ওটিটিতে বিশ্বজুড়েই থ্রিলার ঘরানার সিনেমা ও সিরিজ জনপ্রিয়, বাংলাদেশের প্ল্যাটফর্মগুলোতে এ ধরনের কনটেন্ট দেখা গেছে। তবে চলতি বছর বিষয়বৈচিত্র্যের কারণে বেশ কিছু সিরিজ ও ওয়েব ফিল্ম আলোচনায় ছিল। ওয়েবে মুক্তি পাওয়া বছরের আলোচিত ১০ সিনেমা ও সিরিজ নিয়ে এই প্রতিবেদন
‘গুটি’
সুলতানা একজন মাদক পাচারকারী। বছর কয়েক ধরে স্থানীয় মাদক চোরাচালান নেটওয়ার্কের সঙ্গে জড়িত সে। এই সময়ের মধ্যে প্রচুর অর্থসম্পদ করেছে ঠিকই, তবে হারাতে হয়েছে কাছের মানুষ, সম্পর্ক, বিশ্বাস ও আশা। এ কাজে পালানোর কোনো পথ নেই, তবে সুলতানা স্বপ্ন দেখে। মেয়ের জন্য সুন্দর একটি পৃথিবীর স্বপ্ন। কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণ হয় কি? এমন গল্প নিয়েই শঙ্খ দাশগুপ্তের সিরিজ ‘গুটি’।
বছরের শুরুতে চরকিতে মুক্তি পাওয়া সিরিজ নিয়ে আলোচনার কারণ ছিল দুটি—সুলতানা চরিত্রে আজমেরী হক বাঁধনের অভিনয় আর এর ডার্ক বিষয়বস্তু। মাদক আর সম্পর্কের জটিল চিত্রায়ণ মিলিয়ে সিরিজটির টিজার দেখে প্রশংসা করেছিলেন বলিউড নির্মাতা অনুরাগ কাশ্যপও। অন্যদিকে মাদক পাচারকারীর চরিত্রে অভিনয়ের জন্য যে শারীরিক ও মানসিক চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, তাতে ভালোভাবেই উতরে গেছেন বাঁধন। প্রশংসিত হয়েছেন।
‘মহানগর ২’
অনেক সিরিজের দ্বিতীয় কিস্তি প্রথমটির মতো জমে না, আশফাক নিপুণের ‘মহানগর ২’ অবশ্য উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। বিরতির পর পর্দায় ফিরে ‘ওসি হারুন’ চরিত্রে আবারও তাক লাগিয়ে দিয়েছেন মোশাররফ করিম। আগের কিস্তিতে তিনি ছিলেন সব ঘটনার অনুঘটক, এবার তিনিই ঘটনার শিকার। রোমাঞ্চকর গল্পবিন্যাস, পাত্র-পাত্রীদের দুর্দান্ত অভিনয়—সব ছাপিয়ে মহানগর ২ আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছিল সিরিজটিতে সমসাময়িক নানা ঘটনার সঙ্গে মিল থাকার কারণে।
আলাদা করে প্রশংসিত হয়েছে পরিচালকের রাজনৈতিক সচেতনতাও। সিরিজের চরিত্রায়ণে বরবারই চমকে দেন নিপুণ। এবারও আফসানা মিমি, তানজিকা আমিন, বৃন্দাবন দাসরা নিজেদের চরিত্রে ছক্কা হাঁকিয়েছেন।
‘উনিশ২০’
ওটিটির ‘থ্রিলার দুনিয়া’য় একরাশ তাজা হওয়ার মতোই ছিল চরকির ওয়েব ফিল্ম ‘উনিশ২০’। মিজানুর রহমান আরিয়ানের ওয়েব ফিল্মটি একই প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পাওয়া তাঁর আগের সিনেমা ‘নেটওয়ার্কের বাইরে’র মতোই আলোচনায় ছিল।
দীর্ঘ বিরতির পর আরিফিন শুভ-বিন্দু জুটি, পর্দায় তাঁদের রসায়ন আর গান মিলিয়ে আরও উপভোগ্য হয়ে উঠেছিল সিনেমাটি।
‘আমি কী তুমি’
চলতি বছর আলোচিত সিরিজগুলোর মধ্যে বিষয়বৈচিত্র্যের কারণে ভিকি জাহেদের সিরিজটিকে রাখতেই হবে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সায়েন্স ফিকশন ঘরানার সিরিজ বানানোর জন্য পরিচালককে বাহবাও দিতে হয়। কিছু খামতি থাকলেও প্যারালাল ওয়ার্ল্ড নিয়ে তিনি যে সিরিজটি বানিয়েছেন, সেটা যথেষ্ট উপভোগ্য।
