টম ক্রুজ নামটা পড়েই হয়তো আপনার কিছু অ্যাকশন দৃশ্য চোখে ভাসছে। কেননা লোকটাকে বেশি দেখা গেছে অ্যাকশনধর্মী চলচ্চিত্রেই। কখনো উড়োজাহাজের চাকা ধরে ঝুলছেন, আবার কখনো তাঁকে দেখা যায় উঁচু ভবনের ছাদ থেকে লাফ দিতে। কখনো দেখা যায়, মেরে একাকার করছেন প্রতিপক্ষের লোকজনকে। চিত্র সমালোচকেরা কৌতুক করে বলে থাকেন, টম ক্রুজের দৌড় মানেই ছবি সুপারহিট। টম ক্রুজ থাকা মানেই চলচ্চিত্র নির্মাতাদের বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা।
টম ক্রুজ আজ জীবন দৌড়ের ৫৭ বছর পূর্ণ করলেন। ১৯৬২ সালের আজকের দিনে নিউইয়র্কের সারাকুজে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তাঁর প্রকৃত নাম টমাস ক্রুজ ম্যাপোথার চতুর্থ। বাবা প্রকৌশলী, মা শিক্ষিকা। ক্রুজ স্কুলজীবনে অ্যাথলেট হিসেবে যথেষ্ট সক্রিয় ছিলেন, আর প্রায় প্রতি রাতেই ফোর হকি খেলতেন।
হতে চেয়েছিলেন ধর্মযাজক
টম ক্রুজের ছোটবেলায় স্বপ্ন ছিল ক্যাথলিক গির্জার যাজক হওয়ার। সেভাবেই সবকিছু এগোচ্ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় সেন্ট ফ্র্যান্সিস সেমিনারিতে নিয়মিত যাতায়াত করতেন টম ক্রুজ। সেমিনারিতে শিক্ষার্থী হিসেবে ছিলেন প্রায় তিন বছর। হঠাৎই একদিন টম ক্রুজ ও তাঁর বন্ধুরা কয়েক বোতল অ্যালকোহল পেয়ে যান এবং সেগুলো তাঁরা লুকিয়ে রাখেন। তাঁদের পরিকল্পনা ছিল পরে তাঁরা কোনো একসময় এগুলো খাবেন। কিন্তু তাঁদের পরিকল্পনার কথা আগেই জেনে যান সেমিনারির অন্য কিছু ছেলে। তাঁরা সেগুলো পান করে মাতাল হন। মাতাল অবস্থায় ধরা পড়েন যাজকদের হাতে এবং ছেলেগুলো টম ক্রুজদের নাম বলে দেন। এরপর সেমিনারি স্কুল থেকে তাঁদের মা–বাবার কাছে চিঠি লেখা হয়। পরে তাঁরা বের হয়ে চলে আসেন।
একসময় কুস্তিগিরও হতে চেয়েছিলেন টম ক্রুজ। কিন্তু এখানেও স্বপ্ন ভঙ্গ। একসময় হাইস্কুলের কুস্তি দলের সদস্যও হয়েছিলেন। কিন্তু হাঁটুতে আঘাত পাওয়ার কারণে তিনি কুস্তি ছেড়ে অভিনয় শুরু করেন। হেনরি মুনরো মিডল স্কুলে পড়াকালে ক্রুজ নাটকের সঙ্গে জড়িত হন। তাঁর অভিনীত প্রথম নাটকের নাম ‘আইটি’। ১৯৮১ সালে ক্রুজ ‘এন্ডলেস লাভ অ্যান্ড ট্যাপস’ ছবিতে সহকারী চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে চলচ্চিত্র জীবন শুরু করেন।
বারবার সংসার
ক্রুজ প্রথম বিয়ে করেন মিমি রজারসকে। ১৯৮৭ সালে ৩১ বছর বয়সী মিমি রজারকে বিয়ের সময় ক্রুজের বয়স ছিল ২৪। দুই বছর বাদে তাঁরা আলাদা হয়ে যান। মিমির বয়স তখন ছিল ৩৩। বিচ্ছেদের কারণ সম্পর্কে ১৯৯৩ সালে এক সাক্ষাত্কারে মিমি মজা করে বলেছিলেন, ‘বলা যায়, সন্ন্যাসীর ব্রত নেওয়ার জন্য মনস্থির করে ফেলেছিল টম। সে সময় আত্মিক চাহিদা পূরণেই ব্যস্ত থাকত সে। কাজেই তাঁর সঙ্গে বিচ্ছেদ ছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিল না আমার জন্য।’
