ওটিটি প্ল্যাটফর্ম দেশের বিনোদনে নতুন সংযোজন। প্রতিনিয়ত এর প্রসার ঘটেছে। এতে নানা ধরনের কনটেন্ট উপভোগের সুযোগ পান দেশ-বিদেশের গ্রাহকেরা। ওটিটি পুরোপুরি নির্ভরশীল ইন্টারনেটের ওপর। দেশের চলমান পরিস্থিতির কারণে টানা পাঁচ দিন দেশে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ ছিল। এতে ক্ষতি হয় দেশীয় ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো। গত মঙ্গলবার রাতে স্বল্প পরিসরে ইন্টারনেট সেবা চালু হলেও ওটিটি মাধ্যমগুলোর কার্যক্রম চালু সম্ভব হয়নি। ওটিটি প্ল্যাটফর্মের আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির খবর নিয়েছেন মনজুর কাদের
ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম চরকি প্রতিষ্ঠার তিন বছর পেরিয়ে চারে পড়েছে। প্রতিবছর ১২টি করে ছবি মুক্তি দিয়েছে। এসেছে নতুন নতুন সিরিজও। প্রতিনিয়ত নতুন সাবস্ক্রাইবার তৈরি হয়েছে চরকির। ইন্টারনেট সেবা না থাকায় অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি সাবস্ক্রাইবার কমার আশঙ্কা করছেন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রেদওয়ান রনি। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তিনি প্রথম আলোকে বললেন, ‘আমাদের ক্ষতির পরিমাণ ব্যাপক। আমাদের প্রতিষ্ঠান চরকি প্রতি মাসে একটা বড় কনটেন্ট রিলিজ করে, হোক তা সিনেমা কিংবা সিরিজ। এই সময়ের মধ্যেও আমাদের একটা সিনেমা মুক্তি দেওয়ার কথা ছিল। শেষ মুহূর্তে তা পারিনি। সব মিলিয়ে আমাদের মনে হয়েছে, ৫ থেকে ৭ কোটি টাকার ক্ষতি হয়ে গেছে, যেটা পুষিয়ে আনা কষ্টসাধ্য। সবকিছু আবার নতুন করে শুরু করতে হবে।’
চরকি থেকে ‘থার্টিসিক্স টোয়েন্টিফোর থার্টিসিক্স’-নামে একটি ওয়েব ফিল্ম মুক্তির কথা শোনা যাচ্ছিল। মুক্তির আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পুরোদমে প্রচারণাও চলছিল। ইন্টারনেট সেবা বন্ধ হওয়ায় সবকিছু থেমে গেছে। রনি বললেন, ‘আমাদের পুরোটা ক্লাউডনির্ভর সেবা। গত তিন বছরে আমরা যত কনটেন্টের ঘোষণা দিয়েছি, কোনো দিন এমন হয়নি যে সঠিক সময়ে তা মুক্তি দিতে পারিনি। এখন যে অবস্থা, তাতে তো পারছি না। মানুষের মধ্যে একটা অভ্যস্ততা তৈরি হয়েছিল। এটার তো অপরচুনিটি কস্ট আছে অনেক, যা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে বড় সময় লাগবে।’
এদিকে হইচই বাংলাদেশ থেকে আগস্টের প্রথম সপ্তাহে ‘রঙিলা কিতাব’ নামের একটি সিরিজ মুক্তি দেওয়ার কথা ছিল। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে প্রতিষ্ঠানটি। এদিকে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকার কারণে নিয়মিত যেসব কনটেন্ট হইচই প্ল্যাটফর্মে আছে, তা-ও গ্রাহকেরা দেখার সুযোগ পাচ্ছেন না। এতে ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতি হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটির। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে সে কথা বললেন প্রতিষ্ঠানটির কান্ট্রি ম্যানেজার সাকিব আর খান।
তিনি বলেন, ‘যে ব্যবসায়িক ক্ষতি এ কদিনে হয়েছে, তা কোনোভাবেই পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়।’ তিনি জানান, মুক্তির অপেক্ষায় থাকা সিরিজটি আগস্টের দ্বিতীয় বা তৃতীয় সপ্তাহের আগে মুক্তি দেওয়া সম্ভব হবে না। ডাবিং থেকে শুরু করে সব ঠিকঠাক হচ্ছিল, দেশের পরিস্থিতির কারণে এখন বন্ধ আছে। সাকিব আর খান বলেন, ‘আমরা তো সাবস্ক্রিপশননির্ভর ব্যবসা করি। দর্শক যত দেখবে, ততই ব্যবসা হবে। এখন যেহেতু গ্রাহক দেখার সুযোগ পাচ্ছেন না, তাই ব্যবসাও হচ্ছে না।’
অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতির পাশাপাশি নতুন সাবস্ক্রাইবার নিয়ে চিন্তিত সাকিব আর খান। তিনি বলেন, ‘আমার নতুন কোনো কনটেন্ট নাই। নতুন কনটেন্ট থাকলে প্রতিদিন শত শত সাবস্ক্রাইবার যোগ হয়। সব মিলিয়ে যেসব কনটেন্ট চলছিল, তাতে এতটুকু বুঝতে পেরেছি, ৩০ লাখ টাকার মতো ক্ষতি এই কদিনে আমাদের হয়েছে।’
অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতির পরিমাণ কত, সেটা উল্লেখ না করলেও এ কদিনে বেশ ভালোই ক্ষতি হয়েছে বলে জানালেন ওটিটি প্ল্যাটফর্ম আইস্ক্রিনের প্রকল্প পরিচালক চিত্রনায়ক রিয়াজ আহমেদ।
তিনি বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত তো অবশ্যই হয়েছি। অনেক রাজস্বও হারিয়েছি। ইন্টারনেট পুরোদমে খুলবে, সে ব্যাপারে নির্দিষ্টভাবে কিছুই জানতে পারিনি। তবে ঠিক হয়ে যাবে, এটা শুনতে পাচ্ছি। আমার মনে হয় যে এই ক্ষতি হয়তো আমরা পুষিয়ে নিতে পারব। এখন ইন্টারনেট সেবা যত দ্রুত সম্ভব চালু করা যায়, ততই ভালো। দেশের গ্রাহকেরাও কনটেন্ট দেখার সুযোগ আবার পাবেন।’ আইস্ক্রিনের এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দেশের বাইরে গ্রাহকেরা তাঁদের প্ল্যাটফর্ম থেকে নিয়মিত কনটেন্ট উপভোগ করতে পারছেন বলেও জানালেন।
ওটিটি প্ল্যাটফর্ম বঙ্গ গ্রাহকদের কথা ভেবে কয়েকটি নতুন কনটেন্ট মুক্তি দিয়েছে। এর মধ্যে আছে ‘কলকাতা ডায়েরিজ’, ‘রাজকুমার’, ‘লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন’, ‘ফিমেল ৪’। প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, মুক্তির তারিখ অনুযায়ী কোনো কনটেন্ট মাসখানেক আগে, আবার কোনোটি সংকট পরিস্থিতির দুই দিন আগে মুক্তি পেয়েছে। আবার সুমন আনোয়ার, রায়হান রাফী ও কাজল আরেফিন অমির মতো নির্মাতাদের নিয়ে নতুন কাজের চুক্তিও সেরেছেন।
প্ল্যাটফর্মটির চিফ কনটেন্ট অফিসার মুশফিকুর রহমান গতকাল দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাসখানেকের মধ্যে নতুন কয়েকটি কনটেন্ট মুক্তির কারণে আমাদের ক্ষতিটাই একটু বেশি। যদি শুধুমাত্র ওটিটির কথা বলি, তাহলে প্রতিদিনই আমাদের ৮-১০ লাখ টাকা ক্ষতি হচ্ছে।’
বঙ্গ থেকে জানানো হয়েছে, ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ছাড়াও এই প্রতিষ্ঠান সফটওয়্যার সেবাও দিয়ে থাকে। ইউটিউব আর ফেসবুক মিলিয়ে দুই শতাধিক পেজ ও চ্যানেলকেও সেবা দিয়ে থাকে বঙ্গ। ইন্টারনেট বন্ধ মানে তাদের সব ধরনের সেবা বন্ধ আছে। মুশফিক এ–ও বললেন, ‘পুরোদমে ইন্টারনেট চালু না হলে আমাদের কার্যক্রমও পুরোদমে চালু সম্ভব না। আমাদের কনটেন্ট সম্পর্কে মানুষকে জানানোর সবচেয়ে বড় মাধ্যম সোশ্যাল মিডিয়া, ইন্টারনেট চালু না থাকলে এসব চলবে না। সবকিছুই চালু হতে হবে। ওটিটি এবং আমাদের ইন্টারনেটভিত্তিক অন্যান্য সব সেবা কার্যক্রম থেকে এই অবস্থায় আমরা প্রতিদিন ৪০-৫০ লাখ টাকার অর্থনৈতিক ক্ষতি গুনছি।’
