‘অনেক দিন ধরেই বলিউডের গৎবাঁধা সিনেমা দেখছিলাম, হলিউডও যেন একঘেয়ে লাগছিল। কোরিয়ান সিনেমায় বৈচিত্র্য পেয়েছি। ওদের সিনেমার গল্প গভীর, আলাদা অনুভূতি দেয়’—বলছিলেন ঢাকার তরুণ দর্শক এস রাব্বি। ২০১৫ সাল থেকে নিয়মিত কোরিয়ান সিনেমা দেখছেন তিনি। কেবল তিনিই নন, গত এক দশকে বাংলাদেশের তরুণের মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ান সিনেমা জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
গা ছমছমে থ্রিলার, ধুন্ধুমার অ্যাকশন কিংবা রোমান্টিক সিনেমা নির্মাণ করে বিশ্বজুড়ে আলোচনায় এসেছেন কিম কি দুক, বং জুন–হো, পার্ক চান–উকের মতো কোরিয়ান নির্মাতারা। নব্বইয়ের দশকের শেষ ভাগ থেকে সিনেমা ও ড্রামা সিরিজের ফ্রেমে ফ্রেমে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে কোরিয়ান সংস্কৃতি; কোরিয়ান সংস্কৃতির এ উত্থানকে ‘কোরিয়ান ঢেউ’ হিসেবে বিবেচনা করেন বিশ্লেষকেরা।
শূন্য দশকের গোড়ার দিক থেকে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ‘কোরিয়ান ঢেউ’ আছড়ে পড়েছে। ২০০৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত তুমুল আলোচিত দুই কোরিয়ান সিনেমা ‘ওল্ড বয়’ ও ‘মেমোরিজ অব মার্ডার’ বাংলাদেশি দর্শকদের মধ্যেও আলোড়ন তুলেছিল। এই দুই সিনেমা দেখেই কোরিয়ান সিনেমার ‘খনি’ আবিষ্কারের কথা বলেছেন অনেক দর্শক।
পরে ‘মিরাকল ইন সেল নম্বর সেভেন’, ‘ট্রেন টু বুসান’–এর মতো সিনেমার বদৌলতে কোরিয়ান সিনেমার পাঁড় ভক্তদের ছাপিয়ে সাধারণ দর্শকদের মধ্যেও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ২০২০ সালে অস্কারে বাজিমাত করেছে বং জুন-হোর ‘প্যারাসাইট’; অস্কারের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো অ–ইংরেজিভাষী কোনো চলচ্চিত্র সেরার পুরস্কার ঘরে তুলেছে।
যাঁরা কোরিয়ান সিনেমার নিয়মিত দর্শক না, এমন অনেকেও ‘প্যারাসাইট’, ‘মিরাকল ইন সেল নম্বর সেভেন’, ‘ট্রেন টু বুসান’ দেখেছেন। গত আগস্টে নেটফ্লিক্সে মুক্তি পাওয়া ‘কার্টার’ নিয়ে তো বলা যায় বিশ্বজুড়ে হইচই পড়ে গেছে। নেটফ্লিক্সের গ্লোবাল টপ চার্টে আগস্টের প্রথম সপ্তাহে ৯০টি দেশে সেরা দশের তালিকায় ছিল সিনেমাটি। ধুন্ধুমার অ্যাকশন আর ওয়ান টেক সিনেমার মতো করে তৈরি করা ‘কার্টার’ দিয়ে দর্শককে
বলা যায় আবিষ্ট করে রেখেছেন নির্মাতা।
গত এক দশকে বাংলাদেশে কোরিয়ান সিনেমার আলাদা দর্শক শ্রেণি তৈরি হয়েছে। কোরিয়ান সিনেমার ভক্তদের ফেসবুকে বেশ কয়েকটি গ্রুপ আছে। এর মধ্যে দেড় লাখেরও বেশি সদস্য নিয়ে ‘কোরিয়ান মুভি অ্যান্ড ড্রামা লাভার বিডি’ নামের গ্রুপটি পরিচালনা করেন এস রাব্বি। ২০১৫ সালের দিকে গ্রুপটি গঠন করেন তিনি। গ্রুপে দর্শকেরা কোরিয়ান সিনেমা দেখে নিজেদের মত জানান। সদস্যদের নিয়ে মাঝেমধ্যেই গেট টুগেদারের আয়োজন করা হয়। এটি ছাড়াও বেশ কয়েকটি কোরিয়ান চলচ্চিত্র নিয়ে গ্রুপ রয়েছে, যেখানে কোরিয়ান সিনেমা নিয়ে নিয়মিত আড্ডার আয়োজন করা হয়। কোরিয়ান সিনেমা নিয়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নেন দর্শকেরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন, ফিল্ম অ্যান্ড ফটোগ্রাফি বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী উম্মে সালমা জানান, ‘ওল্ড বয়’ দেখেই কোরিয়ান সিনেমার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন তিনি। পরে ‘নো মার্সি’, ‘বার্নিং’সহ বেশ কয়েকটি সিনেমা দেখে কোরিয়ান সিনেমার ভক্ত বনে যান। তিনি বলেন, ‘কোরিয়ান সিনেমায় নতুন নতুন বিষয় নিয়ে নিরীক্ষা করা হয়। ওদের নির্মাণের ধরন খুব সুন্দর। সাধারণ কোনো ফ্রেমকেও অর্থবহ করে তুলে আনা হয়।’
