রূপকথার গল্পে যেমনটা থাকে, একদিন এক রাজপুত্র বের হয় তাঁর রাজকন্যার খোঁজে। দেখা হয় চোখধাঁধানো এক লাস্যময়ীর সঙ্গে। তাঁদের দেখা হয়, কথা হয়, প্রেম হয়, এরপর হয় রূপকথার মতো বিয়ে। এতটুকু শুনে অনেকেই ভাবতে পারেন, এটা বুঝি প্রিন্স চার্লস আর প্রিন্সেস ডায়ানার গল্প। না, গল্পটা আরও একটু পুরোনো। রূপকথার রাজকীয় এই বিয়ের গল্প মোনাকোর রাজা প্রিন্স রেইনিয়ার ও হলিউড অভিনেত্রী গ্রেস কেলির। ১৯ এপ্রিল ছিল তাঁদের রাজকীয় বিয়ের ৬৮তম বার্ষিকী। এ রকম এক সময়ে আরও একবার গ্রেসের লাবণ্য, মাধুর্য আর ত্যাগের গল্প ঝালাই করে নিই। নায়িকা থেকে রাজকন্যার জীবনে পা রাখার দিনটি বদলে দিয়েছিল গ্রেস কেলির জীবন। আর লোকমতে, এই দিন থেকেই শুরু হয়েছিল মোনাকোর সুসময়।
গ্রেস কেলি তাঁর ‘গ্রেস’ অর্থাৎ মাধুর্য দিয়ে পুরো পঞ্চাশ দশকের হলিউডকে কাবু করে রেখেছিলেন। রুপালি পর্দায় তাঁর মনকাড়া অভিনয় আর লাস্যময় উপস্থিতি সে সময় স্পষ্ট জানান দিয়েছিল, হলিউডের রানি তিনি! কে ভেবেছিল, এই দোর্দণ্ড প্রতাপশালী নায়িকা এক রাজপুত্রের প্রেমে পড়ে হলিউডে নিজের গড়া সিংহাসন ছেড়ে পাড়ি জমাবেন ভিনদেশে, প্রেমের টানে নায়িকার তকমা মুছে হয়ে উঠবেন প্রিন্সেস গ্রেস।
এক সচ্ছল মার্কিন পরিবারে ১৯২৯ সালে জন্ম হয় গ্রেস কেলির। বাবা ছিলেন অলিম্পিক স্বর্ণজয়ী ক্রীড়াবিদ, আর মা ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার প্রথম নারী ক্রীড়া প্রশিক্ষক। বাড়ির চার সন্তানের মধ্যে গ্রেস তৃতীয়। ছেলেবেলা থেকেই অভিনয়ের পোকা মাথায় ঢোকে গ্রেসের। হাইস্কুলের পাট চুকিয়ে নাম লেখান আমেরিকান একাডেমি অব ড্রামাটিক আর্টসে। যদিও গ্রেসের বাবা জ্যাক কেলির কাছে অভিনয় ছিল ‘নীচু’ কাজের একটি। তাই অভিনয়জীবনের শুরুর ধাপে বাবার মন গলানো থিল গ্রেসের জন্য এক বিরাট ব্যাপার।
১৯ বছর বয়সে অভিনয়ের একাডেমি থেকে গ্র্যাজুয়েট করেন গ্রেস কেলি। শুরু করেন ব্রডওয়েতে মঞ্চাভিনয়ের জীবন। কিন্তু তাতে খুব যে সাফল্য আসে, তা নয়। ডন রিচার্ডসন নামে গ্রেসের ব্রডওয়ে অভিনয়ের শিক্ষক ও পরিচালক বলেছিলেন, ‘মঞ্চে থাকলে কোনো দিনও সফল হতো না গ্রেস কেলি। ও দেখতে দারুণ, স্টাইলে অনবদ্য, কিন্তু কণ্ঠে জোর ছিল না।’