১৯৯০ সালে ক্রুজ বিয়ে করেন ২৩ বছর বয়সী নিকোলে কিডম্যানকে। ২০০১ সালে যখন তাঁদের বিচ্ছেদ হয়, সে সময় বিচ্ছেদের কারণ সম্পর্কে নিকোলের ভাষ্য ছিল, ‘আমার জীবনের মূল দর্শন হলো প্রচণ্ড ভালোবাসায় ডুবে থাকা। টমের সঙ্গে সংসার করার পর উপলব্ধি করলাম, জীবন নিয়ে আমি যেমন স্বপ্ন দেখেছিলাম, তা ভুলে যেতে হবে। আমি তার কাছে থেকে যা পেয়েছি, তার চেয়ে অনেক বেশি দিতে হয়েছে। এসব কারণেই আমাদের ঘর ভেঙেছিল।’
২০০৬ সালে ২৭ বছর বয়সী কেটি হোমসকে বিয়ে করেন ৪৪ বছরের ক্রুজ। ৬ বছর পর টমের সঙ্গে বিচ্ছেদ হয় কেটির। কেটি জানান, ক্রুজকে বিয়ের পর থেকে তাঁর পেশাগত জীবনে স্থবিরতা চলে এসেছে। কিন্তু আবারও তিনি অভিনয়ে ফিরতে চান। এ ছাড়া সন্তান লালন-পালন নিয়েও ক্রুজের সঙ্গে মতানৈক্য রয়েছে কেটির। মেয়ে সুরিকে আর দশটা সাধারণ শিশুর মতোই বেড়ে তুলতে চান কেটি। কিন্তু সুরিকে অগোছাল জীবনযাপনে অভ্যস্ত করে তুলছেন ক্রুজ।
দৌড়ে সাফল্য
১৯৮৩ সালে ‘অল দ্য রাইট মুভস’ এবং ‘রিস্কি বিজনেস’ ছবির মাধ্যমে টম ক্রুজের বর্ণাট্য অভিনয় জীবনের সাফল্যগাথা শুরু হয়। ১৯৮৬ সালে ‘টপ গান’ ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে তারকা খ্যাতি পেয়ে যান এ তারকা। ১৯৯৬ থেকে ২০১১, এ সময়টিতে ‘মিশন ইমপসিবল’ ছবির সিরিজগুলোতে অভিনয় করেন হলিউডের এই তারকা।
চলচ্চিত্রের রেটিং দেওয়া প্রতিষ্ঠান রটেন টম্যাটোস গত বছরের আগস্টে জানিয়েছে, যে চলচ্চিত্রে টম ক্রুজ যত বেশি দৌড়ান, সেই ছবির ব্যবসা তত বেশি হয়! এর বিস্তারিত ফিরিস্তিও দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। যেখানে রটেন টম্যাটোস বলছে, সিনেমা হলের পর্দায় ঘণ্টায় গড়ে ১০ মাইল গতিতে দৌড়ান টম ক্রুজ। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, প্রতি সেকেন্ডে ১৪ দশমিক ৭ ফুট পেরিয়ে যান টম। তিনি ন্যূনতম ১ হাজার ফুট দৌড়েছেন এমন চলচ্চিত্রের একটি তালিকা করেছে রেটিং দেওয়া প্রতিষ্ঠানটি। তাতে দেখা গেছে, টম ক্রুজের অত্যধিক দৌড়াদৌড়িতে বক্স অফিস ভালোই জমে। এতে প্রযোজকের পকেট ফুলেফেঁপে যেমন ওঠে, সমালোচকেরাও দেন স্টার মার্কস।
মেন্টাল ফ্লসের এক খবরে বলা হয়েছে, যেসব চলচ্চিত্রে টম ক্রুজ এক হাজার ফুটের বেশি দৌড়েছেন, ওই সব ছবি বিশ্বজুড়ে গড়ে ৫৩৮ মিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করে থাকে। সমালোচকেরাও সেগুলোকে দিয়েছেন ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া। অবশ্য কিছু ব্যতিক্রম আছে। ২০১২ সালের ফ্র্যাঞ্চাইজি ছবি ‘জ্যাক রিচার: নেভার গো ব্যাক’, গত বছরের ‘দ্য মামি’ বা ২০০১ সালের ‘ভ্যানিলা স্কাই’-এ দৌড়-মারধর কম করেননি টম। কিন্তু সেগুলো তুলনামূলকভাবে সমালোচকদের বেশি প্রশংসা পায়নি। বক্স অফিসও পাত্তা দিয়েছে কম।
