ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে বললেই লজ্জায় জড়সড় হয়ে যেতেন তাঁরা। মেকআপ রুমে এসে বসে থাকতেন দুই ভাই। কখনো ক্যামেরার পেছনে, কখনো চুপচাপ শুটিংয়ের আড়ালে নিজেদের মতো আড্ডা দিতেন। এসব বলে দেয়, অভিনয় নিয়ে কখনোই তেমন আগ্রহ ছিল না। লাজুক সেই দুই ভাইয়ের এখন অভিনয়ই ধ্যানজ্ঞান। মা-বাবার মতো তাঁরাও এখন ভক্তদের কাছ থেকে প্রশংসা পাচ্ছেন। প্রস্তুতি নিচ্ছেন পড়াশোনা শেষ করে কোমর বেঁধে অভিনয়ে নামার। বলছি দিব্য জ্যোতি ও সৌম্য জ্যোতির কথা। তাঁরা চিত্রনাট্যকার ও অভিনয়শিল্পী দম্পতি বৃন্দাবন দাস ও শাহনাজ খুশির ছেলে। আলোচিত ওয়েব সিরিজ ‘কারাগার ২’, ‘কাইজার’, ‘ইন্টার্নশিপ’, ‘মহানগর ২’ তাঁদের আলোচনায় এনেছে। এবার ঈদেও একাধিক চমক নিয়ে ফিরেছেন দুজন।
ছোটবেলায় স্কুল ছুটি থাকলে মা-বাবার সঙ্গে শুটিংয়ে যেতেন দুই ভাই। তখন অভিনয়ের কিছুই বুঝতেন না। শুটিংয়ে তাঁদের নিয়মিত যাওয়া–আসা দেখে দুজন পরিচালক প্রস্তাব দেন, তাঁদের দিয়ে অভিনয় করাবেন।
এভাবেই সৌম্য প্রথম ‘পাদুকা বিতান’ নাটকে চঞ্চলের শৈশবের চরিত্রে অভিনয় করেন। দিব্যর শুরু ‘সন্তান’ নাটক দিয়ে। কিন্তু তখনো অভিনয় নিয়ে তাঁদের বাড়তি আগ্রহ ছিল না। এ ছাড়া মা-বাবার সূত্রেই শৈশব থেকে মামুনুর রশীদ, সালাহউদ্দিন লাভলু, জয়া আহসান, মোশাররফ করিম, চঞ্চল চৌধুরীদের ঘরের মানুষ মনে করতেন। বড় বড় তারকার সংস্পর্শে বেড়ে ওঠায় দুই ভাইয়ের কাছে মনে হতো, অভিনয় আর এমন কী! তাঁরা যতই বড় হন, অভিনয়কে তত সহজভাবে নিতে থাকেন।
ও লেভেল পড়াশোনার সময় বড় ছুটি পেয়ে যান দুই ভাই। বাসায় কী করবেন না করবেন, তাই মা–বাবার সঙ্গে তাঁরা শুটিংয়েই সময় কাটানোর চিন্তা করেন। মা–বাবা আগেই জানতেন, ছেলেরা শুটিংয়ে যাবেন, অবসর কাটাতে।
তাঁদের বাবা বৃন্দাবন দাসের চিত্রনাট্যে চঞ্চল চৌধুরীর শ্যালকের জন্য দুজন অভিনয়শিল্পীর চরিত্র রাখেন। পরে অভিনয়ের প্রস্তাব দিতেই রাজি হয়ে যান দুই ভাই। বেকার ঘোরাঘুরির চেয়ে অভিনয় খারপ কী। তবে আগে অভিনয়কে সহজ মনে করলেও এবার ভয়ে ভয়ে ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে হয়। নাম লেখান ঈদের নাটক ‘হেপি ফেমিলি’তে। সেই ঘটনাও বেশ মজার।
দুই ভাইকে একসঙ্গে বেশির ভাগ নির্মাতাই চিনতে পারেন না। পরিচালকেরা তাঁদের কাস্টিং করার জন্য তাঁকে ফোন দেন। ফোন করে কাকে দরকার, সেটা আলাদা করে বলেন না। হেসে শাহনাজ খুশি বলেন, ‘পরিচালকেরা ফোন দিয়ে শুধু বলেন, আপনার যে ছেলেটা ‘কাইজার’-এ অভিনয় করেছে, তাকে লাগবে। অথবা বলেন, কারাগার-এ যে ছেলেটা অভিনয় করেছে, তাকে লাগবে।’
সেই অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে দিব্য বলেন, ‘মা-বাবার সঙ্গে অভিনয় করতে কিছুটা ভয় পেতাম। কিন্তু চঞ্চলের সঙ্গে অভিনয় করতে ভয় পেতাম না। তিনি আমাদের বন্ধুর মতো। মজার ব্যাপার, আমরা চঞ্চলকে শৈশব থেকে চঞ্চল বলেই ডাকি। তিনি আমাদের পরিবারের একজন। তাঁর সঙ্গে দৃশ্যগুলো জমিয়ে করছিলাম। বাবার চিত্রনাট্য কেউ তেমন একটা ইম্প্রোভাইজ করার সাহস পায় না। আমরা চঞ্চলের সঙ্গে পরিকল্পনা করে যতটা দর্শকদের বিনোদন দেওয়া যায়, সেভাবে শুটিং করি। গল্পে চঞ্চলের গলায় হাত দিয়ে ঘোরাঘুরি, দুলাভাইয়ের শার্ট ধরে টানা, এমন অনেক দৃশ্য দর্শকদের নজর কেড়েছিল। ভালো লেগেছিল অভিনয় করে।’
