বাংলা ভাষার কনটেন্ট নিয়ে চারদিকে মাতামাতি। এই তালিকায় যোগ হলো রটারড্যাম উৎসবও। প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের কোনো ওটিটি প্ল্যাটফর্মের কনটেন্ট রটারড্যাম চলচ্চিত্র উৎসবে অফিশিয়াল মনোনয়ন পেয়েছে। বলছি, নুহাশ হুমায়ূন পরিচালিত চরকি অরিজিনাল অ্যান্থোলজি সিরিজ ‘পেট কাটা ষ’র কথা। সিরিজের ১১০ মিনিটের সিনেমা সংস্করণের আন্তর্জাতিক প্রিমিয়ার হয়েছে এই চলচ্চিত্র উৎসবে।
এরই মধ্যে এ উৎসবে যোগ দেওয়ার জন্য পরিচালক নুহাশ হুমায়ূন ও চরকির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রেদওয়ান রনি নেদারল্যান্ডসের রটারড্যামে পৌঁছেছেন। ১ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় সময় রাত সাড়ে ৯টার দিকে সিনেরামা হলে হয়েছে ‘ষ’র প্রথম প্রদর্শনী। হেলেন ওয়েস্টরিকের সঞ্চালনায় হলভর্তি দর্শকের মধ্যে পরিচালক নুহাশ ও প্রযোজক রেদওয়ান রনিকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। সিনেমা শেষে দর্শকের সঙ্গে প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নেন নুহাশ।
সিনেমা দেখে দারুণ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন দর্শকেরা। পরিচালকের কাছে তাঁদের ভালো লাগার কথাও ব্যক্ত করেন। সঞ্চালক হেলেন স্মারকস্বরূপ রটারড্যামের লোগো ‘টাইগার’ (আদতে যা চকলেট) নুহাশের হাতে তুলে দেন। নুহাশ হুমায়ূন বলেন, ‘এটা আমার জন্য যেমন আনন্দের, দেশের জন্যও গৌরবের। বর্তমানে স্থানীয় কনটেন্ট বিশ্বের দর্শক যে গ্রহণ করছেন, এটা একটা বড় আশার বিষয়। পুরো সিনেমার মধ্যে দর্শকেরা খুবই সংযুক্ত ছিলেন; উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছিলেন। যেখানে যেমন প্রতিক্রিয়া দেওয়ার, তেমনই দিচ্ছিলেন।’
‘আমি আসলে এমন ভূতের গল্প আগে দেখিনি। যা কিছু দেখেছি, তার সঙ্গে এখন যা দেখলাম, তার কোনো মিল নেই। এটা অচেনা দেশের, অচেনা জনপদের গল্প। কিন্তু তবু যে গল্পটা আমাকে ছুঁয়ে গেল, ভয় দেখাল, হাসাল; এ জন্যই তো আমরা বলি, সিনেমা ট্রান্সেন্ডস বর্ডার (সিনেমা সীমানা পেরিয়ে যাবেই), নাকি?’, বক্তার নাম পিটার ভন ডিক। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব রটারড্যামে বাংলাদেশি ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম চরকির ‘পেট কাটা ষ’ দেখার অনুভূতি জানাচ্ছিলেন তিনি।
বেলজিয়াম থেকে আন্তর্জাতিক উৎসবে যোগ দিতে এসেছেন চলচ্চিত্র সমালোচক ও গবেষক অ্যানা উবস। ‘পেট কাটা ষ’ সম্পর্কে বলতে গিয়ে অ্যানা প্রথমেই বললেন শিকড়ে ফেরার কথা, ‘এ সিনেমা শুধু ভূতের কথা ও ভয়ের কথা বলেনি। ভূত ও ভয়ের শিকড়ে পৌঁছানোর চেষ্টাও করেছে। আর এর গল্পটা যেহেতু পরিচালকের নিজ দেশের সংস্কৃতি ও বিশ্বাসের কথা বলছে, আমি মনে করি, নির্মাতা তাঁর নিজের শিকড়ের গল্পটাও বলার চেষ্টা করেছেন।’
