বাংলা ওয়েব সিরিজের জগতে হইচই একটা বিশেষ নাম। সাত বছর ধরে হইচইয়ের সিরিজগুলোর জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়েছে গোটা বিশ্বে, বাঙালিয়ানার ঘেরাটোপে হইচই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে তার কাজের সম্ভারের মাধ্যমে। হইচই বাংলাদেশের তেমনই কিছু বিশেষ কাজের তালিকায় রয়েছে ‘মহানগর’, ‘তাকদীর’, ‘কারাগার’, ‘কাইজার’সহ আরও অনেক কিছু। দর্শকের মনের মণিকোঠায় পৌঁছে গেছে এসব গল্প। সেই হইচইয়ের সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত সিরিজ ‘মোবারকনামা’। বছরের শেষে বাংলা ওটিটি জগতে বিশেষ সাড়া ফেলে দিয়েছে এই সিরিজ। মোশাররফ করিম অভিনীত, গোলাম সোহরাব দোদুল পরিচালিত সিরিজটি মুক্তির পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে দর্শকের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
মোশাররফ করিমের মতো তুখোড় অভিনেতা তাঁর অভিনয়ক্ষমতার মাধ্যমে আরও একবার দর্শকের মন জয় করে নিয়েছেন। প্রতিটি কাজের মতো এই কাজেও তিনি নিজের শতভাগ ঢেলে দিয়েছেন। তবে শুধুই তাঁর অভিনয় নয়, এই গল্পের আরও অনেক আকর্ষণীয় দিকের অন্যতম হলো এই গল্পের প্লট। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্ত দর্শককে ভাবাবে এই সিরিজ। সংলাপ থেকে শুরু করে প্রত্যেকের মন্ত্রমুগ্ধ করা পারফরম্যান্স, সবটাই ভালো লেগেছে আপামর দর্শকের।
গল্পের মূল চরিত্র মোবারক। একজন আইনজীবী সে। তবে আর পাঁচজনের গল্পের চেয়ে তার জীবন খানিকটা হলেও আলাদা। একসময়ের অত্যন্ত সফল আইনজীবী, যে অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়ে স্বেচ্ছায় কোর্টে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন, তার গল্প বলে ‘মোবারকনামা’।
তবে গল্পের পরতে পরতে থাকা একটা চাঞ্চল্যকর ঘটনা মোবারককে ফিরিয়ে আনে আইনজীবীর বেশে আরও একবার। মোবারকের চরিত্রের বাঁক যেভাবে বদল হয়েছে, ঠিক তেমন করেই একইভাবে মোশাররফ করিম নিজেকে মেলে ধরেছেন স্বস্তঃস্ফূর্তভাবে।
মোবারকনামা সিরিজে মোবারক ভূঁইয়ার বিপক্ষের আইনজীবী ‘সাবনিন’ চরিত্রে নওরিন হাসান খান জেনির অভিনয়ও সবার প্রশংসা পেয়েছে। গল্পের মূল চরিত্র মোবারক হলেও, তার জীবন আর জীবনের ঘটনাগুলো ঘিরে রয়েছে আরও অনেক চরিত্র, যাদের সমান দক্ষতার জোরে সিরিজটি হয়ে উঠেছে সাবলীল। কোর্টরুম ড্রামা কিন্তু আগেও বেশ কয়েকবার হয়েছে, তবে এই গল্পের বিশিষ্টতা হলো প্রত্যেকের নিজস্ব গল্প, প্রত্যেকের নিজস্ব ভাবনা। অনেক দিন পর জেনির অভিনয়ে ফিরে আসা, তাও আবার এমন একটা বিশেষ চরিত্রের হাত ধরে যে তাঁর অভিনয়দক্ষতা, তাঁর সাবলীল অভিব্যক্তি, সব মিলিয়ে এই কাজ চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে সবার কাছে। কথায় আছে, ক্যামেরার পেছনে পরিচালকই সর্বেসবা, এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। পরিচালক গোলাম সোহরাব দোদুল গল্পের সদ্ব্যবহার করে দর্শককে একটা চমকপ্রদ কাজ উপহার দিয়েছেন।
গল্পের অন্যতম চরিত্র সুরাইয়া, যাকে কেন্দ্র করে বুনন হয় গল্পের, যার গল্প মন ছুঁয়ে যায়। একটা মেয়ে খোলামেলা জীবনযাপন করলেই যে তাকে ‘সহজলভ্য’ বলে ধরে নেওয়া হয়, সেই কঠোর বাস্তবতা তুলে ধরা হয়েছে ‘মোবারকনামা’র মাধ্যমে। একটা ধর্ষণের ঘটনার ভুক্তভোগী হলে যে সমাজের কাছে কী কী শুনতে হয়, তা নিয়ে হয়তো অনেকেই সচেতন, তবে সেই বাস্তবতা থেকে উঠে আসা একটা চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে কতটা দক্ষতার প্রয়োজন, সেটাই প্রমাণ করে দিলেন শাহানাজ সুমি। এমন একটা সাহসী চরিত্র তাঁর ক্যারিয়ারে সারা জীবন উজ্জ্বল হয়ে থাকবে আর দর্শকের মনেও।
ওটিটি মানেই সাহসী কাজ, ওটিটি মানেই একটু ভিন্ন ধরনের কাজ, আর এই দুই পরিপ্রেক্ষিতেই হইচইয়ের অবদান নজরকাড়া। ‘মোবারকনামা’র মাধ্যমে হইচই আরও একবার প্রমাণ করে দিল যে একটা ভালো কাজ দর্শকের মন ছুঁয়ে যায়। এই গল্পের প্লটের পাশাপাশি আরেকটা দুর্দান্ত ব্যাপার হলো এর সংলাপ। বেশ কিছু সংলাপ ইতিমধ্যে ভাইরাল হয়ে গেছে সমাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, কারণ মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে শক্তিশালী সংলাপগুলো। ‘মোবারকনামা’ মুক্তি পাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই চারপাশে হইচই ফেলে দিয়েছে। দর্শকের ভালো লাগার কেন্দ্রে এই সিরিজের বিশিষ্ট সংযোজন হলো এর মিউজিক। সাকী ব্যানার্জির বানানো মিউজিকের বিটগুলো গল্পের সঙ্গে এত সাবলীল হয়ে মিশে গেছে, যা পুরো গল্পটিকে আরও অনবদ্য করে তুলেছে।
সিনেমাটোগ্রাফি যেকোনো কাজের আরেকটা উল্লেখযোগ্য দিক। ‘মোবারোকনামা’য় সিনেমাটোগ্রাফার খসরু তাঁর সর্বোচ্চটা ঢেলে দিয়েছেন, প্রতিটি শট এবং লাইট ডিজাইন গল্পের আবহকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। তা ছাড়া সিরিজটিতে শিল্পী সরকার অপু, শবনম ফারিয়া, সৈয়দ জামান শাওন, সামিয়া অথইসহ সবার অভিনয়ই মন ছুঁয়েছে দর্শকের। গল্প থেকে অভিনয়, সংলাপ থেকে নির্মাণ, সব মিলিয়ে ‘মোবারকনামা’ বেশ উপভোগ্য একটি সিরিজ। এখন দর্শকের প্রত্যাশা এটাই যে এ রকম গল্প যেন ওটিটির জগতে ভবিষ্যতে আরও জায়গা পায়, এ রকম গল্প যেন আরও পৌঁছে যায় আপামর দর্শকের কাছে।