টমেটো বিক্রি করতে বাহামা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে যেতেন সিডনির কৃষক মা–বাবা। এ রকম এক সময়ে সিডনির জন্ম। সেই সূত্রে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পান। দূরসম্পর্কের আত্মীয়েরা বলেন, সিডনির বাবা ছিলেন হাইতির মানুষ, যাঁদের পূর্বপুরুষ পালিয়ে বাঁচা দাস। এসব গল্পের জন্য ইতিহাসের পাতায় জায়গা বড় কম। তারও চেয়ে অনেক অনেক জায়গাজুড়ে লিখতে হবে অভিনেতা সিডনি পটিয়ের কীর্তি। গত শুক্রবার ৯৪ বছর বয়সী এই অভিনেতা প্রয়াত হয়েছেন।
স্মরণীয় থাকবেন তিনি
সিডনির পরিচয়—অভাবনীয় এক অভিনেতা। তিনি বলতেন, অভিনয় ছলাকলা নয়, অনুশীলনের মাধ্যমে চরিত্রকে বাস্তব করে তোলা। ব্যতিক্রম সব ভূমিকায় অভিনয় করে হলিউডকে যাঁরা মর্যাদাপূর্ণ জায়গায় নিয়ে গেছেন, পটিয়ে তাঁদের অন্যতম। নিউইয়র্কে যাওয়ার আগে ১৫ বছর বয়সে মিয়ামিতে ভাইয়ের কাছে থাকতে গিয়ে টের পেয়েছিলেন, ‘কালো’ বলে ভীষণ অবজ্ঞা করা হচ্ছে তাঁকে। এমনকি বাসন ধোয়ার কাজ পেতেও গায়ের রং আর গোত্রপরিচয় তাঁকে ভুগিয়েছে। পরের গল্প হচ্ছে, মার্কিন দেশে বর্ণবাদের রুদ্ধ দুয়ার গুঁড়িয়ে দিয়েছেন তিনি।
সেনাবাহিনীতে কাজের সুযোগ পেয়েছিলেন সিডনি। পরে যোগ দেন আমেরিকান নিগ্রো থিয়েটারে, ১৯৪০ সালে শুরু হয় তাঁর অভিনয়জীবন। ১৯৪৯ সালে তাঁকে নিতে হয় কঠিন সিদ্ধান্ত। মঞ্চ ছেড়ে তিনি যোগ দেন সিনেমায়। ‘কালো’ মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে হলিউডে এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে বিজয়ী হন তিনি। তাঁর অস্কারপ্রাপ্তি প্রমাণ করেছে, বর্ণ নয়, মেধাই সব। নয়তো তাঁর অভিনীত ছবিগুলো কি আর কাড়ি কাড়ি টাকা রোজগার করতে পারে?
চলচ্চিত্রে সিডনি পটিয়ে
১৯৫০ সালে নো ওয়ে আউট ছবিতে সিডনির অভিনয় মানুষের নজর কাড়ে। নতুন চাকরি পাওয়া এক চিকিৎসক ও বর্ণবাদী রোগীকে নিয়ে ছবির কাহিনি। ১৯৫৫ সালে দ্য ব্ল্যাকবোর্ড জঙ্গল ছবিটি পেয়ে যায় অভাবনীয় জনপ্রিয়তা। প্রথমবারের মতো হলিউডের কোনো ছবিতে রক অ্যান্ড রোলের ব্যবহার দেখা যায়, আর ‘রক অ্যারাউন্ড দ্য ক্লক’ গানটিও সেই জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ। ১৯৫৮ সালে ‘দ্য ডিফায়েন্ট ওয়ানস’ ছবির জন্য তিনি পেয়ে যান অস্কারের মনোনয়ন আর বাফটার পুরস্কার। ১৯৬৩ সালে ‘লিলিস অব দ্য ফিল্ড’ ছবির জন্য পান অস্কার। ১৯৬৭ সালে বাণিজ্যিক ছবির প্রভাবশালী অভিনয়শিল্পী হয়ে ওঠেন পটিয়ে। ১৯৭০ সালে তিনি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান খোলেন। ১৯৭৩ সালে পরিচালক হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন।
পটিয়ের বিপুল প্রাপ্তি
