আট বছর পর বাংলাদেশে হিন্দি সিনেমা মুক্তি পেয়েছে। বলিউড তারকা শাহরুখ খানের আলোচিত সিনেমা পাঠান বাংলাদেশে মুক্তির প্রথম সপ্তাহে কেমন ব্যবসা করল, সিনেমা হলে দর্শকের উপস্থিতি কেমন—তা নিয়েই এই প্রতিবেদন।
স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে ‘পাঠান’ দেখতে ঢাকার স্টার সিনেপ্লেক্সের বসুন্ধরা শাখায় এসেছিলেন বেসরকারি চাকরিজীবী জহিরুল ইসলাম। টিকিট কাউন্টারে গিয়ে শুনলেন তিনটার শোর টিকিট শেষ। বিরস বদনে ফেরার পথে গতকাল বেলা পৌনে তিনটায় প্রথম আলোকে জানান, লক্ষ্মীপুর থেকে এক কাজে ঢাকায় এসেছেন। একটু ফুরসত পেয়েই সিনেমাটি দেখতে এসেছেন।
কাউন্টারে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, তিনটার শো হাউসফুল। সাতটার শোর কয়েকটি টিকিট রয়েছে। তবে রাতের বাসে জহিরুলের বাড়ি ফেরার তাড়া, পাঠান না দেখেই ফিরতে হলো তাঁদের। তবে শাহরুখ খানের জন্য অপেক্ষায় থাকলেন ফারিয়া মাহমুদ। তিনিও একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। ছুটির দিনে বন্ধুদের নিয়ে পাঠান দেখতে এসেছেন তিনি।
সাতটার শোর টিকিট কেটে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমি শাহরুখ খানের ফ্যান। তাঁর প্রতিটি সিনেমা আমি দেখার চেষ্টা করি। বড়পর্দায় এবারই প্রথম তাঁর সিনেমা দেখব। এটি আমার কাছে ভিন্ন রকমের অভিজ্ঞতা হবে।’
দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক মুক্তবাণিজ্য চুক্তির (সাফটা) আওতায় স্পাই থ্রিলার সিনেমাটি আমদানি করেছে ঢাকার পরিবেশনা প্রতিষ্ঠান অ্যাকশন কাট এন্টারটেইনমেন্ট। প্রায় আট বছর পর ১২ মে বাংলাদেশের সিনেমা হলে মুক্তি পেয়েছে ‘পাঠান’। দ্বিতীয় সপ্তাহে দুটি হল বাড়লেও শো ২০৬ থেকে ১৮৫টিতে নেমেছে।
প্রথম সপ্তাহে বসুন্ধরা শাখা ছাড়াও এসকেএস টাওয়ার, সীমান্ত সম্ভার, সনি স্কয়ারসহ সাতটি শাখায় প্রতিদিন ৩৪টি করে শো চালিয়েছে স্টার সিনেপ্লেক্স। দ্বিতীয় সপ্তাহে হল না কমলেও শো নেমেছে ২১টিতে।
গতকাল বিকেলে স্টার সিনেপ্লেক্সের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক মেসবাহ উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, প্রথম সপ্তাহের শুক্রবার ও শনিবার বেশ কিছু শো হাউসফুল ছিল। দর্শকের মধ্যে তরুণই বেশি, দেশে শাহরুখ খানের অনেক ভক্ত রয়েছেন। সিনেমাটি পুরোনো হলেও ভালো চলেছে।
স্টার সিনেপ্লেক্স ছাড়াও ঢাকার আরও দুই মাল্টিপ্লেক্স ব্লকবাস্টার সিনেমাস ও লায়ন সিনেমাসে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রথম সপ্তাহে সিনেমাটি দেখতে দর্শকের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো।
ব্লকবাস্টার সিনেমাসের বিপণন কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান শুক্রবার বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, হাউসফুল না হলেও দর্শকের উপস্থিতি মোটামুটি সন্তোষজনক। সন্ধ্যার দিকে শোগুলোতে ৮০ ভাগের মতো দর্শক এসেছেন। সকালের শোগুলোতে ৪০ থেকে ৫০ ভাগের মতো দর্শক এসেছেন। সিনেমাটি নিয়ে তরুণদের আগ্রহ বেশি রয়েছে।
প্রথম সপ্তাহে তিন হলে প্রতিদিন নয়টি করে শো চালিয়েছে ব্লকবাস্টার সিনেমাস; দ্বিতীয় সপ্তাহে হলিউডের আলোচিত ‘ফাস্ট অ্যান্ড ফিউরিয়াস’ ফ্রাঞ্চাইজির সিনেমা ‘ফাস্ট এক্স’ মুক্তি পাওয়ায় ‘পাঠান’ সিনেমার শো ছয়টিতে নেমেছে।
দ্বিতীয় সপ্তাহে লায়ন সিনেমাসে একটি হল বেড়েছে, নতুন যুক্ত হয়েছে ঢাকার আরেকটি সিনেমা হল ‘সৈনিক ক্লাব’।
