বাংলা পপ গানের এক জাদুকরের নাম আজম খান, যিনি অংশ নিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধেও। একজন শিল্পী, পপ সম্রাট বা একটি নামই মাত্র নয়, বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এবং বাংলা গানের নতুন ধারার প্রবর্তকও—যিনি নিজেই একটি ঘটনা বা ইতিহাস, যে ইতিহাসকে কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যাবে না। বেঁচে থাকলে আজ তাঁর ৭০তম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন করা হতো। ২০১১ সালে ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করে জাগতিক ভ্রমণ শেষ হয় তাঁর। সংস্কৃতি অঙ্গনে তাঁর বন্ধুদের মধ্যে যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে ফেরদৌস ওয়াহিদ ও ফকির আলমগীরের সঙ্গে কথা হয়। তাঁদের স্মৃতিচারণে জানা গেল, বন্ধু হিসেবে, মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন পপসম্রাট আজম খান।
ফেরদৌস ওয়াহিদের স্মৃতির জানালায় কড়া নাড়তেই তাঁর মনে পড়ে গেল ১৯৭৪ সালের একটি ঘটনা। তখন সিনেমা হলেও টিকিটের বিনিময়ে গানের অনুষ্ঠান হতো। তেমন এক অনুষ্ঠানে আজম খান, ফেরদৌস ওয়াহিদের গাওয়ার কথা। সবই প্রস্তুত। কিন্তু বেঁকে বসলেন আজম খান। সেই দিনের ঘটনার কথা মনে করে ফেরদৌস ওয়াহিদ বলেন, ‘জোনাকি সিনেমায় আমাদের একটা অনুষ্ঠান হবে। সবাই অনুষ্ঠানে যাব, ঠিক আগমুহূর্তে আজম হাসতে হাসতে বলল, ‘‘আমার শরীর ভালো লাগছে না। আমি যামু না। আমারে অন্যভাবে নেওয়ার ব্যবস্থা কর।’’ এরপর ওর জন্য গাড়ি আনা হলো, গেল না। রিকশা ডাকা হলো, তা–ও গেল না। সবাই মিলে ভাবলাম, একটা ভ্যানগাড়ি পাঠাই। ভ্যানগাড়ি দেখে আজম তখন বলে, ‘‘এইবার ঠিক আছে।’’ সত্যি সত্যিই সে ভ্যানগাড়িতে চড়ে অনুষ্ঠানের জন্য বের হয়।’
আজম খানের সঙ্গে ঘটে যাওয়া এই ঘটনা আজও ভুলতে পারেননি ফেরদৌস ওয়াহিদ। জানতে চাইলাম, আজম খান তখন কেন এমনটা করেছিলেন, তা জানতে চাননি? উত্তরে ফেরদৌস ওয়াহিদ বলেন, ‘এটা স্রেফ মজা করার জন্যই করেছে। তবে সিনেমা হলে পৌঁছানোর আগেই সে নেমে যায়। কমলাপুর থেকে মতিঝিল থানা পর্যন্ত ভ্যানগাড়িতে আসে। তারপরের পথটা হেঁটেই গেছে। এই ধরনের মজাগুলো আজম খুব করত। রসিকতা ও দুষ্টুমি করতে ওর ভালোও লাগত। এই স্মৃতি আমি কখনোই ভুলি না।’
আজম খানের মৃত্যুর পাঁচ দিন আগে বন্ধু ফেরদৌস ওয়াহিদের সঙ্গে তাঁর কথা হয়। বন্ধুকে কিছু কথা বলেছিলেন। সেই কথাও মনে পড়ে গতকাল দুপুরে। ফেরদৌস ওয়াহিদ বলেন, ‘মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে আজমের চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে যাওয়ার কথা ছিল। যেহেতু জানি, ও সিঙ্গাপুরে যাচ্ছে, তাই ফোন দিলাম। কথা শেষে আমাকে বলল, ‘‘তুই রাগ করে গানবাজনা বন্ধ করে দিস না বন্ধু। মাঠ কিন্তু খালি। মানুষগুলা জানি কেমন।’’ এরপর কিছুক্ষণ চুপ। আমি কথা ঘুরিয়ে নিলাম। এটাই ছিল ওর সঙ্গে আমার শেষ কথা।’
আজম খান ও ফকির আলমগীর কাছাকাছি এলাকায় থাকতেন। একজন কমলাপুরে, অন্যজন খিলগাঁওয়ে। একসঙ্গে তাঁরা দুজন ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আর তাঁদের নেতৃত্বে ছিলেন নিজামুল হক, কামাল লোহানী—জানান ফকির আলমগীর। তিনি বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলা, গানবাজনা, আড্ডার প্রতি তাঁর দারুণ ঝোঁক ছিল। আমরা প্রায় সময় কমলাপুরের রেললাইন ধরে হেঁটে চলতাম। আজ মনে পড়ছে, আমাদের কমলাপুর রেললাইনের সেই আড্ডা একই সঙ্গে মনুমিতা হোটেল, চিটাগাং হোটেলের আড্ডা এবং মতিঝিল পেট্রলপাম্পে লম্বা আড্ডা চলত। গান চলত। আরও কত কী!’
ফকির আলমগীরের এখনো নানা ভাবে নানা সময়ে মনে পড়ে শিল্পী আজম খানকে। তিনি বলেন, ‘আমার তো শুধু একার নয়, সারা দেশের এমনকি বাংলাদেশিদের যাঁরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে আছেন, সবার সব সময় মনে পড়ে তাঁকে। কিন্তু আমার সব সময় মানুষ আজমকে মনে পড়ে। কারণ, আমাদের প্রতি তাঁর লুকানো একটা ভালোবাসা ছিল। সে তাঁর ভালোবাসা কখনোই দেখাত না। নিজেকে খুব আড়াল করে রাখত।’
বন্ধু হিসেবে আজম খান অতুলনীয়, বললেন ফেরদৌস ওয়াহিদ। তিনি বললেন, ‘হি ইজ আ ভেরি সুইট ফ্রেন্ড—এটা বলতেই হবে। শিল্পী হিসেবে আলাদা। আজমের বন্ধু গ্রুপ ছিল দুইটা। এক দলে ছিল, যাঁদের সঙ্গে সে ছোটবেলা থেকে বেড়ে উঠেছে। আরেকটা গ্রুপে ছিলাম আমরা, যাঁরা সংস্কৃতি অঙ্গনে কাজ করতাম—এই যেমন আমি, ফিরোজ সাঁই, পিলু মমতাজ, ফকির আলমগীর। দুই মহলকে আজম কখনোই এক করত না।’