ এল, সে সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলাম না। দিনরাত ভাবতে থাকলাম কেমন হবে গানের সুর? একসময় সুর করেও ফেললাম। গানের সঙ্গে মানানসই বলে মনে হয়েছিল আমার। কিন্তু সমস্যা ছিল একটাই, গানটি সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার মতো পরিবেশ পাওয়া যাচ্ছিল না। প্রায় দুই বছর পর এল সেই কাঙ্ক্ষিত দিন। সেটি ছিল ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ। রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ আমাদের উজ্জীবিত করে। ভাষণের পর চলল ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ গানটি গাইতে গাইতে ট্রাকে করে ঘুরে বেড়ানো। এই গানের কথা একদিন বঙ্গবন্ধুর কানেও পৌঁছেছিল। তিনি আমাকে ডেকে নিয়ে বলেছিলেন, তোর মতো এত পাতলাপুতলা একটা পোলা আইয়ুবের বিরুদ্ধে কথা কয়, ভয় করে না? তখন আমি তাকে বলেছিলাম, বাবা আপনে যদি ভয় না পান, তাহলে আমি পাব কেন? আমার মুখে এমন কথা শুনে সেদিন থেকে বঙ্গবন্ধু আমাকে ছেলে সম্বোধন করা শুরু করেছিলেন।
১৯৭১ সালের ১৪ মার্চ এটি প্রথম বেতারে প্রচার হয়।
‘তুমি কী দেখেছ কভু জীবনের পরাজয়’
আবদুল জব্বারের গাওয়া গানটি লিখেছেন অনেক কালজয়ী গানের গীতিকার মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। সুর করেছেন সত্য সাহা। গানটি ব্যবহার করা হয়েছিল নারায়ণ ঘোষ মিতার ‘এতটুকু আশা’ ছবিতে।
নিজের গাওয়া গানের মধ্যে এ গানটি আবদুল জব্বারের খুব পছন্দ ছিল। এ বিষয়ে আবদুল জব্বার ইতিপূর্বে বলেছেন, ‘গানটি এফডিসিতে রেকর্ডিং হয়েছিল। ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর শুনি, গানটি নিয়ে নাকি তোলপাড় হয়ে গেছে। গানটি পর্দায় আলতাফ (প্রয়াত) যখন গেয়ে ওঠেন, তখন পর্দার সামনে অনেক লোকের চোখে পানি দেখেছিলাম। জীবনে যতবার মঞ্চে গান করেছি, এ গানটি গাইতেই হয়েছে।
স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে আবদুল জব্বার আরও বলেছিলেন, অনেক মানুষের মুখে শুনেছি গানটি তাদের প্রিয় গানের তালিকায় আছে। তবে এর মধ্যে একজনের কথা না বললেই নয়। বিখ্যাত শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের খুব প্রিয় গান ছিল এটি। তিনি গানটি শুনে বলেছিলেন, ‘তুমি বাংলাদেশের জব্বার, তোমার এই গান আমাকে মোহিত করেছে। এত সুন্দর কণ্ঠ, এত সুন্দর গান বিরল।’