সিনেট অনলাইনের বিশ্লেষণ, টম বেশি দৌড়ালে ছবি হিট হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ বেশি দৌড়ানো মানেই বেশি অ্যাকশন। আর যত অ্যাকশন, তত পয়সা। সিনেটের খবরে বলা হয়েছে, মিশন ইম্পসিবল সিরিজের তৃতীয় কিস্তিতে ৩ হাজার ২১২ ফুট দৌড়েছেন টম ক্রুজ। এই ছবি আয় করেছে ১৩ কোটি ৩৪ লাখ ডলার। একই সিরিজের ‘ঘোস্ট প্রটোকল’-এ ৩ হাজার ৬৬ ফুট দৌড়ানোয় প্রযোজকের পকেটে ঢুকেছে ২০ কোটি ৯৩ লাখ ৬৪ হাজার ৯২১ ডলার। ‘ওয়ার অব দ্য ওয়ার্ল্ডস’-এ ভিনগ্রহের প্রাণীদের ভয়ে ১ হাজার ৭৫২ ফুট দৌড়েছেন টম ক্রুজ। তাতে আয় হয়েছে ২৩ কোটি ৪১ লাখ ৪১ হাজার ৮৭২ ডলার। এই তিন ছবিতেই সবচেয়ে বেশি দৌড়েছেন টম।
ভ্যানিটি ফেয়ার বলছে, এই বয়সেও বুড়িয়ে যাননি ক্রুজ ওরফে ইথান হান্ট। বরং অ্যাকশন চলচ্চিত্রে আরও বেশি সক্রিয় তিনি। এখনো নিজের স্টান্ট নিজেই করেন ক্রুজ। এতে রুপালি পর্দার দৃশ্য বাস্তবঘেঁষা হয়। আর সেই কেরামতি দেখতে টিকিট কেটে হলে ঢুকতে ঢল নামে দর্শকের।
অস্কার নেই
টম অনুরাগীরা হয়তো অবাক হবেন, একটার পর একটা বাণিজ্যিক সাফল্যের ছবি উপহার দিলেও টমের ঝুলিতে আজ পর্যন্ত অস্কার জোটেনি। তিনবার মনোনয়ন পেয়েছিলেন। তাই বলে টম ক্রুজের অভিনয়ের স্বীকৃতিও কম নয়, এখন পর্যন্ত তিনটি গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন এবং তিনটি একাডেমি অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনয়ন পেয়েছেন। ১৯৯০, ১৯৯১ ও ১৯৯৭ সালে ‘পিপল ম্যাগাজিন’ ক্রুজকে বিশ্বের ৫০ জন সুন্দরতম মানুষের মধ্যে স্থান দিয়েছে।
১৯৯৫ সালে ‘এমপায়ার’ ম্যাগাজিন ক্রুজকে চলচ্চিত্র ইতিহাসে ১০০ জন যৌন আবেদনময় তারকার মাঝে স্থান দেয়। এমনকি ২০০৬ সালে ‘ফোর্বস’ ও ‘প্রিমিয়ার’ ম্যাগাজিন তাঁকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী তারকা হিসেবে আখ্যায়িত করে। ২০১৩ সালের বিশ্বের সেরা ধনী অভিনেতাদের মধ্যে টম ক্রুজ ছিলেন ৫ নম্বরে। তিন তিনবার অস্কার মনোনয়ন পাওয়া এই তারকার ঝুলিতে রয়েছে ২৫০ মিলিয়ন ডলার। সিলভেস্টার স্ট্যালনের মতোই ৩৫ মিলিয়ন ডলারের একটি প্রাসাদের মালিক টম ক্রুজ।
টম ক্রুজের সব ছবিই যে ব্যবসাসফল হয়েছে, এমনটি নয়। ব্যর্থতার মুখ তাঁকেও ছাড়েনি। টম ক্রুজের ব্যবসা–অসফল ছবিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘নাইট অ্যান্ড ডে’ ছবিটি।