জীবদ্দশায়ও মানুষের শ্রদ্ধা–ভালোবাসা কম পাননি এই অভিনেতা। তিনিই প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ, যিনি অস্কারে সেরা অভিনেতা হিসেবে শুরুতে মনোনয়ন ও পরে পুরস্কার পান। আরও পেয়েছেন গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড, দুটি গোল্ডেন গ্লোব, একটি ব্রিটিশ অ্যাকাডেমি ফিল্ম আওয়ার্ড। ১৯৭৪ সালে পান ‘নাইট’ খেতাব। ১৯৯৫ সালে কেনেডি সেন্টার সম্মাননা, ২০০৯ সালে বারাক ওবামা তাঁকে পরিয়ে দেন প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম। ১৯৯২ সালে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে আমেরিকান ফিল্ম ইনস্টিটিউট তাঁকে দিয়েছে আজীবন সম্মাননা। পাঁচ বছর পর তিনি জাপানে বাহামার রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হন। ২০১৬ সালে বাফটা তাঁকে দেয় ফেলোশিপ। নিজেকে বর্ণবাদ ও ভেদাভেদ বিরোধিতার প্রতীক মনে করতেন এই অভিনেতা।
বৃক্ষবিদায়
১৯৫০ সালে পটিয়ে বিয়ে করেন হোয়ানিতা হার্ডিকে। ১৯৬৫ সালে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। ১৯৭৬ সালে বিয়ে করেন কানাডীয় অভিনেত্রী জোয়ানা শিমকেসকে। দুই সংসারে তাঁর ছয় সন্তান। মার্কিন টেলিভিশন অভিনেত্রী সিডনি তামিয়া পটিয়ে তাঁদের একজন। পটিয়ের প্রয়াণে তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন বিশ্ব সিনেমার শিল্পী ও তারকারা। সেই তালিকায় আছেন অভিনেত্রী ভায়োলা ডেভিস, কেরি ওয়াশিংটন, পরিচালক টেলার পেরি, অভিনেতা ডেনজেল ওয়াশিংটন, অভিনেত্রী ডেবি অ্যালেন এবং সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্রমুখ। বারাক ওবামা লিখেছেন, যুগান্তকারী ভূমিকা এবং একক প্রতিভায় সিডনি পোটিয়ে সম্মান অর্জন করেছেন। চলচ্চিত্রে তাঁর ক্ষমতা আমাদের কাছাকাছি এনেছে। একটি প্রজন্মের অভিনয়শিল্পীদের সুযোগের দরজা খুলে দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর পরিবার এবং বিপুল ভক্তকুলকে মিশেল ও আমার ভালোবাসা। হ্যালি বেরি লিখেছেন, প্রিয় সিডনি, তোমার প্রয়াণে আমার হৃদয়টা কাঁদছে। ৯৪ বছরে এই গ্রহে তুমি অসাধারণ স্বাক্ষর রেখে গেলে...
পটিয়েকে আলিঙ্গনরত একটি ছবি পোস্ট করে খ্যাতিমান মার্কিন টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব অপরা উইনফ্রে লিখেছেন, ‘মাথার ওপর থেকে বিরাট বৃক্ষটি সরে গেল। গুরু–শিক্ষক–বন্ধু–ভাই–আত্মবিশ্বাস মানতাম তাঁকে। শ্রদ্ধা করতাম, ভালোবাসতাম। তাঁর মহৎ, সদয়, বাকপটু জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা। আমি তাঁকে হৃদয়ে রাখতাম, আদরে রাখতাম। তাঁর হৃদয়টা ছিল বিশাল, যা আমি চিরতরে লালন করব। জোয়ানা ও তাঁর সুন্দর সন্তানদের মঙ্গল কামনা করি।’
সমাজ জয়, ক্যানসার জয়
১৯৯০ সালে ৬৬ বছর বয়সে পটিয়ের প্রোস্টেট ক্যানসার ধরা পড়ে। ১৯৯৩ সালে অস্ত্রপোচারের মাধ্যমে সেটি অপসারণ করা হয়। মার্কিন সিনেমাগুলোয় পটিয়ে অভিনীত চরিত্রগুলো বর্ণবাদের ট্যাবু ভেঙে সমাজকে উদার হতে ভূমিকা রেখেছে। এ ক্ষেত্রে তিনি রোল মডেল। তিনি বলেছিলেন, ‘সামান্য কিছু ভালো কাজের জন্য যদি কেউ আমাকে মনে রাখে, আমার উপস্থিতি যদি কাউকে ইতিবাচক শক্তি যোগায়, সেটুকুই যথেষ্ট।’