গ্রেস তাঁর খামতি বুঝতে সময় নেননি। অল্প দিনের মধ্যেই মঞ্চ থেকে সরে গিয়ে হলিউডে নাম লেখান তিনি। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে মাত্র। মার্কিন মুলুকে টেলিভিশন আর সিনেমার ব্যবসা ঊর্ধ্বমুখী। গ্রেস ঠিক তখনই নিজের উপস্থিতি জানান দেন হলিউডে। হলিউড তল্লাটে পা ফেলতে না ফেলতেই ১১টি চলচ্চিত্র আর ৬০টিরও বেশি টেলিভিশন প্রডাকশনের কাজ চলে আসে তাঁর। সেই যে শুরু, হলিউডে গ্রেস কেলির এই জয়রথ তখনো কেউ ভাবেনি যে এত জলদি থেমে যাবে।
ব্যস্ততম নায়িকা গ্রেস
পঞ্চাশ দশকের হলিউডে গ্রেস কেলি ছিলেন সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পাওয়া অভিনেত্রী। পত্রপত্রিকার শিরোনামে তাঁর উপস্থিতি হয়ে উঠেছিল রোজকার ব্যাপার। তাঁর প্রথম সিনেমা ‘ফোরটিন আওয়ার্স’ মুক্তি পায় ১৯৫১ সালে। এরপর একের পর এক গ্রেসের সিনেমা আসতেই থাকে। তিনি হয়ে ওঠেন আলফ্রেড হিচকক, জন ফোর্ড, চার্লস ওয়াল্টার্সের মতো নির্মাতাদের প্রিয় শিল্পী। ১৯৫৪ সালের ‘দ্য কান্ট্রি গার্ল’ ছবির জন্য ঘরে তোলেন সেরা অভিনেত্রীর অস্কার। কিন্তু নিয়তি যাকে রাজা, রাজত্ব আর সিংহাসনের দিকে নিয়ে যায়, তাতে বাধা দেওয়ার সাধ্যি কার!
রাজকন্যার খোঁজে রাজপুত্র
১৯৫৫ সাল। গ্রেস কেলির অভিনয়ের ক্যারিয়ার তখন তুঙ্গে। সে বছর মার্কিন প্রতিনিধিদলের হয়ে কান চলচ্চিত্র উৎসবে যোগ দেওয়ার সুযোগ পান তিনি। সেখানে গিয়ে সহকর্মী ও অভিনেত্রী অলিভিয়ি ডি হেভিল্যান্ড্রের কাছে জানতে পারেন মোনাকোর রাজপুত্রও এসেছেন কান চলচ্চিত্র উৎসবে, দেখা করতে চান গ্রেসের সঙ্গে। কিন্তু গ্রেস উৎসবে এসেছিলেন প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান এমজিএমের সৌজন্যে। তাই তাদের অনুমতি ছাড়া কোথাও যাওয়ার সুযোগ ছিল না তাঁর। এমজিএম অবশ্য রাজপুত্রের আগ্রহের কথা শুনে অনুমতি দিয়েও দেয়, কিন্তু একটা শর্তও জুড়ে দেয়। তাদের চাওয়া ছিল, গ্রেস তখনই রাজপুত্রের সঙ্গে দেখা করতে পারবে, যখন রাজপুত্র অনুমতি দেবে এই সাক্ষাতের ছবি পত্রপত্রিকায় ছাপানোর।
মোনাকোর রাজপুত্র রেইনিয়ার তখন ছিলেন বেশ চাপে। তাঁর রাজ্যে উত্তরাধিকার হস্তান্তর নিয়মে সে সময় উল্লেখ ছিল, যদি রাজপুত্রের বৈধ কোনো ঔরসজাত সন্তান না থাকে, তাহলে মোনাকো রাজ্যের ক্ষমতা চলে যাবে ফ্রান্সের হাতে। গিজেল প্যাসকেল নামের এক ফরাসি অভিনেত্রীর সঙ্গে দীর্ঘদিনের প্রেম ছিল রেইনিয়ারের। কিন্তু একসময় জানতে পারেন গিজেল কখনো মা হতে পারবেন না। তাই রাজ্যের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সেই সম্পর্কে ইতি টানতে হয় প্রিন্স অব মোনাকোকে। এর পর থেকেই ৩২ বছর বয়সী রাজপুত্র রেইনিয়ার তাঁর রাজ্য বাঁচাতে হন্যে হয়ে নিজের জন্য সুপাত্রী খুঁজছিলেন, যাঁর গর্ভে নিজের উত্তরাধিকারের জন্ম দেবেন। সুপাত্রীর বর্ণনায় প্রিন্স রেইনিয়ার নাকি বলেছিলেন, ‘শরতের ঝরা পাতা-রঙা এলোকেশী একজনকে আমি চাই, যার চোখ হবে নীল কিংবা বেগুনি, আর সেই সঙ্গে থাকবে হালকা সোনালি আভা।’