দেশের বর্তমান যে পরিস্থিতি, তাতে মানুষের মন তো এখন বিনোদনকেন্দ্রিক নয় বলেও জানালেন মুশফিক। তিনি বললেন, ‘দেশ যখন একটা সংকটপূর্ণ সময় পার করে, তখন মানুষের কাছে বিনোদন গৌণ হয়ে পড়ে। স্বাভাবিক সময়ে একটা চ্যালেঞ্জ হবে গ্রাহক ফেরানোয়। তা ছাড়া গ্রাহক ফেরাতে হলে তো কনটেন্ট লাগবে। আমাদের যে কনটেন্টগুলো আসার কথা, সেগুলোও দেরি হয়ে যাবে। এখানে খরচের বিষয় আছে। সব শিল্পীর শিডিউলের বিষয়ও আছে। সার্বিক একটা ক্ষতি হবে। সবচেয়ে বড় কথা, যখন কেউ একটা গতিতে থাকে, সেটা যখন হঠাৎ অনাকাঙ্ক্ষিত ব্লক চলে আসে থেমে যায়, গতিতে আসতে একটা সময় লস হয়ে যায়।’
দেড় বছর বয়সী ওটিটি প্ল্যাটফর্ম দীপ্ত প্লেও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়েছে, এমনটাই জানালেন প্রতিষ্ঠানটির হেড অব ডিজিটাল মিডিয়া মোহাম্মদ আবু নাসিম। গতকাল বুধবার বিকেলে তিনি বললেন, ‘আমরা সাবস্ক্রাইবার সংগ্রহ করছি। সাবস্ক্রাইবারদের কথা ভেবে নতুন কনটেন্টেও বিনিয়োগ করছি। চলতি মাসে একাধিক নতুন কনটেন্টের শুটিংও শুরু করেছিলাম। নতুন একটি কনটেন্ট মুক্তিও দিয়েছিলাম। এসব থেকে যে রিটার্ন আসার কথা, তা পিছিয়ে গেল। আমরা আরও রেভিনিউর জন্য নতুন কিছু পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও আলাপ করছিলাম, কয়েকটি সার্ভিস প্রোভাইডারের সঙ্গেও আলাপ চলছিল—নতুন প্ল্যাটফর্ম হিসেবে সবকিছুতে একটা বড় ধাক্কা খেলাম। আর্থিক ক্ষতি বিবেচনায় এই কয় দিনে ৭০-৮০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। ইন্টারনেট সেবার পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আগের অবস্থায় না ফিরে এলে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে।’
দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘একটি খোলা জানালা’ মুক্তি স্থগিত করে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম বিঞ্জ। ভিকি জাহেদ পরিচালিত চলচ্চিত্রটি ১৮ জুলাই মুক্তির কথা ছিল।
সবকিছু স্বাভাবিক হলেও গ্রাহক ফেরানো চ্যালেঞ্জ মনে করছেন বেশির ভাগ ওটিটি প্ল্যাটফর্মের কর্মকর্তারা।
কতটা চ্যালেঞ্জ, সে প্রসঙ্গে রেদওয়ান রনি বললেন, ‘সবার আগে এ মুহূর্তে মানুষের মনমানসিকতা ফেরানো জরুরি। জরুরি, মানুষকে আবার নতুন করে অভ্যস্ত করাটাও। পাশাপাশি প্রচারণা চালানোর বিষয়টাও আছে। আমাদের এই প্রচারণা পুরোটাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমনির্ভর। ইন্টারনেট সেবা চালু হলেও নতুন করে আমরা কিন্তু এ মুহূর্তে প্রচারণার কোনো জায়গা তৈরি করতে পারছি না। এখানে শুধু ইন্টারনেট চালু করলে হচ্ছে না, পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম চালুর বিষয়টিও আছে। নইলে কাঙ্ক্ষিত সেই জায়গা আমরা তৈরি করতে পারব না।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি আরও বলেন, ‘আমার পণ্য সম্পর্কে গ্রাহককে জানাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রচারণা লাগবে, এই মাধ্যমে আমাদের গ্রাহকেরা নিয়মিত সক্রিয় না হলে কোনো কিছুই প্রমোট করতে পারব না। তাই সেবা চালু হওয়ার পরও কনটেন্ট মুক্তির জন্য যে পরিমাণ বিপণনের কৌশল, এটা চালু হতে সময় লেগে যাবে মনে হচ্ছে। ওটিটি ইন্ডাস্ট্রি মাত্র রাইজিং, ঠিক এই সময়ে বড় একটা ধাক্কা। আমরা তো পুরোপুরি পেইড সাবস্ক্রিপশন-বেজড ব্যবসা করি, ফ্রি না তো। ওই পেইড সাবস্ক্রাইবার রিটার্ন করানো, আবার পুরোনো জায়গা ক্রিয়েট করা বড় চ্যালেঞ্জ। যত দ্রুত সবকিছু স্বাভাবিক হবে, ততই ভালো।’