ক্যারিয়ারে প্রথম আলোচনায় আসেন ‘ভোপাল এক্সপ্রেস’ সিনেমায় অভিনয় করে। সেই সিনেমার গল্প ছিল ভোপালের গ্যাস দুর্ঘটনা নিয়ে। সিনেমাটি মুক্তি পায় ১৯৯৯ সালে। ‘ভোপাল এক্সপ্রেস’-এর সেই গ্যাস ফ্যাক্টরির ভার্মা ফিরলেন ভোপালের রেলওয়ে স্টেশনমাস্টার হয়ে। যে রেলমাস্টার জীবন বাজি রেখে ভোপালের হাজার হাজার মানুষকে গ্যাস দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা করেন। ঐতিহাসিক সেই চরিত্রের তরুণ সেই ভার্মা ২৪ বছর পর ফিরলেন গাম্ভীর্য নিয়ে, সঙ্গে অভিনয়ের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা তো বটেই। নিজের সেরাটা ঢেলে অভিনয় করেছেন ‘দ্য রেলওয়ে মেন’ ওয়েব সিরিজে। নেটফ্লিক্সের সিরিজটি নিয়ে এখন অন্তর্জালে তুমুল আলোচনা চলছে। সিরিজের অন্যতম অভিনেতা কৃষ্ণকুমার মেনন ওরফে কে কে মেনন। উড়ে এসে তিঁনি জুড়ে বসেননি।
মনের কোণে অভিনয়
সবে ৯ বছরের এক বালক। সেই সময়ই ঝোঁক ছিল মঞ্চনাটক নিয়ে। একবার স্কুলের এক আয়োজনে মেনন নাম লেখান অভিনয়ে। কিন্তু কেরালার সেই বালকের তেমন ইচ্ছা ছিল না অভিনয়ের। পড়েছেন পছন্দের বিষয় পদার্থ নিয়ে। পরে আবার নাম লেখান ব্যবসার ছাত্র হিসেবে। হয়তো ভাগ্যই তাঁকে টানছিল অভিনয়ের দিকে। এই ব্যবসায় শিক্ষা থেকে এমবিএ পাস করে বিজ্ঞাপনের এজেন্সিতে কাজ শুরু করেন। কিন্তু মঞ্চে অভিনয় করার ভূত তখনো মনের এক কোণে চেপে রেখেছিলেন। নাম লেখালেন মঞ্চ–দুনিয়ায়। তাঁর ভাগ্য খুলতে শুরু করে।
শুরুতেই নাসিরুদ্দিন শাহর মুখোমুখি
প্রথম মঞ্চনাটক ‘মহাত্মা বনাম গান্ধী’তে অভিনয় করেন তিনি। তাঁর অভিষেককে রাজকীয় বলা যায়। শুরুতেই তিনি মঞ্চে মুখোমুখি হন বলিউডের আরেক জাঁদরেল অভিনেতা নাসিরুদ্দিন শাহর। সিনেমার পাশাপাশি মঞ্চকাঁপানো নাসিরুদ্দিন শাহর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছিলেন। তবে মঞ্চে প্রথমবার অভিনয় করছেন, তাঁর কাজ দেখে মনে হয়নি। বরং মনে হয়েছে, নাসিরুদ্দিনের সঙ্গে কোনো অভিজ্ঞ, পরিণত অভিনেতাই কাজ করছেন। সেই অভিজ্ঞতা নিয়েই তিনি শুরু করেন ছোট পর্দায় অভিনয়। ‘ধর’ নামে একটি ধারাবাহিকে ইরফান খানদের সঙ্গে অভিনয় করে প্রশংসা পান। তখনো জানেন না, অভিনেতা হবেন কি না। কিন্তু সব সময় ছিলেন সুযোগের অপেক্ষায়।
‘ভোপাল এক্সপ্রেস’ থেকে ভোপালের রেলমাস্টার