রেইনিয়ার রাজ্য বাঁচানোর জন্য রাজকন্যাকে খুঁজলেও গ্রেস কেলি কিন্তু অত সাতপাঁচ ভাবেননি। রেইনিয়ার-গ্রেসের সাক্ষাতের দিন নাকি কান শহরে হঠাৎ বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। অগত্যা গ্রেস এলোমেলো চুল আর কুঁচকে যাওয়া পোশাকে রাজপুত্রের সঙ্গে দেখা করতে চলে যান। আর প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ে যান। রাজপুত্রও গ্রেসের ঝরা পাতা-রঙা এলোচুল আর সাদামাটা সাদ পোশাকের মধ্যেই নিজের রাজকন্যাকে খুঁজে পান। এরপর মাস সাতেক চলে তাঁদের বহুল চর্চিত প্রেম।
স্বপ্নের জীবন থেকে রূপকথার জীবনে
অভিনেত্রী হওয়ার স্বপ্ন গ্রেস কেলি ছেলেবেলা থেকেই দেখতেন। কিন্তু প্রেমে পড়ার পর রেইনিয়ার বিয়ের জন্য গ্রেসকে হলিউড ছাড়ার অনুরোধ করেন। স্বপ্নের জীবন ত্যাগ করে গ্রেস বেছে নেন রাজকীয় জীবন। রূপকথার মতো ছিল রাজকীয় সেই জীবন। ১৯৫৬ সালের ১৯ এপ্রিল, ৬৮ বছর আগের এই দিনেই স্বপ্নকে বিদায় জানিয়ে রাজা আর রাজত্বকে আগলে নেন গ্রেস কেলি। শুধু অভিনয়ই নয়, রাজপুত্র রেইনিয়ারকে বিয়ে করার জন্য গ্রেস কেলিকে তাঁর মার্কিন নাগরিকত্বও ছাড়তে হয়। অন্যতম স্মরণীয় আর জাঁকজমকপূর্ণ বিয়ে হিসেবে এখনো ইতিহাসে প্রিন্স রেইনিয়ার ও গ্রেস কেলির নাম খুঁজে পাওয়া যায়।
নামজাদা তারকা, বিশ্বখ্যাত রাজনীতিক, সংগীতজ্ঞ থেকে শুরু করে প্রায় ৭০০ প্রভাবশালী অতিথি মোনাকো শহরে রেইনিয়ার-গ্রেসের বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন। প্রায় তিন কোটি মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই বিয়ের সরাসরি সম্প্রচার দেখেছিল।
মোনাকোতে প্রচলিত আছে, রেইনিয়ার-গ্রেসের বিয়ের পর থেকে তাঁদের রাজ্যের ভাগ্য বদলাতে শুরু করে। সাফল্য আর সমৃদ্ধি বয়ে আনে রাজকীয় এই বিয়ে। গ্রেসের ত্যাগ আর স্বপ্ন বিসর্জন মোনাকোর রাজপরিবারকে দেয় তাঁদের উত্তরাধিকারী। শুধু তা-ই নয়, মোনাকোর ইতিহাসের অন্যতম সফল রাজা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন রেইনিয়ার। যেই মোনাকোকে একসময় শুধু ক্যাসিনো আর জুয়ার জন্য চিনতে বিশ্ববাসী, রেইনিয়ার সেই ধারণা বদলে মোনাকোকে শিল্প-সংস্কৃতির শহর হিসেবে বিশ্বের সামনে তুলে ধরে। অন্যদিকে অভিনয় ছেড়ে সংসার ও দাতব্য কাজে মন বসানো গ্রেস কেলি তিন সন্তান জন্ম দিয়ে রক্ষা করেন মোনাকো রাজপরিবারের পতন। মোনাকো রাজ্য সাফল্য আর সচ্ছলতায় প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। দেশটি পর্যটকদের কাছে প্রিয় হতে শুরু করে।
