আট বা আশি—বয়স যা-ই হোক না কেন, ভূতের গল্প কে না ভালোবাসে। ইদানীং দুনিয়ার নানা প্রান্তে নানা কিসিমের হরর সিনেমা, সিরিজ হচ্ছে; তবে দেশি ভূত নিয়ে খুব বেশি কাজ হয়নি। এবার দেশি ভূতের গন্ধ নিয়ে অ্যান্থোলজি সিরিজ ‘আধুনিক বাংলা হোটেল’ বানিয়েছেন কাজী আসাদ। ‘বোয়াল মাছের ঝোল’, ‘খাসির পায়া’ ও ‘হাঁসের সালুন’ মিলিয়ে তিন সপ্তাহে, তিন পর্বে এসেছে সিরিজটি। হ্যালোইন উপলক্ষে চরকিতে মুক্তি পাওয়া সিরিজটি তৈরি হয়েছে শরীফুল হাসানের গল্প অবলম্বনে। নাম শুনেই আন্দাজ করা যায় তিন পর্বের সঙ্গেই রয়েছে খাবারের যোগ। তো কেমন হলো ‘দেশি ভূত’-এর রান্না?
এক নজরেসিরিজ: ‘আধুনিক বাংলা হোটেল’স্ট্রিমিং: চরকিগল্প: শরীফুল হাসানপরিচালনা: কাজী আসাদঅভিনয়ে: মোশাররফ করিম, গাজী রাকায়েত, সালাহউদ্দিন লাভলু, শিল্পী সরকার অপু, এ কে আজাদ মেতু, রোবেনা রেজা জুঁই, নিদ্রা নেহা।
‘বোয়াল মাছের ঝোল’ বোয়ালিয়া গ্রামের গল্প। বোয়ালিয়া গ্রাম বিখ্যাত বোয়াল মাছের জন্য। কথিত আছে, সেখানে নাকি মানুষের সাইজের বোয়াল মাছ পাওয়া যায়! এই গ্রামের ছেলে আজিজের বাড়িতে বেড়াতে আসেন তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। আজিজের মায়ের হাতের বোয়াল মাছের ঝোল খাবার খুব শখ তাঁর। সেই বোয়াল মাছের ঝোল খেতে আসাই কি সবচেয়ে বড় ভুল ছিল তাঁর?
‘খাসির পায়া’ গল্পের পটভূমি শহুরে। ভিতু রফিক সাহেব ভয় পান বাসায় একা থাকতে। তাই কাজ শেষে সময় কাটাতে পার্কে হাঁটতে যান তিনি। সেখানে একটি ছোট্ট ছেলে এক অদ্ভুত আবদার করে, ‘স্যার, দুইশোডা ট্যাকা দ্যান, খাসির পায়া খামু।’ ছোট্ট ছেলের এই আবদারে পাত্তা দেন না রফিক সাহেব।
এই আবদার না রাখে কী বিপদে পড়েছিলেন রফিক সাহেব? অন্যদিকে ‘হাঁসের সালুন’-এ পাগল পাগল চেহারার মজু মিয়া ঘুরে বেড়ায় ঘুঘুর ফাঁদ নিয়ে। আদপে এক ভয়ংকর খুনি সে। তবে প্রতিটি খুন করার পরেই তার দুটি জিনিস খাবার শখ জাগে—একটি হাঁসের সালুন, অন্যটি খুনের চেয়েও ভয় ধরানো। শেষ পর্যন্ত কী হয় মজু মিয়ার? ঘুঘুর ফাঁদ নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে সে–ও কি অন্য কোনো ফাঁদে আটকে যায়? রোমাঞ্চকর তিনটি গল্পের পরিণতি জানা যায় ‘আধুনিক বাংলা হোটেল’-এ।
তিনটি পর্বেই প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন মোশাররফ করিম। তিনটি ভিন্ন চরিত্রে তাঁর দুর্দান্ত অভিনয় এই সিরিজের প্রধান রসদ। তাঁর অভিনয়, অভিব্যক্তি সিরিজটিকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে। অনেক সাদামাটা দৃশ্য বা সংলাপ ভিন্ন মাত্র পেয়েছে কেবল মোশারফরের কারণে। সিরিজের আরেকটি বড় প্রাপ্তি গ্রাম।