নাটক থেকে কিছুটা পরিচিতি পাওয়ার পর সিনেমায় নাম লেখান। ক্যারিয়ারে প্রথম সিনেমা ছিল ‘নাসিম’ (১৯৯৫)। সেখানে জাফর নামে ছোট একটি চরিত্রে সুযোগ পান। পরে আর সিনেমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়নি। চার বছর কোনো সিনেমায় কাজ করা হয়নি। তখন সিনেমা–সংশ্লিষ্ট প্রোডাকশন হাউস নিয়েই ছিলেন। ১৯৯৯ সালে সুযোগ পান ‘ভোপাল এক্সপ্রেস’ সিনেমায় প্রধান চরিত্রে অভিনয়ের। এই সিনেমার গল্পের মূল চরিত্র ছিলেন ভার্মা। ভার্মা ভোপালের গ্যাস ফ্যাক্টরিতে চাকরি করেন। তিনি বুঝতে পারেন, ফ্যাক্টরি থেকে হঠাৎ গ্যাস বের হওয়া শুরু হয়েছে। মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটবে। সবাইকে বাঁচাতে হবে। কিন্তু সংকেত কাজ করছে না। ভার্মা চেষ্টা করেন সবাইকে সচেতন করতে। কেউ ভয়ংকর পরিস্থিতির কথা স্মরণ করে দূরে সরলেও অনেকেই গুরুত্ব দিচ্ছিলেন না। কঠিন এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হন ভার্মা। হঠাৎ তাঁর মনে পড়ে, বাসায় নববিবাহিত স্ত্রী। ১৯৮৪ সালে ভোপালের গ্যাস দুর্ঘটনাকে ঘিরে সিনেমায় মানসিক এক দ্বন্দ্ব ফুটে ওঠে। ভার্মা চরিত্রে মেনন অভিনয় করে প্রশংসা পান। এই সিনেমায়ও তিনি পেয়েছিলেন নাসিরুদ্দিন শাহকে। তিনি অতিথি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। নাসিরুদ্দিন শাহও মেননের অভিনয়ের প্রশংসা করেছিলেন।
কৃষ্ণকুমার মেনন থেকে কে কে মেনন
‘ভোপাল এক্সপ্রেস’-এর সাফল্যের পর তাঁকে পেছনে তাকাতে হয়নি। তবে ঠিক করেন, ভালো গল্প ছাড়া অভিনয় করবেন না। আড়ালে থাকা এই অভিনেতাকে খুঁজে নেন ভারতের গুরুত্বপূর্ণ পরিচালকেরা। ২০০০ সাল–পরবর্তী সময়ে মেনন নাম লেখান অনুরাগ কশ্যপের ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’ সিনেমায়। সিনেমাটি লোকার্নো চলচ্চিত্র উৎসবে প্রিমিয়ার হয়। পরের বছর নাম লেখান রাম গোপাল ভার্মার ‘সরকার’, দুই বছর পর অনুরাগ বসুর ‘লাইফ ইন আ মেট্রো’ সিনেমায়। এ ছাড়া ‘হায়দার’, ‘দ্য গাজী অ্যাটাক’ সিনেমাগুলো তাঁকে আরও বেশি পরিচিত করে। একসময় দক্ষিণ ছাপিয়ে তিনি ভারতের দর্শকদের কাছে কৃষ্ণকুমার মেনন থেকে হয়ে ওঠেন কে কে মেনন। অভিনয় ক্যারিয়ারে তাঁর ঝুলিতে যোগ হয় ফিল্মফেয়ারসহ একাধিক পুরস্কার।
ওয়েব ফিল্মের দুনিয়ায় রাজত্ব
২০১৮ সালের পরে বিশ্বে বাড়তে থাকে ওয়েব সিরিজ-সিনেমার দাপট। তখন সময় না নিয়েই অন্তর্জালে নাম লেখান মেনন। ‘পরচায়ী: গোস্ট স্টোরিজ বাই রাসকিন বন্ড’ দিয়ে সাদামাটাভাবেই ওয়েবে শুরু হয়। এরপর নীরজ পান্ডের ‘স্পেশাল ওপস’, ‘রে’, ‘ফারজি’, ‘মুম্বাই মেরি জান’ ও সর্বশেষ ‘দ্য রেলওয়ে মেন’ দিয়ে তিনি ভক্তদের সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা পাচ্ছেন। কখনো খল চরিত্রে, কখনো পুলিশ, কখনো সচেতন নাগরিক, কখনো রকস্টার—নানা বৈচিত্র্যময় ভূমিকায় আলাদা করে নজর কাড়া মেননকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে এসেছে ‘দ্য রেলওয়ে মেন’ সিনেমার ইফতেখার সিদ্দিকী চরিত্রটি।