এক বিষাদময় সমাপ্তি
অভিনেত্রী সত্তাকে ত্যাগ করলেও খ্যাতি কখনোই গ্রেসকে ছেড়ে যায়নি। বরং অভিনেত্রী গ্রেসকেও কিছু ক্ষেত্রে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন প্রিন্সেস গ্রেস। তাঁর দাতব্য কাজ, নিজ হাতে গড়া ‘প্রিন্সেস গ্রেস ফাউন্ডেশন’ বেশ আলোড়ন তুলেছিল সে সময়।
১৯৮২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ৫২ বছর বয়সী প্রিন্সেস গ্রেস কেলি তাঁর ছোট মেয়ে স্টেফানিকে (১৭) নিয়ে তাঁদের ফ্রান্স-মোনাকো সীমান্তবর্তী অবকাশযাপনের বাংলো থেকে ফিরছিলেন। অনেক মালপত্র ছিল তাঁদের সঙ্গে। পুরো গাড়ি বোঝাই হয়ে যাওয়ায় গাড়িচালককে রেখে গ্রেস নিজেই বসে পড়েন চালকের আসনে। মাত্র ৩৫ মিনিটের পথ। সহজেই বাড়ি পৌঁছে যাবেন এই ভেবে মেয়েকে পাশের সিটে বসিয়ে রওনা দেন বাড়ির দিকে। কিন্তু রওনা হওয়ার ১০ মিনিটের মাথায় ‘ডেভিল’স কার্স’ নামের একটি দুর্ঘটনাপ্রবণ রাস্তায় ইউ-টার্ন করতে গিয়ে খাদে পড়ে যায় অস্কারজয়ী এ অভিনেত্রীর গাড়ি। ধারণা করা হয়, ওই সময় স্ট্রোক করেছিলেন গ্রেস। যার ফলে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনাটি ঘটে। মেয়ে স্টেফানি বেঁচে গেলেও গুরুতর আহত হন গ্রেস। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় মোনাকো হাসপাতালে। অস্ত্রোপচারের পরও জ্ঞান ফেরে না গ্রেসের। তাঁকে রাখা হয় লাইফ সাপোর্টে। তবে লাইফ সাপোর্ট দিয়েও তাঁকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয় না। ১৪ সেপ্টেম্বর সকালে তিনি মারা যান।
এত ত্যাগ আর বিসর্জন দিয়ে গড়া রাজ্যে তিনি আর ফিরতে পারেননি। গ্রেস কেলির গল্পটা রূপকথার মতো হলেও জীবনের চূড়ান্ত ‘ট্র্যাজেডি’ থেকে নিজেকে তিনি বাঁচাতে পারেননি।
গ্রেস কেলি মারা যাওয়ার পর প্রিন্স রেইনিয়ার আর বিয়ে করেননি। মন বসিয়েছিলেন রাজ্য সামলানোতেই। দিনে ৬০টির মতো সিগারেট খাওয়ার বদভ্যাস হয়ে গিয়েছিল তাঁর। যার ফলে লম্বা সময় রোগভোগের পর ২০০৫ সালে মারা যান তিনি।
গার্ডিয়ান, বায়োগ্রাফি ডটকম, বিজনেস ইনসাইডার, পিপল ম্যাগাজিন, ভ্যানিটি ফেয়ার ও ডেইলি মেইল অবলম্বনে