প্রদর্শনী শেষে ছিল ২০ মিনিটের প্রশ্নোত্তর পর্ব। এ সময় উপস্থিত দর্শকদের নানা প্রশ্নের উত্তর দেন পরিচালক নুহাশ হুমায়ূন। সেখানেও বারবার উঠে আসে ভূতের গল্পগুলোর শিকড়ের কথাই। এক দর্শকের প্রশ্ন ছিল, গল্পগুলো খুঁজে পেতে কী ধরনের গবেষণা করতে হয়েছে? উত্তরে নুহাশ জানালেন, যে গল্পগুলো বড়দের মুখে মুখে শুনে তিনি বড় হয়েছেন, সে গল্পগুলোই তিনি নতুন করে বলতে চেয়েছেন। তবে বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কথা বলে তাদের কুসংস্কার, শৈশব থেকে শুনে আসা ভয়ের গল্পগুলো জানারও চেষ্টা করেছেন তিনি।
প্রশ্নোত্তর পর্বে দারুণ প্রশংসিত হয় সিনেমাটির আবহ সংগীতও। দর্শকেরা জানতে চান এমন ‘ইউনিক’ শব্দশৈলী তৈরির পেছনের গল্পটাও। নুহাশ জানান, অ্যান্থলজির প্রতিটি গল্পের প্রতিটি আবহ সংগীতই দক্ষিণ এশিয়ার কোনো একটি বাদ্যযন্ত্রকে ‘সি মাইনরে’ বাজিয়ে তৈরি করা হয়েছে। কোথাও ব্যবহৃত হয়েছে শুধু হারমোনিয়াম, কোথাও মন্দিরা।
মন্দিরার টুং টাং, পুতুলনাচের গাজি, চমচমের ঘ্রাণ ও সমুদ্রের নোনা বাতাস—বাংলাদেশের একেবারে নিজস্ব কিছু উপকরণ, বাঙালির নিজস্ব কিছু গল্প এভাবেই নুহাশ হুমায়ূন পৌঁছে দিলেন বৈশ্বিক জনপদের কাছে। ইউরোপের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক এই উৎসবে বহু দেশের, বহু ভাষার মানুষের সঙ্গে বসে বাংলাদেশের, বাংলা ভাষার কাজ দেখার আনন্দ তো অবশ্যই অতুলনীয়।
আমি আসলে এমন ভূতের গল্প আগে দেখিনি। যা কিছু দেখেছি, তার সঙ্গে এখন যা দেখলাম, তার কোনো মিল নেই। এটা অচেনা দেশের, অচেনা জনপদের গল্প। কিন্তু তবু যে গল্পটা আমাকে ছুঁয়ে গেল, ভয় দেখাল, হাসাল; এ জন্যই তো আমরা বলি, সিনেমা ট্রান্সেন্ডস বর্ডার (সিনেমা সীমানা পেরিয়ে যাবেই)
আজ বিকেল সাড়ে চারটায় ল্যানটারভ্যানস্টারে হয় ‘ষ’-এর এর দ্বিতীয় শো। চরকির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রেদওয়ান রনি বলেন, নুহাশ হুমায়ূন ও ফেস্টিভ্যাল প্রোগ্রামারদের ধন্যবাদ বাংলাদেশের জন্য এ রকম গৌরব বয়ে এনে দেওয়ার জন্য। বাংলাদেশের নতুন, তরুণ ও নবীন নির্মাতাদের জন্য এটা একটা উদাহরণ হয়ে থাকবে। চরকি মেড ইন বাংলাদেশ ফর দ্য ওয়ার্ল্ড—যে মোটো নিয়ে এগিয়ে চলেছে, এটা সেই পদক্ষেপে একটি মাইলফলক।
‘ষ’র পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘শবনম’-এর দুটি শো অনুষ্ঠিত হয়েছে এই উৎসবে। পরিচালক ঋতু সাত্তার শোর সময় উপস্থিত ছিলেন। তিনিও দর্শকদের প্রশ্নের উত্তর দেন। ২৫ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া এই উৎসব চলবে ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। ইউরোপের যতগুলো সম্মানজনক চলচ্চিত্র উৎসব রয়েছে, রটারড্যাম তার মধ্যে অন্যতম।
এবারের আয়োজনে প্রদর্শিত হচ্ছে ৭১ দেশের ৪০০টির বেশি চলচ্চিত্র।
ভৌতিক ঘরানার চারটি ভিন্ন গল্প নিয়ে তৈরি হয়েছিল চরকি অরিজিনাল অ্যান্থোলজি সিরিজ ‘পেট কাটা ষ’—‘এই বিল্ডিংয়ে মেয়ে নিষেধ’, ‘মিষ্টি কিছু’, ‘লোকে বলে’ ও ‘নিশির ডাক’। মুখে মুখে প্রচলিত বিভিন্ন কুসংস্কার, লোককথার প্রেক্ষাপটে বর্তমান আবহে তৈরি এই সিরিজ। এতে অভিনয় করেছেন আফজাল হোসেন, চঞ্চল চৌধুরী, কাজী নওশাবা আহমেদ, সোহেল মণ্ডল, শিরিন আক্তার শিলা, মোরশেদ মিশু, সাঈদা তাসলিমা, প্রীতম হাসান ও মাসুদা খান।