ব্যতিক্রম সব চরিত্র বাছাই নিয়ে মেনন ইন্ডিয়া টুডেকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘চরিত্র বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আমি খুবই সংবেদনশীল। কেউ সিনেমা বা সিরিজ যা–ই বানাক, সেটা নিয়ে কখনোই আপত্তি নেই। সবার আগে তার সঙ্গে দেখা করি। গল্প নিয়ে কথা বলি। কিন্তু যারা অসাধারণ কিছু চিন্তা করে, আমি শুধু তাদের সঙ্গে কাজ করতে চাই। এটা আমাকে রোমাঞ্চিত করে। আমাকে কাজটা করতেই হবে।’
তবে এটা বলাই যায়, ‘দ্য রেলওয়ে মেন’ সিরিজের পর ওটিটিতে তাঁর দাপট আরও বাড়বে। তাঁর অভিনীত ‘শালর্ক হোমস’সহ তিন সিরিজ মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে।
‘দ্য রেলওয়ে মেন’ কেন দেখবেন
ভোপাল রেলওয়ের স্টেশনমাস্টার ইফতেখার সিদ্দিকী। কাজপাগল সৎ মানুষটি স্টেশনের যাত্রী–সুবিধাকে সব সময় প্রাধান্য দেন। কোথায় রেললাইন মেরামত করতে হবে, কোথায় টেলিফোন নষ্ট হয়েছে—এমন নানা সমস্যা দেখলেই তিনি সমাধান করতে ছুটে যান। সবাই তাঁকে পছন্দ করেন। ব্যস্ততার মধ্যেই তিনি হঠাৎ বুঝতে পারেন, রেলস্টেশনের লোকজন ছোটাছুটি করছেন। বাইরে এসে বুঝতে পারেন, বাতাসে গ্যাসের গন্ধ। একের পর এক মানুষ নিশ্বাস বন্ধ হয়ে পড়ে যাচ্ছেন। সারা জীবন রেলস্টেশনকে ভালোবাসা মানুষটি কি আজ স্টেশন ছাড়তে পারবেন? ঠিকই ধরেছেন। তিনি স্টেশনের মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন। জীবন বাজি রেখে সবাইকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নিতে কাজ করেন।
কিন্তু এর মধ্যেই ভোপালের এই স্টেশনে আসবে আরেকটি ট্রেন। তাতে আছেন কয়েক হাজার মানুষ। ১৯৮৪ সালে ভোপালের গ্যাস লিকেজের সত্য ঘটনা নিয়ে এটি নির্মিত। পুরো সিনেমার টান টান উত্তেজনা ক্ষণিকের জন্য হলেও দর্শককে নিয়ে যাবে ১৯৮৪ সালের ভোপালের সেই রেলস্টেশনে।
ওয়েব সিনেমাটি প্রথম ফ্রেম থেকে প্রতিটি মুহূর্তে দর্শকের চোখ আটকে রাখবে। মানুষের আর্তচিৎকার, জীবন বাঁচানোর লড়াই, মৃত্যু—সবই মনে হবে চোখের সামনে ঘটছে; এতটাই বাস্তবসম্মত ছিল। বাড়তি কোনো মিউজিক ছিল না। কালার গ্রেডিং থেকে শুরু করে গল্প বর্ণনা, গল্প ছড়িয়ে যাওয়া দর্শকদের টেনশন বাড়িয়ে তোলে। সিনেমার আর মাধবন, দিব্যেন্দু শর্মা, বাবিল খান, মন্দিরা বেদি, রঘুবীর যাদব, রাহুল তিওয়ারিসহ সবার কাছ থেকে সেরা অভিনয় বের করেছেন পরিচালক শিব রাওয়াল। চার পর্বের এই মিনি সিরিজের আইএমডিবি রেটিং ৮.৬। ৫৪ শতাংশ দর্শক ওয়েব সিরিজকে ১০–এ ১০ রেটিং দিয়েছেন।