ইংরেজি ও হিন্দি ভাষার সঙ্গে বাংলাদেশের দর্শকেরা হলিউড-বলিউডের সিনেমা তুলনামূলক সহজে বুঝতে পারেন। কিন্তু ভাষার সঙ্গে পরিচিতি না থাকলেও সাবটাইটেলের কারণে সেই দূরত্ব ঘুচে গেছে বলে জানান রাব্বি। ‘বাংলা সাবটাইটেল’সহ বেশ কয়েকটি ওয়েবসাইটে কোরিয়ান সিনেমার বাংলা সাবটাইটেল পাওয়া যায়।
বাংলাদেশি দর্শকদের কথা বিবেচনা করে ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলোও এখন নিয়মিত কোরিয়ান সিনেমা প্রদর্শন করছে। কয়েক দিন আগে ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম ‘চরকি’তে মুক্তি পেয়েছে কোরিয়ান সিনেমা ‘বান্ধবী’। সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন বাংলাদেশের অভিনেতা মাহবুব লী। বাংলাদেশে কোরিয়ান সিনেমা কেন জনপ্রিয়তা পাচ্ছে? এমন প্রশ্নের জবাবে কোরিয়া থেকে মাহবুব বলেন, ‘বাংলাদেশে ভাষার মিল নয়, এশীয় দেশ হিসেবে পারিবারিক মূল্যবোধের বিষয়গুলোয় মিল আছে। আর ভালো কনটেন্টের জন্য ভাষাগত দূরত্ব কোনো বাধা নয়, সীমানা পেরিয়ে সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়।’
মাত্র দুই দশকের ব্যবধানে কোরিয়ান সিনেমা কীভাবে প্রভাবশালী হয়ে উঠল? মাহবুব লী বলেন, কনটেন্টই তাঁদের মূল শক্তি। ভালো কনটেন্টের পেছনে যথেষ্ট শ্রম দেন। প্রাথমিক পর্যায় থেকে কনটেন্টগুলো পরিচর্যা করেন। অন্যান্য দেশের তুলনায় কোরিয়ায় শ্রম বেশি দেওয়া হয়। সে কারণেই এখন সারা পৃথিবীতে কনটেন্টগুলোর চাহিদা রয়েছে।
সামরিক শাসনের অবসানের পর দক্ষিণ কোরিয়ার সেন্সরশিপ আইন শিথিল করা হলে বিনিয়োগকারীরা চলচ্চিত্র ও টিভি সিরিজে বিনিয়োগে উৎসাহিত হন। ১৯৯৭ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতিতে ব্যাপক ধস নামে। তখন টিভি ড্রামা কোরিয়ার বাইরে পাঠানো শুরু করেন প্রযোজকেরা। সি জে এন্টারটেইনমেন্ট, অরিয়ন গ্রুপ ও লোট এন্টারটেইনমেন্টের হাত ধরে দাঁড়িয়ে যায় কোরিয়ান পপ কালচার। ১৯৯৮ সালে কিম ডি জুং ক্ষমতায় এসে কোরিয়ার সংস্কৃতি অঙ্গনের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৪৮ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করেন। সংস্কৃতির প্রচারণাকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব হিসেবে ঘোষণা করেন তিনি।
সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় একের পর এক সিনেমা বানিয়ে লাভের মুখ দেখতে থাকে দেশটি। প্রথমে এশিয়া, পরে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে কোরিয়ার জয়রথ। চলচ্চিত্রের বাইরে কোরিয়ান টিভি সিরিজ ও পপ গানও ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বজুড়ে, বিশেষ করে ‘গ্যাংনাম স্টাইল’ শোনেননি বা দেখেননি এমন লোক খুঁজে পাওয়া ভার। গত বছর কোরিয়ান সিরিজ ‘স্কুইড গেম’ বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তোলে।