শৌচাগারে একের পর এক নারীর আত্মহত্যা, রহস্য সমাধানে হিমশিম অবস্থা পুলিশের

‘দাহাড়’–এর পোস্টারে সোনাক্ষী সিহনা
ইনস্টাগ্রাম

ওটিটি প্ল্যাটফর্ম আসার পর সারা দুনিয়ায় অনেক থ্রিলার সিরিজ হয়েছে; এর মধ্যে বড় অংশ পুলিশি তদন্ত নিয়ে। ‘পাতাল লোক’, ‘সুরাল: দ্য ভোটক্স’ থেকে ‘ভাধান্ধি: দ্য ফ্যাবল অব ভ্যালোনি’—ভারতেও এমন সিরিজ কম নয়। এ তালিকার সর্বশেষ সংযোজন ‘দাহাড়’।

১২ মে অ্যামাজন প্রাইমে মুক্তির পর থেকে সিরিজটির প্রশংসায় দর্শক-সমালোচকেরা। কিন্তু কী এমন আছে এ সিরিজে? যা হালে মুক্তি পাওয়া অন্য ভারতীয় সিরিজের থেকে এটিকে আলাদা করেছে?

‘দাহাড়’–এর একটি দৃশ্য

শৌচাগারে আত্মহত্যা
রাজস্থানের ছোট্ট একটি গ্রাম। মূলত এ অঞ্চলে দরিদ্র মানুষের বসতি, যাদের বেশির ভাগ নিম্নবর্ণের হিন্দু। আপাতদৃষ্টে নিরুত্তাপ গ্রামটিতে হঠাৎ আসে এক তরুণীর লাপাত্তা হওয়ার খবর। এসব অঞ্চলে তরুণী লাপাত্তা হলে পরিবারের মানুষের মধ্যে অন্য সন্দেহ ভর করে—অন্য জাতের কারও সঙ্গে পালায়নি তো! এ ক্ষেত্রে জাত ‘রক্ষায়’ পরিবারের সদস্যদের হাতে ছেলে ও মেয়ের খুন হওয়ার ঘটনা কম নয়। এমন গল্প নিয়ে এর আগে নির্মিত মারাঠি সিনেমা ‘সাইরাত’ সুপারহিট হয়েছিল। তবে ‘দাহাড়’-এর গল্প হাজির করা হয়েছে থ্রিলারের মোড়কে, রোমান্টিক গল্পের মধ্য দিয়ে নয়।

রাজস্থানের যে গ্রামে এক তরুণীর লাপাত্তা হওয়ার খবর আসে, সেখানে পাওয়া যায় আরও তরুণীর ‘উধাও’ হওয়ার খবর। সবার ক্ষেত্রে গল্পটা এক—একটি চিঠি রেখে বাড়ি থেকে পালিয়েছেন তাঁরা। তবে গল্প নতুন মোড় নেয়, যখন এক তরুণীর লাশ মেলে মর্গে। খুঁজতে গিয়ে পাওয়া যায় এমন আরও ২৭ তরুণীর খবর। সবাই পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেছেন। সবারই লাশ মিলেছে পাবলিক টয়লেট বা গণশৌচাগারে!

রীমা-যোয়া জুটির বাজিমাত
ভারতের প্রশংসিত নির্মাতা, চিত্রনাট্যকার জুটি রীমা কাগতি ও যোয়া আখতার। আগে ‘জিন্দেগি না মিলেগি দোবারা’, ‘গলি বয়’, ‘মেড ইন হ্যাভেন’-এর মতো সিনেমা ও সিরিজ এসেছে তাঁদের হাত ধরে।

রীমা কাগতি ও যোয়া আখতারের সঙ্গে সোনাক্ষী সিনহা

এবার তাঁরা হাজির ‘দাহাড়’ নিয়ে। আট পর্বের সিরিজটির ক্রিয়েটর তাঁরা, রিতেশ শাহর সঙ্গে চিত্রনাট্য লিখেছেন যোয়া ও রীমা। পরিচালনা করেছেন রীমা কাগতি ও রুচিকা ওবেরয়।