আইস্ক্রিনে প্রচারিত সিরিজটির প্রধান চরিত্রে মেহজাবীন চৌধুরী ভালো করেছেন, তবে ‘আমি কী তুমি’র পর চমক ছিল বিরতির পর জোনায়েদ বোগদাদী ফেরা। মেহজাবীনের প্রেমিকের চরিত্রে তাঁর সাবলীল অভিনয়ের পর যেকোনো দর্শকই বলবেন, পর্দায় এত দিন তাঁকে মিস করেছেন।
‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’
গত কয়েক বছরে ওটিটি প্ল্যাটফর্মের অন্যতম বড় আবিষ্কার নাসিরদ্দিন খান। তবে চলতি বছর নিজেকেই তিনি ছাড়িয়ে গেছেন। ‘নায়কোচিত নন’, এমন চেহারার এক অভিনয়শিল্পীকে প্রধান চরিত্র করে সিরিজটি বানানোর জন্য নির্মাতা শিহাব শাহীন ধন্যবাদ পাবেন। তেমনি ধন্যবাদ পাবেন রবিউল আলম রবি, পরিচালকের সঙ্গে যৌথভাবে গল্প লিখেছেন তিনি। সিরিজটির গল্প খুব নতুন বলা যাবে না। কিন্তু এটি উপভোগ্য হয়েছে দুর্দান্ত চিত্রনাট্য আর পাত্র-পাত্রীদের অভিনয়ের কারণে।
নাসিরউদ্দিন নিজের চরিত্রে খুব ভালো করেছেন, তবে বাংলাদেশের দর্শকেরা নতুন করে আবিষ্কার করেছেন রাফিয়াত রশিদ মিথিলাকে। গৃহবধূ শায়লার চরিত্রটি তৈরি হয়েছিল একই সঙ্গে অসহায়ত্ব আর শক্তিশালী নারীর মিশ্রণে। পর্দায় যা ভালোভাবেই তুলে ধরেছেন তিনি।
‘মারকিউলিস’
সিরিজের প্রধান চরিত্রের সঙ্গে অন্য প্রায় সব অভিনেতার দৃশ্য আছে—এমন বিরল ঘটনা দেখা গেছে আবু শাহেদ ইমনের সিরিজটিতে। চরকির এই সিরিজের প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন সাবিলা নূর। এটি দিয়েই ওটিটিতে অভিষেক হয়েছে তাঁর। সাবিলা অভিনীত ‘জয়িতা’ চরিত্রটির সঙ্গে সিরিজের প্রায় সব পাত্র-পাত্রীরই দৃশ্য ছিল। ছোট পর্দার রোমান্টিক নায়িকা হিসেবে পরিচিত সাবিলা দৃশ্যগুলোতে ভালোভাবেই উতরে গেছেন। সিরিজটি ছিল জয়িতার গল্প। তার অসহায়ত্বের গল্প দিয়ে শুরু হয় ‘মারকিউলিস’, পর্ব যত এগোলো, জয়িতা নিজের অসহায়ত্বকে শক্তিতে রূপান্তরিত করে। এমন একটি চরিত্রে অভিনয়ের চ্যালেঞ্জ নেওয়ার পর অভিনেত্রী হিসেবে সাবিলার আত্মবিশ্বাস আরও বেড়ে যাওয়ার কথা।
‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’
নিজের ব্যক্তিজীবনের খণ্ড গল্প নিয়ে চরকির আলোচিত এই ওয়েব ফিল্ম বানিয়েছেন মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। তবে গল্প ‘ব্যক্তিগত’ হলেও ফারুকীর কাজের সঙ্গে পরিচিত দর্শকেরা জানতেন, সিনেমায় ঠিকই এই সময়ের গল্প থাকবে।
মুক্তির পর যা সত্যি প্রমাণিত হয়েছে। সিরিজটি আরও একটি কারণে ব্যতিক্রম—প্রথমবারের মতো অভিনয় করেছেন ফারুকী, প্রথমবারের মতো লিখেছেন নুসরাত ইমরোজ তিশা।
বুসান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রিমিয়ারের পর মুম্বাই উৎসবেও দেখানো হয় সিনেমাটি। পরে মুক্তি চরকিতে। মুক্তির পর সিনেমাটি আর ‘ব্যক্তিগত’ থাকেনি, ফারুকীর অন্য কাজগুলোর মতো সবারই মনে হয়েছে, ‘এটা তো আমার নিজেরই গল্প!’