গত ২২ মার্চ ওটিটি প্ল্যাটফর্ম অ্যামাজন প্রাইমে মুক্তির পর শাহরুখ খানের অনুরাগীদের অনেকেই নানা মাধ্যমে সিনেমাটি দেখে ফেলেছেন। তা না হলে ঢাকায় দর্শক আরও বাড়ত বলে মনে করছেন সিনেমা হলের কর্মীরা।
এতে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র-এর (রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং) সাবেক এজেন্ট পাঠান চরিত্রে অভিনয় করেছেন শাহরুখ খান। সিদ্ধার্থ আনন্দ পরিচালিত পাঠান ছবিটিতে শাহরুখ খান ছাড়াও দীপিকা পাড়ুকোন, জন আব্রাহাম, ডিম্পল কাপাডিয়া, আশুতোষ রানাসহ অনেকে আছেন।
৮৫ লাখ টাকার টিকিট বিক্রি
হিন্দি ছবির ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি আয় করা ছবির তালিকায় জায়গা করে নেয় সিনেমাটি। আয় করেছে ১ হাজার ৫০ কোটি রুপি। সিনেমাটির আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান অ্যাকশন কাট এন্টারটেইনমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্মাতা অনন্য মামুন গতকাল প্রথম আলোকে জানান, প্রথম সপ্তাহে (১২ থেকে ১৯ মে) বাংলাদেশে ৪১টি সিনেমা হল মিলিয়ে ৮৫ লাখ টাকার টিকিট বিক্রি (গ্রস) হয়েছে। এর মধ্যে মুক্তির দিনেই বিক্রি হয়েছে ২৫ লাখ টাকার টিকিট।
টিকিট বিক্রির মোট অর্থকে গ্রস বলা হয়, সেখান থেকে করসহ বিভিন্ন খরচ বাদ দিয়ে আয় বের করা হয়। সিনেমাটি প্রথম দিনে কত টাকা আয় করেছে, তা জানাতে চাননি অনন্য মামুন।
টিকিট বিক্রির হিসাব কীভাবে করা হয়েছে—জানতে চাইলে অনন্য মামুন জানান, মাল্টিপ্লেক্সে ই–টিকেটিং থাকায় সহজেই হিসাব পাওয়া গেছে। আর একক হলে আমাদের প্রেরিত প্রতিনিধি টিকিট বিক্রির দেখভাল করেছেন। ফলে টিকিট বিক্রির হিসাবটা সঠিকভাবে পাওয়া গেছে। সপ্তাহখানেক পর একক সিনেমা হলেও ই–টিকেটিং চালু করবেন বলে জানান তিনি।
একক সিনেমা হলে দর্শক–খরা
মাল্টিপ্লেক্সে পাঠান সিনেমা দেখতে দর্শকের উপস্থিতি দেখা গেলেও ঢাকাসহ দেশের একক সিনেমা হলগুলোর চিত্র ছিল ভিন্ন। গতকাল ঢাকার ফার্মগেটের আনন্দ সিনেমা হল ঘুরে দেখা গেছে, দর্শকের সংখ্যা হাতে গোনা। প্রায় ৯০০ দর্শক ধারণক্ষমতার হলটিতে গতকাল সাড়ে ১২টার শোতে মোটে ৪০ থেকে ৫০ জন ছিলেন।
হলটির অপারেটর সোহাগ হোসেন প্রথম আলোকে জানান, সিনেমাটি দর্শকসংখ্যা খুবই কম। শুক্রবার বাদে অন্যান্য দিনে আরও কম দর্শক আসেন। অনেক বাংলা সিনেমাও এটির চেয়ে ভালো চলেছে। সোহাগের ভাষ্যে, অনেক শোতে আলোচিত বাংলা সিনেমা হাওয়া দেখতে ৬০০ দর্শকও দেখেছেন। এরপর পরাণ দেখেছেন। সেই তুলনায় পাঠান সিনেমার দর্শক অনেক কম।
পাঠান সিনেমার জন্য টিকিটের দাম বাড়িয়েছে আনন্দ সিনেমা হল কর্তৃপক্ষ। ৭০ টাকার টিকিট বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকা এবং ৫০ টাকার টিকিট বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকায়।
এর বাইরে ঢাকার মধুমিতাসহ কয়েকটি একক সিনেমা খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাঠান দর্শক–খরায় ভুগছে। ঢাকার বাইরে খুলনার লিবার্টি সিনেমা হল ঘুরে দেখা গেছে, গতকাল দুপুরের শোতে মোটে ৮ জন দর্শক ছিলেন।
হলের কাউন্টার ম্যানেজার মোশারফ হোসেন প্রথম আলোকে জানান, গত এক সপ্তাহে লিবার্টি হলে মোট ৬০ হাজার টাকার টিকিট বিক্রি হয়েছে। ৪০০ সিটের হলে একদিন সর্বোচ্চ ১০০ জন হয়েছিল।
খুলনার আরেক সিনেমা হল শঙ্খ সিনেমা হলের ব্যবস্থাপক রেজাউল করিম বলেন, এক দিনও হাউসফুল যায়নি। খুব ভালো না, একেবারে খুব খারাপ, তা–ও না। এর চেয়ে ‘লিডার: আমিই বাংলাদেশ’ ভালো ছিল। ২৫ ভাগ দর্শক দেখেছেন।
তিনি জানান, এর আগে ‘হাওয়া’, ‘পরাণ’, ও ‘অপারেশন সুন্দরবন’ ভালো গেছে।