‘দাহাড়’-এর এত প্রশংসার কারণ প্রচলিত অন্য অনেক ওয়েব সিরিজের মতো এখানে বাড়তি রংচং মেশানো হয়নি, জাতবৈষম্য ও নারী-পুরুষের বৈষম্য যতটা সম্ভব বাস্তবসম্মতভাবে তুলে এনেছেন নির্মাতারা। ভারতের ‘লাভ জিহাদ’ নিয়ে যাঁরা খোঁজখবর রাখেন, তাঁরা জানেন ‘দাহাড়’-এর গল্পটি কেন রাজস্থানকে কেন্দ্র করে। ভারতের এই রাজ্যের সঙ্গে গল্পটি ভালোভাবে মিলে যায়, আরোপিত মনে হয় না। তবে সমাজের বাস্তব ঘটনা তুলে ধরতে গিয়ে তথ্যচিত্র হয়ে যায়নি ‘দাহাড়’, আবার পুলিশি তদন্ত দেখাতে অতি নাটকীয় বা একের পর টুইস্ট দিয়ে দর্শক ধরে রাখার চেষ্টাও হয়নি; বরং গল্পটি বলেছেন গল্পের মতো করে। তাই থ্রিলারে অভ্যস্ত দর্শকের কাছে হয়তো সিরিজটিতে টান টান ব্যাপার নেই; গল্প, বিভিন্ন চরিত্রদের দুর্দান্ত গাঁথুনি ও তাদের সুখ-দুঃখ মিলিয়ে সিরিজটি হয়ে উঠেছে দারুণ এক ড্রামা।

সংবাদ সম্মেলনে ‘দাহাড়’–এর অভিনয়শিল্পীরা

‘দাহাড়’ এক ক্রমিক খুনিকে ধরার গল্প। তবে খুনি কে, তা দেখিয়ে দেওয়া হয় প্রথমেই! এরপরও প্রায় আট ঘণ্টার শো যে দর্শক দেখতে বাধ্য হন, তা সিরিজের পাত্রপাত্রীদের সঙ্গে মিশে যান বলেই। শৌচাগারে আত্মহত্যার ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ক্রমিক খুনিকে ধরতে পুলিশের মরিয়া চেষ্টা, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক টানাপোড়েন মিলিয়ে চোখ আটকে থাকে পর্দায়। ‘দাহাড়’ ধীরলয়ের সিরিজ, চরিত্রের গাঁধুনি, সংলাপ, সামাজিক ও রাজনৈতিক বক্তব্যের দিকে মনোযোগী হয়ে যারা রস আস্বাদন করতে চান; তাঁদের ভালো না লেগে উপায় নেই।

সোনাক্ষী মনে করিয়ে দিলেন সোনাক্ষীকেই
সোনাক্ষী সিনহাকে চেনেন? বাণিজ্যিক সিনেমার নিয়মিত দর্শকদের বেশির ভাগ হয়তো বলবেন, ‘দাবাং’-এর নায়িকা। ‘দাহাড়’-এর মতো সিরিজের প্রধান চরিত্র এস আই অঞ্জলী ভাটির চরিত্র করেছেন তিনি। বাণিজ্যিক ছবির খোলস ছেড়ে দর্শক যেন এক অন্য সোনাক্ষীকে পেয়েছেন। ‘রাফ অ্যান্ড টাফ’ নারী পুলিশ কর্মকর্তার চরিত্র দিয়ে ওটিটিতে অভিষেকটা মনে রাখার মতোই হলো তাঁর।

সংবাদ সম্মেলনে সোনাক্ষী সিহনা

সিরিজের বাঘা বাঘা অভিনেতার মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল সোনাক্ষীর অভিনয়। তাই ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা অভিনয় করেও অন্য শিল্পীদের সঙ্গে তুলনা করলে সোনাক্ষী কখনো প্রায় সমান, কখনো কিছুটা পিছিয়ে। বিশেষ করে যেসব দৃশ্যে সংলাপ ছিল না, কেবল ‘বডি ল্যাঙ্গুয়েজ’ দিয়ে অভিনয় করতে হয়েছে, সেসব দৃশ্য সোনাক্ষীর দুর্বলতা চোখে পড়ে। তবে ‘দাহাড়’-এর সোনাক্ষী মনে করিয়ে দিয়েছেন বিক্রমাদিত্য মোতওয়ানির ‘লুটেরা’র সোনাক্ষীকে। সংবেদনশীল, আবেগময় সেই চরিত্রে নিজেকে পুরোপুরি ভেঙেছিলেন তিনি, ভেঙেছেন এবারও। তবে ‘দাহাড়’-এর চেয়ে ‘লুটেরা’র সোনাক্ষী কিছুটা হলেও এগিয়ে থাকবেন।