সেই ভালো লাগার গল্পটা আরও বাড়তে থাকে। এর আগে বাইরে বের হলেই ভক্তরা তাঁদের মা–বাবাকে ঘিরে ধরতেন, একসঙ্গে ছবি তুলতেন। পাশে দাঁড়িয়ে থাকতেন দুই ভাই। ‘হেপি ফেমিলি’ প্রচারের পর পরিস্থিতি বদলে গেল। মগবাজারের একটি মার্কেটে কাজে গিয়েছিলেন সৌম্য। সেখানে হঠাৎ লোক এসে সৌম্যকে বলেন, ‘আপনি চঞ্চলের শ্যালকের চরিত্রে অভিনয় করেন নাই? আপনার অভিনয় অনেক ভালো লাগছে।’ পরে একসঙ্গে ছবি তোলেন। সৌম্য বলেন, ‘সেই ঘটনার প্রতিটা মুহূর্ত এখনো আমার মনে আছে। এটাই ছিল আমার প্রথম ফ্যান এক্সপেরিয়েন্স। আব্বু, আম্মু, চঞ্চলের ভক্ত আমি। সেদিনের সেই অপ্রত্যাশিত ঘটনার পর মনে হয়, অভিনয়টা করলে মন্দ হয় না।’ সিনেমা ও ওয়েবে নাম লেখান। তাঁরা ‘কারাগার’, ‘কাইজার’ ও ‘ইন্টার্নশিপ’-এ অভিনয় করে আলোচনায় আসেন। বাড়তে থাকে ব্যস্ততা। কিন্তু পড়াশোনার কী হবে? সৌম্য ও দিব্য নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। সৌম্য পড়ছেন ইংরেজি সাহিত্যে, দিব্য অর্থনীতিতে। এখন তাঁরা পড়াশোনার পাশাপাশি অভিনয় করছেন। পড়াশোনা শেষ হলেও অভিনয়ের দিকে জোরে পা ফেলবেন বলে জানান দুই ভাই।
যমজ হওয়ার কারণে দুই ভাইকে বেশ মজার বিড়ম্বনায়ও পড়তে হয়। ভক্তরা বুঝতে পারেন না, কোনজন সৌম্য আর কে দিব্য। তবে সহকর্মী ও পরিচালকেরাও যে তাঁদের চিনতে পারেন, তেমন নয়। তাঁদের মা শাহনাজ খুশি জানালেন, দুই ভাইকে একসঙ্গে বেশির ভাগ নির্মাতাই চিনতে পারেন না। পরিচালকেরা তাঁদের কাস্টিং করার জন্য তাঁকে ফোন দেন। ফোন করে কাকে দরকার, সেটা আলাদা করে বলেন না। হেসে শাহনাজ খুশি বলেন, ‘পরিচালকেরা ফোন দিয়ে শুধু বলেন, আপনার যে ছেলেটা ‘কাইজার’-এ অভিনয় করেছে, তাকে লাগবে। অথবা বলেন, কারাগার-এ যে ছেলেটা অভিনয় করেছে, তাকে লাগবে।’ মায়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সৌম্য মজা করে বলেন, ‘তার আগে সবাই ফোন দিয়ে মাকে বলতেন, আপনার যে ছেলের চুল ছোট, তাকে লাগবে। তখন ‘কাইজার’-এর জন্য আমার চুল ছোট ছিল। দিব্যর চুল বড় ছিল।’
এবার ঈদে দুই ভাই বেশ আলোচনায় রয়েছেন। ‘মহানগর ২’ দিয়ে আলোচনায় এসেছেন দিব্য। এ ছাড়া তাঁর সাত খণ্ডের ধারাবাহিক অঙ্ক স্যার দর্শক পছন্দ করেছেন।
সৌম্য ঈদের নাটক ‘হাত ছাফাই’য়ে অভিনয় করে প্রশংসা পাচ্ছেন। মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে তাঁর সিনেমা ‘টুঙ্গিপাড়ার দুঃসাহসী খোকা’। সিনেমায় তিনি বঙ্গবন্ধুর শৈশবকালের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। এ ছাড়া সিনেমা ‘দাওয়াল’-এ নাম লিখিয়েছেন তিনি। একসঙ্গে দুই ভাইকে দেখা যাবে নকশিকাঁথার জমিন সিনেমায়। হাসান আজিজুল হকের গল্প অবলম্বনে নির্মিত সিনেমায় দিব্যকে কৃষকের ভূমিকায় দেখা যাবে। সৌম্য করেছেন নেতিবাচক চরিত্র। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধুর বায়োপিকেও দিব্যকে দেখা যাবে। ‘মহানগর-২’ নিয়ে উচ্ছ্বসিত দিব্য বলেন, ‘দর্শক আমার চরিত্র নিয়ে এতটা কথা বলবে, বুঝতেই পারিনি।’
সৌম্য ও দিব্য সম্পর্কে তাঁদের বাবা বৃন্দাবন দাস বলেন, ‘কখনোই তাদের মধ্যে অভিনয় নিয়ে আগ্রহের কথা শুনিনি। তবে ওরা আমার লেখার সমালোচনা করত। তাদের পর্যবেক্ষণে অবাক হয়ে যেতাম। চিত্রনাট্য পড়ে শোনালে ভালো ইনপুট দিত। এমন হয়েছে, গল্পের শেষটা পরিবর্তন করতে হয়েছে।’
ছেলেদের নিয়ে শাহনাজ খুশি বলেন, ‘তাদের কাছে আমার চাওয়ার কিছু নেই। কখনোই তাদের বলিনি ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হতে হবে। বরাবরই বলি, ভালো মানুষ হতে। সৎ থাকুক। তারা ভালো থাকলেই আমরা খুশি।’