উৎসবের সময় শেষ। এখন সময় শৃঙ্খলার, দেশ গড়ার। আশার কথা, আমাদের তরুণ সমাজের মধ্যে আমি এ বিষয়ে সচেতনতা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু আমাদের আরও সক্রিয় হতে হবে। কারণ, উৎসবের ফাঁকেই একদল লোক বিভিন্ন জায়গায় নৈরাজ্য চালিয়েছে। প্রাণহানি হয়েছে। দেখেন, প্রাণের কোনো রং থাকতে পারে না। পুলিশ হোক, আওয়ামী লীগ হোক, আন্দোলনরত ছাত্র হোক; যেকোনো প্রাণের জন্যই আমাদের মন একইভাবে কাঁদতে হবে।
আমরা গত ১৫ বছর কী দেখেছি? আওয়ামী লীগ এক অমানবিক প্রপাগান্ডা চালিয়ে বিএনপিকে ডিহিউমিনাইজ করেছে। ভিন্নমতাবলম্বী যাকে পেয়েছে, ডিহিউমিনাইজ করেছে। এমনকি সাধারণ কাউকে মারলেও মেরেই বলত, বিএনপি-জামায়াত; যেন বিএনপি মরলে কোনো অন্যায় নাই, বিএনপির নেতা গুম হলে কোনো অন্যায় হচ্ছে না, বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের ছোট মেয়েটা কাঁদলে আল্লাহর আরশ কেঁপে ওঠে না। এর আগে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সময়ও একই মনোভাব দেখেছি বিএনপি নেতাদের মধ্যে, যেন আওয়ামী লীগের নিহত কর্মীর স্বজনদের কান্নার রং আলাদা, যেন আল্লাহর আরশ শুধু একদল নির্দিষ্ট মানুষের জন্য কেঁপে ওঠে।
এই বৃত্ত থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। আমরা আওয়ামী ফ্যাসিজম থেকে স্বাধীনতা অর্জন করেছি আরেকটা ফ্যাসিজম কায়েম করার জন্য নয়। সুতরাং প্রিয় ভাই ও বোনেরা, আপনার যাঁর যাঁর এলাকায় টিম গঠন করে মবিলাইজ করেন, যেন আর একটা প্রাণও না হারায়, একটা বাড়িতেও আগুন না লাগে। বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপিকে সুস্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, আপনাদের দলের মধ্যে এই বার্তা ছড়িয়ে দিন। জামায়াতে ইসলামীকেও একই কথা বলতে চাই। প্রয়োজনে আপনারা পাহারা দিন বিরুদ্ধ পক্ষের বাড়ি-ঘর-প্রতিষ্ঠান। মনে রাখবেন যে ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, সেই একই ভাষায় বাংলাদেশ আর কথা বলুক, এটা আমরা চাই না, আমাদের নতুন প্রজন্ম চায় না। নতুন দেশে নতুন রাজনীতি নিয়ে না এলে নতুন দিনের রাজনীতির ট্রেন আপনাদের ছেড়ে চলে যাবে।
এই প্রতিশোধের রাজনীতি আমরা দেখতে চাই না। আমরা দেখতে চাই না আমাদের হিন্দু সম্প্রদায়ের ভাই-বোনদের বাড়িঘরে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটুক! দুঃখজনক হলো, এটা ঘটেছে কোথাও কোথাও। আমার বন্ধু-ভাই রাহুল আনন্দের বাসায় হামলা হয়েছে। বাদ্যযন্ত্র পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অনেক জায়গায় ভাস্কর্য ভাঙচুর করা হয়েছে। কেন? কারণ, দেশে এই মুহূর্তে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো কার্যক্রম নেই। শেখ হাসিনা যেন সরকারে আসে, সেই জন্য ২০০৮ আমরা সবাই কাজ করেছিলাম। কিন্তু উনি সরকারে এসে আমাদের শিকল উপহার দিলেন, আয়নাঘর বানালেন, নিজের লোকজন দিয়ে লুটপাট করালেন, পুলিশ বাহিনীকে ব্যক্তিগত গুন্ডা বাহিনী বানাতে গিয়ে জনতার বিরুদ্ধে দাঁড় করালেন। শেষমেশ দেশটাকে অরক্ষিত রেখে পালিয়ে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর লিগ্যাসিকে প্রশ্নের মুখে ফেললেন।
এখন আমাদের দরকার দ্রুত সরকার গঠন। পুলিশ বাহিনীর অপরাধীদের সরিয়ে বাহিনীকে কনফিডেন্স দিয়ে কাজে নামানো। পুলিশ বাহিনী আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন। আমি জানি, পুলিশ বাহিনীর ওপর অনেকের ক্ষোভ আছে। কিন্তু পুলিশ বাহিনীর সব সদস্য আওয়ামী–গুন্ডা, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। একটা বাহিনীতে অনেক মানুষ কাজ করেন। বিভিন্ন পরিবার থেকে উঠে আসেন। তাঁদের বিভিন্ন রকম অর্থনৈতিক বাস্তবতা থাকে। ফলে তাঁরা চাইলেও চেইন অব কমান্ড ভেঙে অন্য কিছু করতে পারেন না। আমাদের প্রথম কাজ হবে, পুলিশের চিহ্নিত অপরাধীদের নির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে বিচারের মুখোমুখি করা। একই সঙ্গে পুলিশ বাহিনীকে আস্থা দিতে হবে, ‘তোমরা দুশ্চিন্তা কোরো না, তোমরা আমাদের ভাই; আমাদের বাহিনী।’ যাতে তারাও আস্থা ফিরে পায়।
