কোনো চরিত্রে ছিলেন না তিনি; হালকা গোঁফ-দাড়ি, নেভি ব্লু শার্ট, জিনসের প্যান্ট আর রোদচশমায় আপাদমস্তক পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় হয়েই এসেছিলেন। গতকাল রোববার বিকেলে ঢাকার প্রথম আলো কার্যালয়ে খোশমেজাজে পাওয়া গেল তাঁকে।হাজির হলেন বিনোদন বিভাগে। ‘বিনোদন’-এর সঙ্গে জমাটি আড্ডা দিলেন তিনি।
গত শনিবার তিনি ঢাকায় নেমেছেন, আজ সোমবার ভারতে ফিরে যাওয়ার কথা রয়েছে। ফেরার আগে দু–একটি কাজ নিয়ে প্রযোজকের সঙ্গে আলাপ সেরেছেন, তবে এখনই খোলাসা করেননি পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়।
ঢাকার সঙ্গে আপনার সম্পর্ক তো বেশ পুরোনো...
পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়: ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দুই বাংলার চলচ্চিত্রের যোগাযোগের ক্ষেত্রে আমি হয়তো কিছুটা ভূমিকা রাখতে পেরেছিলাম। ২০২০ সালে লকডাউন শুরুর পর বিদেশযাত্রা ব্যাহত হয়েছিল। ২০২৩ সাল থেকে আসা-যাওয়া বেড়েছে। ঢাকার বন্ধুরা কলকাতায় যাচ্ছেন, কলকাতা থেকেও আমরা আসছি। আশা করছি, আমরা একসঙ্গে অনেক কাজ করতে পারব।
গত তিন-চার বছরে বাংলাদেশে কাজের ধরন ও মানে বড় রকমের পরিবর্তন ঘটেছে। ওটিটি, চলচ্চিত্র ও গানে ভালো কাজ হচ্ছে। কোক স্টুডিওর গান কলকাতায় খুব জনপ্রিয়। একটা বিষয় স্পষ্ট, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে নিস্তব্ধ বিপ্লব কিছুটা হলেও ঘটে গেছে। হয়তো সেটা অর্থনৈতিকভাবে আমরা দেখতে পাচ্ছি না। বাংলাদেশের সিনেমা দুই বাংলার মানুষকে আলোড়িত করছে। এটা ভীষণ আনন্দের খবর।
ঢাকার কাজগুলো কী কী কারণে আলোচিত হচ্ছে বলে আপনি মনে করেন?
পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়: আজকের পৃথিবীতে মানুষ অদ্ভুতভাবে বাঁচছে। একজন মানুষ সবজি বিক্রেতাও হতে পারেন, তাঁর মুঠোফোনে পুরো পৃথিবী আছে। ১০–১৫ বছর আগে এই বাস্তবতা ছিল না। একধরনের দ্বৈত সত্তার জন্ম হয়েছে; অস্তিত্বের ধরনটাও নতুন হয়ে গেছে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র এই বিষয়গুলোকে আরও কাছ থেকে ধরছে বলে আমি মনে করি। বাংলাদেশে আরও অনেক বেশি সময় উপযোগী ও মানুষ উপযোগী কনটেন্ট হচ্ছে।
পৃথিবীতে প্রায় ৩০ কোটি বাঙালি রয়েছেন। এই বড় বাজার ধরা কতটা সম্ভব?
পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়: নিশ্চয়ই সম্ভব। আমার মনে হয়, বাঙালির বাজার ধরার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কনটেন্টই পথ দেখাচ্ছে ও দেখাবে। পশ্চিমবঙ্গের সিনেমায় কিছু গুণ আছে, সেটা অন্য ক্ষেত্রে সমাদৃত হবে। কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে দেখতে গেলে নিউইয়র্ক কিংবা মধ্যপ্রাচ্যে বাণিজ্যিকভাবে মুক্তি দিতে হবে, সেটা বাংলাদেশের ছবি দিয়ে করতে হবে।
কাদের দিয়ে এই বাজার সহজে ধরা যায়?
পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়: আমি একজনেরও নাম বলব না। যে ছবি সম্প্রতি আলোড়ন ফেলেছে, সেসবের নির্মাতারা যে খুব নামী পরিচালক, তেমনটা নয়। শিল্পীরাও তেমন কেউ নয়। সবাই যে শাকিব খান, দেব, জিৎ—এমনটা নয়। ওটিটিতে বটেই, বড় পর্দায় মানুষ কিন্তু কনটেন্টের দিকেই ঝুঁকছেন। বাংলা সিনেমা দেশের বাইরে সফল হওয়ার ক্ষেত্রে তারকাদের বিরাট ভূমিকা আছে কিংবা থাকবে বলে মনে হয় না। ভালো কনটেন্টের জোরেই ছবি চলছে ও চলবে, আমার বিশ্বাস।
স্রেফ গল্পের জোরেই কনটেন্ট দেখার এই প্রবণতা কবে থেকে দেখছেন?
পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়: এটার পেছনে ওটিটির বিরাট ভূমিকা আছে। ওটিটিতে মানুষ অনেক কিছু দেখতে শুরু করার পর থেকে এই পরিবর্তন আসছে। কেউ যখন স্প্যানিশ সিরিজ, টার্কিশ সিরিজ দেখছেন, সেটা আটকাচ্ছে কি? আটকাচ্ছে না। সে জন্য আমার মনে হয়, গল্পের প্রতি মানুষের লোভটা ওটিটি ভীষণভাবে পরিবর্তন করেছে। আগে থেকেই এই পরিবর্তন হচ্ছিল, অতিমারির সময় সেই পরিবর্তনের পারদটা আরও বেশি চড়েছে। তার মানে তারকারা অচল হয়ে গেছে? নাহ্, আমি সেটা বলছি না। আজও শাকিব খান, দেবের নামে প্রচুর লোক ছবি দেখতে যায়। কিন্তু আমার কোথাও একটা মনে হয়, সেটার সঙ্গে এখন একটা যোগ হয়েছে যে আমাকে যা দেবে, আমি তা–ই দেখব না কিন্তু। কোথাও একটা ফিল্টার কাজ করে।
তারকাখ্যাতিরও ভূমিকা তো থাকে; সেটা শাহরুখ খানের তিনটা সিনেমায় দেখা যায়...
পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়: হিন্দির ব্যাপারটা আলাদা। হিন্দি সিনেমা যেভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, তার পেছনে যতটা গল্প আছে, তার চেয়েও বেশি স্টারডম আছে। শাহরুখ খান না হলে অন্য কেউ হলে সেটা কী হতো, আমি জানি না। তবে বাংলা সিনেমার ক্ষেত্রে কনটেন্টটা আরও বড় ভূমিকা পালন করবে। দক্ষিণ ভারতীয় ছবি এখন খুব জনপ্রিয়। আমরা ভাবি, প্রভাস, দুলকার সালমান, ফাহাদ ফাসিলের ছবি এলেই হিট হচ্ছে। আসলে তা কিন্তু নয়। এদের অনেক সিনেমা আসে, সেগুলো আমরা জানতেও পারি না। যে কনটেন্টগুলো মানুষের পছন্দ হয়, সেগুলো আমরা জানতে পারি। অবশ্যই দুলকার সালমান, প্রভাসের প্রতি ভালোবাসা আছে। কিন্তু দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমার রজনীকান্ত, মামুট্টিকে বাদ দিয়ে বাকি ছবিগুলো কনটেন্ট বেছেই সিনেমা দেখছে।
শুনেছি, আপনি একবার শাহরুখ খানের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। সাক্ষাৎকার নেওয়ার অভিজ্ঞতাটা একটু জানতে চাই...
পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়: গত তিন–চার বছরে অনেক বেশি কাজ করি। বোম্বের সঙ্গে সম্পর্ক, সবাই চেনে আমাকে। কিন্তু যখন আমি ইন্টারভিউটা নিয়েছিলাম, তখন আমি নেহাতই একজন বাঙালি অভিনেতা ছিলাম। তখন এতটা পরিচালনাও করতাম না। ২০১৪ সালে শাহরুখ খান একটি সিনেমার প্রচারে কলকাতায় এসেছিলেন। কলকাতার একটি পত্রিকার আমন্ত্রণে আমি সাক্ষাৎকারটা নিই। উনি বসে যখন আপনার সঙ্গে কথা বলছেন, তখন আপনার মনে হবে, আপনি ওনার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। মন দিয়ে প্রতিটা কথা শুনছেন, শুনে উত্তর দিচ্ছেন। আমাকে এতটা গুরুত্ব না দিলেও ওনার চলত। এতে বোঝা যায়, কেন একজন মানুষ শুধু অভিনেতা হিসেবেই তারকা নন। সফল ব্যবসায়ী, মুম্বাইয়ে আজ পর্যন্ত শাহরুখ খানকে নিয়ে কোনো টেকনিশিয়ান, সহশিল্পী, প্রযোজককে খারাপ কথা বলতে শুনিনি। সবাই বলেন, উনি একটু আলাদা। তিনি কিংবদন্তি। আমার মনে হয় না আমরা আরেকটা শাহরুখ খান তৈরি করতে পারব। ওনার থেকে ভালো অভিনেতা আসবে না? অবশ্যই আসবে। এত বড় তারকা পাওয়া মুশকিল আছে। ভারতের এত বড় অ্যাম্বাসেডর বিশ্বের কাছে আর আছে বলে মনে হয় না।
কলকাতার দর্শকদের রুচি নিয়ে একধরনের ধারণা আছে, তাঁরা একটু অন্য ধরনের সিনেমা দেখতে পছন্দ করেন...
পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়: পশ্চিম বাংলার বাঙালি দর্শক যে ধরনের ছবি দেখতে পছন্দ করছে, সেটা হয়তো আমরাই কিছুটা অভ্যাস করিয়েছি। তাতে দেখা যাচ্ছে, মানুষ ছবি দেখতে হলে যাচ্ছে। কিন্তু একই ধরনের সিনেমা, হয় গোয়েন্দা গল্পভিত্তিক কিংবা পারিবারিক ড্রামাভিত্তিক সিনেমা। দর্শককে দোষ দেওয়ায় বিশ্বাস করি না। আমাদের কাছে কোনো উপযুক্ত বিকল্প নেই, তাই একই জিনিস দেখছি। বিকল্প কিছু দিতে পারলে তারা দেখবে। সেটা দেওয়ার জন্য লেগে থাকতে হবে। আমরা খুব আধুনিকমনস্ক ছবি কি দিতে পেরেছি? আমরা পারিনি। আমরা গোয়েন্দা গল্প, ফ্যামিলি ড্রামাটা ভালো করে বানাতে পেরেছি। আমরা একটা ধুন্ধুমার অ্যাকশন দিতে পেরেছি? পারলে সেটা দেখতেন। আমরা পারিনি।
অ্যাকশন সিনেমা খুব বেশি হচ্ছে না, বিকল্পধারার সিনেমারও একই দশা। আগে কলকাতার সিনেমা বাইরের ফেস্টিভ্যালে যেত। এখন দক্ষিণ ভারতের সিনেমা যাচ্ছে...
পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়: আর্টহাউস সিনেমা একেবারে বেহাল। একটা কারণ মনে হয়, আর্টহাউস সিনেমা হলে খুব একটা সফল হতো, এমনটা নয়। কিন্তু তৈরি হতো, একধরনের পৃষ্ঠপোষকতা ছিল। কিছু লোক হলেও দেখতে আসতেন। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা অনেকটা বন্ধ হয়ে গেছে। একশ্রেণির দর্শক অনেকেই কলকাতার বাইরে গিয়ে থিতু হয়েছেন। তাঁরা সিনেমা দেখতে চান, তাঁরা ফেরত আসেন শুধু শীতকালে পরিযায়ী পাখির মতো।
শিক্ষিত সমাজের বড় অংশ পশ্চিম বাংলা ছেড়ে বাইরে থাকে। আমরা মধ্যবর্তী সময়ে আছি। পরবর্তী প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে, তারা কী দেখতে চাইছে, সেটা বুঝে ওঠার চেষ্টা করছি। তাদের পছন্দের সিনেমা দেওয়ার আগে নিরাপদ হলো, ফ্যামিলি ড্রামা ও গোয়েন্দা গল্প। ধাঁচটাকে ভাঙতে হবে। একবার হবে না, দুবার-তিনবারে হবে। ভেতরে–ভেতরে ভীষণভাবে শুরু হয়েছে। অনেকে আবারও বাণিজ্যিক সিনেমাকে দাঁড় করাতে চাইছেন। যেটা একসময় চলত, সেই ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে। হয়তো বছর দুয়েকের মধ্যে প্রতিফলন দেখতে পাব।