‘ফ্রাইডে’
পর্দায় রায়হান রাফী যেভাবে সহিংসতার দৃশ্য দেখিয়েছেন আগে, সেভাবে দেখা যায়নি। ২০২১ সালে আরেকটি ওয়েব ফিল্ম জানোয়ার-এর সঙ্গে মিল আছে চলতি বছর বিঞ্জে মুক্তি পাওয়া ‘ফ্রাইডে’র। দুটিই সত্য ঘটনা অবলম্বনে, দুটিতেই সহিংসতা দেখানো হয়েছে। সিরিজটি মূলত আলোচনায় ছিল তমা মর্জির পারফরম্যান্সের কারণে। ‘মুনা’ নামে এক খুনির চরিত্রে তাঁর অভিনয় ছিল তারিফ করার মতো। তাঁর পুরো সিনেমাতেই ধূসর থিমটা বজায় রেখেছিলেন নির্মাতা, যা হয়তো ওই পরিবারের মানসিক অবস্থাকেই নির্দেশ করেছিল। এই ফিল্ম ‘জানোয়ার’-এর মতো ততটা সমাদৃত হয়নি, তবে নির্মাতা রাফীর ছাপ স্পষ্ট ছিল।
‘কুহেলিকা’
কয়েক বছর ধরেই ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ও ছোট পর্দায় নানা বৈচিত্র্যময় চরিত্রে অভিনয় করে প্রশংসা কুড়িয়েছেন নাজিয়া হক অর্ষা। ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে অর্ষার অভিনয়, তাঁর চরিত্রগুলোর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ে প্রায়ই আলোচনায় হয়েছে। চলতি বছর বিঞ্জের সিরিজ কুহেলিকাতেও দেখা যায় অভিনেত্রীকে। সামিউর রহমান পরিচালিত সিরিজটিতে ‘নন্দিনী’ চরিত্রে দেখা যায় তাঁকে। একই সমাজে বাস করলেও জীবনকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে নন্দিনী ও অন্বেষা। সেই নন্দিনী ও অন্বেষাই যখন এক বিন্দুতে মিলে যায়, নতুন দিকে মোড় নেয় গল্প। এমন গল্প নিয়েই নির্মিত হয়েছিল ওয়েব ফিল্মটি। অর্ষা জানিয়েছিলেন, অভিনেত্রী হিসেবে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জ নিতে মুখিয়ে থাকেন তিনি। এ জন্যই একটু সেমি ডার্ক হয়, সাইকোথ্রিলার, পোস্টট্রমাটিকের গল্পের কাজ বেছে নেন তিনি।
‘নিকষ’
ছোট পর্দায় নিয়মিত কাজ করেছেন তাসনিয়া ফারিণ। অনেক সময়ই তাঁকে ছোট পর্দায় দেখা গেছে রোমান্টিক চরিত্রে। তবে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম দীপ্ত প্লের ওয়েব ফিল্ম ‘নিকষ’-এ একেবারেই গ্ল্যামারহীন চরিত্রে হাজির হন। রুবেল হাসানের পরিচালনায় থ্রিলার ঘরানার গল্পটিতে টাইপিস্ট সুলতানার চরিত্রে দেখা যায় ফারিণকে। লাপাত্তা ছোট বোনকে খুঁজতে যাঁকে এক অনিশ্চিত যাত্রায় নামতে হয়। এই যাত্রায় সুলতানা চরিত্রটিকে যতটা অসহায়, প্রতিজ্ঞাবদ্ধ আর দৃঢ়চেতা থাকার কথা, পর্দায় ততটাই তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন ফারিণ।