প্রথম পর্ব ‘বোয়াল মাছের ঝোল’-এ যেভাবে গ্রামীণ পরিবেশকে তুলে ধরা হয়েছে, তা স্মৃতিমেদুর ছেলেবেলার কথা মনে করিয়ে দেবে। প্রথম দৃশ্যের সেই বিশাল বড় গাছের নিচে গাজী রাকায়েত যখন আনমনে বলে ওঠেন, ‘শিখর ভুলে শিকড় ভজো’, তখন এই গাছটাকেই একটা চরিত্র মনে হয়। ধীর চরিত্র নির্মাণ, সংলাপ আর গল্পের পরিবেশই যেন গল্পে ভৌতিক আবহ ফুটিয়ে তোলে, নির্মাতা নজর দিয়েছেন সেদিকে। তাই এ গল্পে কোনো ভৌতিক সাউন্ড বা জাম্পস্কেয়ার ব্যবহার করেননি। এ পর্বে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছেন মোশাররফ করিম ও গাজী রাকায়েত। মাঝির সঙ্গে গাজী রাকায়েতের কথোপকথন বা শেষ দৃশ্যে মোশাররফ করিমের হাসি পর্বটি অন্য মাত্রায় নিয়ে যায়।
‘খাসির পায়া’ সাউন্ড আর ভিএফএক্সের ব্যবহারে প্রথম দিকে বেশ ভালোই জমে উঠেছিল। তবে নির্মাতা শেষ পর্যন্ত সেটা ধরে রাখতে পারেননি। প্রথম পর্বে যেখানে গল্পটাই ভয় ছড়িয়ে দিয়েছিল, দ্বিতীয় পর্বের গল্প যেন বলাই হলো না ঠিকভাবে। তবে মোশাররফ করিমের অভিনয় অনেক কিছুই ভুলিয়ে দেয়। তাঁর সঙ্গে মাত্র একটি সংলাপনির্ভর চরিত্রে খুদে অভিনেতা ফাহিমও দারুণ অভিনয় করেছেন।
তিন পর্বের সিরিজের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর পর্ব সম্ভবত ‘হাঁসের সালুন’। পাগলাটে চেহারার ধূর্ত দৃষ্টির মজু মিয়াকে মোশাররফের চেয়ে ভালো আর কে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন! এই পর্বে নির্মাতা আবার ফিরে গিয়েছিলেন গ্রামীণ পটভূমিতে। দায়িয়েন ড্যানির চিত্রগ্রহণ ছিল অসাধারণ। রংবেরঙের কাপড়, গান, মাটির চুলায় রান্না, গ্রামীণ পরিবেশে নির্বাচনী প্রচারের মধ্যেই চলে এক ক্রমিক খুনির গল্প। এই পর্বে মোশাররফ করিমের সঙ্গে দারুণ অভিনয় করেছেন নিদ্রা নেহা। চরিত্র ছোট হলেও শিল্পী সরকার অপু, সালাউদ্দিন লাভলুর অভিনয়ও ছাপ রেখে গেছে। এ পর্বের সিরিয়াল কিলারের ভয় হার মানিয়েছে ভূতের ভয়কে।
পরিচালক হিসেবে প্রথম কাজ দিয়েই নজর কেড়েছেন কাজী আসাদ। এই সিরিজ কিন্তু আপনাকে ভয় পাওয়াবে না, পরিচালকের উদ্দেশ্যও সেটা ছিল না। তিনি চেয়েছেন আয়েশ করে একটা গল্প বলতে।
এই সিরিজের অনেকে কিছুই আপনি আগেই অনুমান করতে পারবেন। তবে শেষটা জানা থাকলেও গল্প বলার লোভে পড়লে তো আর কিছুই মনে থাকে না। হিংসা, লোভ, আতঙ্ক, একাকিত্বের সঙ্গে ভয়ের উপাদান মিশিয়েছেন নির্মাতা; দেশি ভূতের ‘রান্না’ কী আর ভালো না হয়ে পারে!
দিন শেষে গল্পগুলো আমাদের চারপাশের। কোনো গল্প আমাদের নিয়ে যায় শেকড়ে, কোনো গল্প দেখে হয়তো পার্কে হাঁটতে গেলে গা ছমছম করে উঠবে। আবার কোনোটা নাড়া দেয় বিশ্বাসে। তাই ‘আধুনিক বাংলা হোটেল’-এ ঢুকলে সব খাবারই খেয়ে উঠতে হবে। কারণ, দেশি ভূতের গল্পের সঙ্গে বাংলা খাবারের এমন রেসিপি মেলা ভার!