বিজয় ভার্মা আর গুলশান দেবাইয়া
‘দাহাড়’-এ অনেক চরিত্র, প্রত্যেকের পরিবার মিলিয়ে একসঙ্গে এত অভিনয়শিল্পীকে দেখাও চোখের আরাম। পুলিশ কর্মকর্তা গুলশান দেবাইয়াকে দেখে আফসোস হবে, কেন যে তিনি নিয়মিত কাজ করেন না! এমন চরিত্রে করবেন বলেই হয়তো নিজের সেরাটা জমিয়ে রাখেন।

সংবাদ সম্মেলনে ‘দাহাড়’–দুই অভিনয়শিল্পী সোনাক্ষী সিনহা ও বিজয় ভার্মা

ক্রমিক খুনির চিত্রে বিজয় ভার্মাও দুর্দান্ত। গত বছর আলিয়া ভাটের সঙ্গে ‘ডারলিংস’ দিয়ে রাতারাতি পরিচিতি পান অভিনেতা। ‘দাহাড়’-এর কাজ নিঃসন্দেহে তাঁকে আরও এক ধাপ এগিয়ে দেবে। তবে ‘ডারলিংস’-এর চরিত্রের সঙ্গে এ সিরিজের চরিত্রে কিছুটা সামঞ্জস্য আছে। এ অঞ্চলের যা রীতি—কেউ এক চরিত্রে জনপ্রিয় হলেও একই ধরনের চরিত্রের প্রস্তাব আসতে থাকে; অনেক ক্ষেত্রে নিরুপায় অভিনেতাও রাজি হয়ে যান। বিজয় নিশ্চয়ই সামনে অন্য অবতারে হাজির হবেন। এ ছাড়া এস আই কৈলাম পারঘি চরিত্রে সোহম শাহও ফাটিয়ে দিয়েছেন।

থ্রিলারের চেয়েও বেশি কিছু
‘দাহাড়’-এর গল্প নতুন কিছু নয়, এ ধরনের অনেক থ্রিলার রয়েছে। তবে শোটি বিশেষত্ব পেয়েছে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স আর রাজস্থানের স্থানীয় বিষয়গুলো দুর্দান্তভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য। শোটির কোনো চরিত্রকে নায়কোচিত করা হয়নি। প্রথম কয়েকটি পর্বে সমাজ, জীবন, নারী ও পুরুষ সম্পর্কে স্থানীয় মানুষের ভাবনা তুলে ধরা হয়েছে।
গুলশান দেবাইয়া বা সোহম শাহর চরিত্রটিরও বিভিন্ন স্তর দেখানো হয়েছে। প্রথমজন সৎ পুলিশ কর্মকর্তা হলেও স্ত্রীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কের সময়ও কি সে নিজের সততা বজায় রাখতে পারে?

‘দাহাড়’–এর পোস্টারে বিজয় ভার্মা

অন্যদিকে বাবা হতে যাচ্ছে—এটা জানার পর সোহম শাহ অভিনীত চরিত্রটির বদল লক্ষণীয়। তবে সিরিজের প্রধান চরিত্র হলেও সোনাক্ষী সিনহার চরিত্রই বরং একমুখী, তাঁর পরিবারের গল্প সেভাবে দেখানো হয়নি। তাঁর মায়ের চরিত্রটি অপ্রয়োজনীয়।
এককথায় বলতে গেলে পারফরম্যান্সনির্ভর, ধীরগতির গল্প যাঁরা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে যান, তাঁদের জন্য চলতি মাসের সেরা ভারতীয় সিরিজ হতে পারে ‘দাহাড়’।

একনজরে
দাহাড়
ধরন: সিরিজ
পর্ব:
ক্রিয়েটর: যোয়া আখতার ও রীমা কাগতি
পরিচালনা: রীমা কাগতি ও রুচিকা ওবেরয়
স্ট্রিমিং: অ্যামাজন প্রাইম ভিডিও
অভিনয়ে: সোনাক্ষী সিনহা, বিজয় ভার্মা, গুলশান দেবাইয়া, সোহম শাহ
প্রিমিয়ার: বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসব
শুটিং লোকেশন: রাজস্থান, ভারত

‘দাহাড়’–এর পোস্টার