এসব কাজ করার জন্য দ্রুত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করতে হবে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান করা হয়েছে, এটা আমাদের দেশের জন্য দারুণ খবর। আমি আশা করতে চাই, প্রফেসর ইউনূস সবার সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত, খুবই দ্রুত একটা পূর্ণাঙ্গ সরকার গঠন করবেন। এই সরকারের প্রথম কাজ হবে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করা।
ইতিমধ্যেই সেনাবাহিনী ও সেনাপ্রধান জাতির প্রয়োজনে সঠিক ভূমিকা নিয়েছেন। আমি নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আবারও ইতিবাচকভাবে সক্রিয় করার ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আমাদের নষ্ট করার মতো এক সেকেন্ডও সময় নেই।
ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। কত বড় ঘৃণ্য কাজ, ভাবা যায়! বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান নেতা হিসেবে আপনি বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করে আগাতে পারবেন না। এর আগে আমরা দেখলাম, আওয়ামী লীগ বলার চেষ্টা করছে, জিয়াউর রহমান রাজাকার। এইভাবে আমাদের অতীতকে আমরা যদি অসম্মান করতে থাকি, আমাদের মুক্তি নাই এই কাটাকুটির খেলা থেকে।
আমি মনে করি অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেয়ার পর একটা জরুরি কাজ হবে ৩২ নম্বরে বাড়িটার সংস্কার কাজ শুরু করা। এই বাড়িকে আগের চেহারায় ফিরিয়ে নিয়ে আসা এবং এ বাড়ি-সম্পর্কিত বিভিন্ন ছবি, স্মৃতিস্মারক, যা যা পাওয়া যায়, তা দিয়ে জাদুঘর আবার চালু করা। এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান প্রফেসর ইউনূসের উচিত হবে নিজেই বাড়িটি ভিজিট করা।
তিনি এই বাড়ি ভিজিট করলে একটা সিগনিফিকেন্স তৈরি হবে, একটা বার্তা দেবে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন জায়গায় বীরশ্রেষ্ঠদের ভাস্কর্য ভাঙচুর করা হয়েছে। এগুলো সব ঠিকঠাক করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। বাংলাদেশের মন্দির থাকবে, মসজিদ থাকবে, প্যাগোডা থাকবে, গির্জা থাকবে, বোরকা থাকবে, জিনস থাকবে। সবকিছুই থাকবে বহুজনের এই সমাজে।
আরেকটা বিষয়ে কথা বলতে চাই, হ্যাঁ, আমাদের এখানে একটা গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে। এখন আমাদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাজ হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো, যেমন বিচার বিভাগ, পুলিশ সিভিল প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন, এগুলোকে সংস্কারের ব্যবস্থা করে একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের দিকে যাওয়া। সে নির্বাচনে জনগণ যদি আবার আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসাতে চান, বসাবেন। জনগণ বিএনপিকে বসাতে চাইলে বসাবেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা যদি একটি রাজনৈতিক দল করেন এবং জনগণ যদি তাঁদের ভোট দেন, তাহলে তাঁরা বসবেন। শুধু খেয়াল রাখতে হবে, আমরা ভোট দিয়ে ক্ষমতায় পাঠানোর পর সরকার যেন স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠতে না পারে। বিচার বিভাগ যেন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে। বিচারকেরা যেন স্বাধীন চিন্তার হন। পুলিশ প্রশাসনকে যেন সরকারের আজ্ঞাবহ না হতে হয়। সিভিল প্রশাসনকে যেন সরকারের অন্যায় কাজে সমর্থন না করতে হয়। লোভে হোক অথবা ভয়ে।